এক দেশ এক নির্বাচনের পক্ষেই সওয়াল প্রশান্ত কিশোরের! মোদি ঘনিষ্ঠ হতে চাইছেন পিকে?
Prashant Kishor on One Nation One Election: পিকে বলছেন, এই এক দেশ, এক নির্বাচন মডেলে ভোট ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যেই হওয়া উচিত
বাংলায় বিজেপিকে ঠেকাতে তিনি যে কী ভূমিকা নিয়েছিলেন বঙ্গবাসী জানে। 'নো ভোট টু বিজেপি'- এই একটি বাণীতে তৃণমূল কংগ্রেস বিধানসভা ভোটে গলার সবচেয়ে বড় কাঁটাটি উপড়ে ফেলেছিল। পেশায় তিনি নির্বাচনী কৌশলী। কাকে কীভাবে ঠেকাবেন, কীভাবে কোন চালে ভোটারদের মন জিতবেন, কাকে কীভাবে কতখানি সামনে আনতে হবে, কাকে ঠেলে দিতে হবে পিছনের সারিতে, তিনি জানেন। একদিকে তিনি বাংলায় বিজেপিকে ঠেকিয়ে দেন, অন্যদিকে বিজেপির সিদ্ধান্তকে সমর্থনও করেন। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি বিরোধী 'ইন্ডিয়া' জোট গঠনের উদ্যোগকে তাই কটাক্ষ করেছিলেন প্রশান্ত কিশোর। সেই পিকে বলছেন, নরেন্দ্র মোদি সরকার যে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ নীতি রূপায়ণ করতে চলেছে তা যথেষ্ট ভালো উদ্যোগ। পিকে বলছেন, ‘সঠিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণয়ন করা হলে ‘এক দেশ এক নির্বাচন' আসলে জাতীয় স্বার্থেরই পন্থী।
রাজনৈতিক কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোর এই বক্তব্যে সামান্য একটি ‘খিঁচ’ রেখে দিয়েছেন। সঠিক উদ্দেশ্য শব্দটি। এক দেশ, এক নির্বাচন ধারণাটি ভালো, কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি সাক্ষাৎকারে পিকে বলছেন, এক দেশ এক নির্বাচন নিয়ে তাঁর কোনও সমস্যা নেই। তবে নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয় তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি ছয় মাস পরপর নির্বাচন করা কোনওভাবেই কাজের কথা নয়। এই পৃথক পৃথক সময়কালের বিধানসভাগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে লোকসভার সঙ্গে তা মিলিয়ে নির্বাচন করতে গেলে তাহলে আদর্শ সময় কী হওয়া উচিত?
আরও পড়ুন- বিজেপি আর সংঘ ‘এক দেশ এক নির্বাচন’-এর নামে আসলে কী করতে চাইছে?
