দু'নম্বরে নামবে তৃণমূল! বাংলায় পিকে-র বাণী ফলার সম্ভাবনা কতটা?
Lok Sabha Election 2024: এ রাজ্যে এক নম্বরে উঠে আসতে চলেছে বিজেপিই। শুধু বাংলায় নয়, গোটা পূর্ব ভারত ও দক্ষিণ ভারতেই চমকে দেওয়ার মতো ফল করতে চলেছে বিজেপি, তেমনই ভবিষ্যদ্বাণী প্রশান্ত কিশোরের।
ভোটের ময়দানের সারথী-কৃষ্ণ তিনি। যুদ্ধের মাঠে যে দলের পাশে তিনি, জয় যে নিশ্চিত তারই— এমন একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে ভারতীয় রাজনীতির অন্দরমহলে। এর অন্যথা হয়েছে মাত্র একবার। ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের ভারতীয় রাজনীতির রেকর্ড বলছে, মাত্র একবারই ব্যর্থ হয়েছে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের পরামর্শদাতা হিসেবে যোগ দিলেও কংগ্রেসকে জিতিয়ে আনতে পারেননি পিকে। মাত্র ১৪টি আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। মাঠে মারা গিয়েছিল পিকে-র রণনীতি। সম্প্রতি ভোটকুশলীর কাজ থেকে বিরাম নিয়েছেন প্রশান্ত কিশোর। বিহারে নিয়ম করে জনসূরজ যাত্রা করছেন। তবে আসন্ন লোকসভা ভোটের ফলাফল নিয়ে মাঝেমধ্যেই বিশেষজ্ঞের মত দিতে দেখা যাচ্ছে ভোটকুশলীকে।
কিছুদিন আগেই মন্তব্য করেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে বিজেপি। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ একাধিক বিজেপি নেতামন্ত্রীরা যে বারবার চারশো আসন পাওয়ার দাবি করে চলেছেন, তা ঠিক নয় বলেই মন্তব্য করেছিলেন পিকে। জানিয়েছিলেন, এ আসলে নরেন্দ্র মোদির সাইকোলজিক্যাল দাওয়াই। বিজেপিকে নিয়ে ধারণাকে পাল্টে দেওয়ার মোক্ষম চাল। ফের আরও একবার বিজেপিকে নিয়ে সেই একই সুর ফুটে উঠল পিকে-র কণ্ঠে। এমনকী পশ্চিমবাংলায় বিজেপির অবস্থান নিয়েও। সাফ জানালেন, এ রাজ্যে এক নম্বরে উঠে আসতে চলেছে বিজেপিই। শুধু বাংলায় নয়, গোটা পূর্ব ভারত ও দক্ষিণ ভারতেই চমকে দেওয়ার মতো ফল করতে চলেছে বিজেপি, তেমনই ভবিষ্যদ্বাণী প্রশান্ত কিশোরের।
গত বিধানসভা ভোটের আগে প্রশান্ত কিশোর দাবি করেছিলেন, বাংলায় বিজেপি তিন অঙ্কে পৌঁছবে না। নিজের সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়েও দিয়েছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। গত ভোটেও বাংলায় তৃণমূলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ছিলেন ভোটগুরু প্রশান্ত কিশোর। আইপ্যাকের সঙ্গে তৃণমূলের চুক্তি ছিল ২০২৬ পর্যন্ত। তবে তারা তেমন ভাবে সহায়তার দায়িত্ব পালন করছে না বলে অভিযোগ তুলে আইপ্যাকের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও, সরকারি ভাবে আইপ্যাকের সঙ্গে আর নেই প্রশান্ত কিশোরও। আপাতত ভোটকুশলীর দায়িত্ব ছেড়ে নিজের জনসূরজ যাত্রা নিয়েই ব্যস্ত প্রশান্ত কিশোর। তারই ফাঁকে জাতীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আসন্ন লোকসভা ভোটের ফলাফলের ব্যপারে একগুচ্ছ ভবিষ্য়দ্বাণী করলেন তিনি।
আরও পড়ুন: কেন ‘৪০০ পার’ বলছে বিজেপি? ফাঁস করলেন প্রশান্ত কিশোর
পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা পূর্ব ভারতে বিজেপির সম্ভাব্য ফল নিয়ে প্রশান্ত কিশোর বলেন, "ওড়িশায় বিজেপি নিশ্চিত ভাবে এক নম্বর দল হতে চলেছে৷ অনেকেই শুনে অবাক হতে পারেন, কিন্ত আমার মতে লোকসভা নির্বাচনে বাংলাতেও বিজেপি সম্ভবত এক নম্বর দল হিসেবেই উঠে আসবে৷ বিহারে বিজেপি মাত্র ১৭টি আসনে লড়ছে, কিন্তু সেই অনুপাতে আসন প্রাপ্তির নিরিখে বিহারেও বিজেপি এক নম্বর দলই হতে চলেছে৷" শুধু পূর্ব ভারত নয়, দক্ষিণ ভারতেও বিজেপির ফলাফল নিয়ে দারুণ আশাবাদী প্রশান্ত কিশোর৷ পিকের দাবি,"তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে বিজেপি ভোটের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়বে৷ আমি আসন সংখ্যার কথা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না৷ তবে তামিলনাড়ুতে বিজেপির আসন সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছবেই৷ তেলঙ্গানাতেও বিজেপি এক না হলে দু নম্বর দল হিসেবে উঠে আসবে৷ যা খুবই বড় বিষয় হতে চলেছে৷" একই সঙ্গে পিকে দাবি করেছেন, হিন্দি বলয় এবং পশ্চিম ভারতেও নিজেদের দুর্গ অটুট রাখবে বিজেপি৷ ওই অঞ্চলগুলিতে যদি কংগ্রেস ১০০-র বেশি আসন জয়ে সক্ষম হয়, তাহলেই বিরোধী পক্ষ বিজেপিকে কিছুটা চাপে ফেলতে সক্ষম হবে বলে মত প্রশান্ত কিশোরের৷ যদিও সেই সম্ভাবনা কার্যত নেই বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি৷ একই সঙ্গে প্রশান্ত কিশোরের পূর্বাভাস, অন্ধ্রপ্রদেশে এবার আর ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন না জগন্মোহন রেড্ডি৷ প্রসঙ্গত, লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গেই এবার অন্ধ্রপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনও হচ্ছে৷
তবে প্রশান্ত কিশোর যা-ই বলুন না কেন, এ রাজ্যের একাধিক কেন্দ্রে প্রার্থী দিতে রীতিমতো নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে বিজেপিকে। গো-বলয়ের রাজ্যগুলির মতো বাংলায় হিন্দুত্ববাদী হাওয়া ততটা চড়া নয় কোনওদিনই। ভোটের মুখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কুমন্তব্য করে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ও নির্বাচন কমিশন- দু'জায়গাতেই বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে বিজেপির বরিষ্ঠ নেতা দিলীপ ঘোষ। এ রাজ্যে একমাত্র বিজেপির কাণ্ডারি শুভেন্দু অধিকারী। একা হাতেই বঙ্গ বিজেপির রাজপাট সামলানোর চেষ্টা করে চলেছেন শুভেন্দু। তবে সেই একার জোরে ভোটের ময়দানে কতটা আসন কুড়োতে পারবে বিজেপি, তা নিয়ে সন্দেহ আছে ভালোই। তার উপর ভোটের ঠিক আগে আগেই সামনে এসেছে বিজেপির ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতির অভিযোগ। সে দিক থেকে জনগণের নজর ঘোরাতে তড়িঘড়ি সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (CAA) কার্যকর করার কথা ঘোষণা করে দিয়েছিল বিজেপি সরকার। বাংলা, অসমের মতো বহু রাজ্যের মানুষই সেই ঘোষণাকে ভালোভাবে নেয়নি। রীতিমতো বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল সিএএ-ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। সব মিলিয়ে বাংলায় তেমন ভালো জায়গায় নেই বিজেপি সরকার বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের। সন্দেশখালিকে ইস্যু করে এ রাজ্যের ভোটে বড়সড় আসন পাওয়ার চেষ্টা করলেও সেই কৌশল তেমন ভাবে কাজে আসেনি বিজেপির। ক্রমশ স্তীমিত হয়ে গিয়েছিল সন্দেশখালি প্রসঙ্গ। বরঞ্চ একাধিক আসনে বিজেপি প্রার্থীই দিয়ে উঠতে পারেনি এখনও। কিন্তু প্রশান্ত কিশোর বলছেন, এই লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে অভূতপূর্ব ফলাফল করতে চলেছে বিজেপি।
এখনও পর্যন্ত প্রশান্ত কিশোরের মুখ ফুটে বেরোনো অধিকাংশ ভবিষ্যদ্বাণীই বিফলে যায়নি। ২০১২ সালে গুজরাতে তাকে সঙ্গী করেই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মোদি। ২০১৪ সালে কাজ করেন লোকসভা ভোটে বিজেপির পরামর্শদাতা হিসেবে। তারপরেই কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। ২০১৫ সালে বিহারে জেডিইউয়ের ভোটকুশলী হন প্রশান্ত কিশোর, সেবার মুখ্যমন্ত্রী হন নীতীশ। ২০১৭ সালে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংকেও জিতিয়ে আনেন পঞ্জাবে। ২০১৯ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে তাঁর সহায়তাতেই চন্দ্রবাবু নায়ডু সরকারের পতন এবং উত্থান জগনমোহন রেড্ডির। ২০২০ সালে কাজ করেন দিল্লিতে আপের পরামর্শদাতা হিসেবে, এবং দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রীও হন কেজরিওয়াল। ২০২১ সালে জোটে বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে, বিপুল ভোটে জিতে তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরেন মমতা, ওই বছরই তামিলনাড়ুতেও ডিএমকে-র সঙ্গে কাজ করে এম কে স্ট্যালিনকে জিতিয়ে আনেন প্রশান্ত কিশোর। এত সাফল্যের মধ্যে তাঁর কথা ফলেনি শুধু একবার, ২০১৭ বিধানসভা ভোটে। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছিলেন পিকে। তবে কংগ্রেসকে জেতাতে ব্যর্থ হন।
সেই ব্যর্থতার কাঁটা বোধহয় আজও একইরকম করে বিঁধে রয়েছে ভোটগুরুর গলায়। এই লোকসভা ভোটের আসরে কংগ্রেসের অবস্থান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সেই ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেললেন ভোট-কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ প্রশান্ত কিশোর। তাঁর মতে, লোকসভা ভোটে কংগ্রেস ‘কাঙ্ক্ষিত ফল’ না করলে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত। রাহুল সম্পর্কে প্রশান্ত কিশোর সম্প্রতি জানিয়েছেন, “যখন গত দশ বছর ধরে আপনি একটি কাজ করে যাবেন, কিন্তু কোনও সাফল্য পাবেন না, তখন বিরতি নিলে আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। বরং আপনার উচিত অন্য কাউকে পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব দেওয়া।” এই প্রসঙ্গে সনিয়া গান্ধীর প্রসঙ্গ তুলে পিকে বলেন, “রাহুলের মা এটাই করেছিলেন।” পিকে স্মরণ করিয়ে দেন, রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর সনিয়া সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসে ১৯৯১ সালে পিভি নরসিংহ রাওকে নেতৃত্বে এগিয়ে দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে ভরাডুবির পর কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন রাহুল। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পিকে বলেন, “সেই সময় ওয়েনাড়ের সাংসদ (রাহুল) লিখেছিলেন যে, তিনি সরে যাচ্ছেন এবং অন্য কেউ তাঁর পরিবর্তে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবে তিনি যা লিখেছিলেন, তাঁর উল্টোটা করেছিলেন।” তার পরেই পিকে ইঙ্গিত করেন যে, কংগ্রেস নেতারা নিজেরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেন রাহুলই। রাহুলের বিরুদ্ধে খানিক অনুযোগের সুরেই ভোটকুশলীকে বলতো শোনা যায়, “তিনি মনে করেন, সব জানেন। আপনি যদি আপনার সাহায্যের প্রয়োজন, এটা মানতে না চান, তবে কেউ আপনাকে সাহায্য করবে না।” কংগ্রেসের ধারাবাহিক অবক্ষয়ের নেপথ্যে ‘সাংগঠনিক বিচ্যুতি’র কথা বললেও পিকে মনে করেন না দলটি ক্রমশ অবলুপ্তির পথে হাঁটছে বলেই মনে করছেন পিকে।
আরও পড়ুন: বাংলায় সন্দেশখালির জন্য কতটা আসন কমবে তৃণমূলের? প্রশান্ত কিশোর যা বলছেন
এমনকী দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভালো ফল সত্ত্বেও কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে ওঠার কোনও সুযোগ আম আদমী পার্টির নেই বলেও মনে করেছেন প্রশান্ত। তাঁর মতে, আপের কোনও আদর্শগত ভিত্তি নেই। তার থেকে তিনি বেশি প্রত্যয় রাখেন কংগ্রেসেই। ভারতের ইতিহাসে এর আগে এরাধিক বার কংগ্রেস রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন করেছে। ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটের কথা মনে করিয়ে পিকে জানান, সে বছরও বহু ভোট-অভিজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণীকে ভুল প্রমাণ করে ক্ষমতায় ফিরেছিল ইউপিএ জোট। তবে এই মুহুর্তে তেমন সুযোগ যে নেই, সে কথাও মনে করাতে ভোলেননি ভোটকুশলী। দক্ষিণ-পূর্ব ভারতে বিজেপির আসনসংখ্যা বাড়বে বলেই মনে করছেন তিনি। দেশের এই অংশেই আপাতত বিজেপি পিছিয়ে। আর এই ভোটে সেই অঙ্কই উল্টেপাল্টে যেতে চলেছে বলে মনে করছেন প্রশান্ত। আর বিরোধীদের আলস্য ও ভুল স্ট্র্যাটেজির জন্যই তেমনটা হলে চলেছে বলে মনে করছেন পিকে।
তবে বাংলাতে কি সত্যিই ফলতে চলেছে পিকে-র এই ভবিষ্যদ্বাণী? যেখানে হাওয়া কিন্তু বলছে উল্টোকথা। ভোটের মুখে একের পর এক জনমুখী প্রকল্পের ঘোষণা, ভাতাবৃদ্ধির মতো একের পর এক সিদ্ধান্তের ফলাফল এ রাজ্যে তৃণমূল ভালোই পেতে চলেছে বলে অভিজ্ঞদের একাংশের ধারণা। কেউ কেউ আবার আশাবাদী বামেদের ভালো ফল নিয়েও। দীপ্সিতা বা মহম্মদ সেলিমের মতো বামপ্রার্থীদের ভালো ফলের আশা রয়েছে এই ভোটে। রামমন্দিরের ধুয়ো দিয়ে উত্তরভারতের মন জিতলেও বাংলায় সেই প্রভাব কখনওই তৈরি করতে পারেনি বিজেপি। তার উপর রয়েছে সিএএ নিয়ে ক্ষোভ। এই আবহে আদৌ কি সত্যি হতে চলেছে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের ভবিষ্যদ্বাণী? নাকি ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেসের জন্যে যে ব্যর্থতার দাগ কেরিয়ারে লেগেছিল পিকে-র, তেমন ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে এই লোকসভা ভোটে। অন্তত বাংলায় তো বটেই।