পিকে বলছেন, এই এক দেশ, এক নির্বাচন মডেলে ভোট ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যেই হওয়া উচিত কারণ এপ্রিল-মে মাসে নির্বাচন হলে যে কোনও সরকার পাঁচ বছরের মেয়েদের প্রথম ছয় মাসেই হেরে যাবে। পিকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ভারতের মতো বড় দেশে প্রতি বছর দেশের প্রায় ২৫% ভোট দেয়। তাই নির্বাচনের এই আবর্তে ব্যস্ত থাকে সরকার। যদি ভোট বিষয়টা ১-২ বারের মধ্যে সেরে ফেলা যায় তাহলে খরচ কমবে তো বটেই, জনগণকেও বারবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। তবে, রাতারাতি পরিবর্তনের চেষ্টা করলে সমস্যা হবে ঠিকই। তাই সরকার সম্ভবত একটি বিল আনছে। বিল আসুক। সরকারের যদি ভালো উদ্দেশ্য থাকে তবে এটা হওয়া উচিত, দেশের জন্য ভালোই হবে, বলছেন পিকে।
‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ কার্যকরী হলে জাতীয় ব্যয় এবং ভোটারদের ক্লান্তি কমবে ঠিকই, তবে এই উদ্যোগের ফলে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসতে পারে বলেও মনে করছেন তিনি।
লোকসভা ভোটের সঙ্গেই সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট মিটিয়ে নেওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে তাতে বিজেপি সরকারের অন্যতম যুক্তি হচ্ছে নির্বাচনের খরচ বিপুল হারে কমানো। একটি ভোটার তালিকাতেই দু’টি নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় ফলে সরকারি ভোটকর্মীদের তালিকা তৈরির চাপ কমবে। ভোটের আদর্শ আচরণ বিধির জন্য বার বার সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে বাধা পড়বে না।
প্রশান্ত কিশোর বর্তমানে একেবারে বুনিয়াদি স্তরে বিষয়গুলি বোঝার লক্ষ্যে বিহার জুড়ে পদযাত্রা করছেন। বিহারে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করার দিকেই এখন নজর দিয়েছেন তিনি। নতুন দল ঠিকই, তবে তা কোনও একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেতৃত্বে নয়। সাধারণ মানুষের সমর্থনে গঠিত একটি দল। খোলাখুলি বিজেপিকে সমর্থন করছেন কি পিকে? এবার কি বিজেপিতেই যোগ দেবেন তিনি? প্রশান্ত কিশোর অবশ্য নিজের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বিজেপি হোক INDIA হোক, কোনও কোনও রাজনৈতিক দল বা জোটেই তিনি যোগ দিতে আগ্রহী নন।
এবার দেখা যাক, ভারতের নির্বাচনী ইতিহাস কী বলছে? ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত রাজ্যের বিধানসভা এবং লোকসভার একসঙ্গেই নির্বাচন হতো ভারতে। ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ সালে কিছু বিধানসভা এবং ১৯৭০ সালে লোকসভা অকালে ভেঙে গেলে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়।
এর এক দশক পর, ১৯৮৩ সালে নির্বাচন কমিশন একসঙ্গে নির্বাচন আয়োজন ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেয়। তবে কমিশন তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তৎকালীন সরকার এর বিরুদ্ধেই সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৯ সালের আইন কমিশনের রিপোর্টে আবার একসঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টিকে জোর দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন- এক দেশ, এক নির্বাচন! সারা দেশে একসঙ্গে নির্বাচন কেন চাইছে বিজেপি?
এইবার বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে বিজেপি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নিজেদের নির্বাচনী ইস্তাহারেই বলেছিল যে রাজ্য সরকারগুলির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য একসঙ্গে সমস্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি পদ্ধতি তৈরি করতে চাইবে বিজেপি৷ ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আবারও বিষয়টা নিয়ে কথাবার্তা বলতে থাকেন। ২০১৭ সালে, নীতি আয়োগ একসঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে।
২০১৮ সালে আইন কমিশন জানায়, একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য কমপক্ষে পাঁচটি সাংবিধানিক সুপারিশের প্রয়োজন। ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র এক মাস পরেই প্রধানমন্ত্রী মোদি একসঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানদের সঙ্গে দেখা করেন। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বহুজন সমাজ পার্টি, সমাজবাদী পার্টি এবং দ্রাবিড় মুনেত্র কাঝঘম সহ বেশ কয়েকটি বিরোধী দল এই বৈঠক থেকে দূরে ছিল। আম আদমি পার্টি, তেলেগু দেশম পার্টি এবং ভারত রাষ্ট্র সমিতি অবশ্য যোগ দেয় সেই বৈঠকে।
২০২২ সালে, তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুশীল চন্দ্র জানিয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশন একসঙ্গে সব নির্বাচন পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং সক্ষম। তবে এই ধারণাটি বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে এবং সংসদে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ওই বছরই ডিসেম্বরে আইন কমিশন দেশে একসঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাবে জাতীয় রাজনৈতিক দল, ভারতের নির্বাচন কমিশন, আমলা, শিক্ষাবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত চেয়েছিল।