নেই খাবার, জল! যেভাবে ক্রীতদাসী হচ্ছেন মহিলারা, বেঁচে ফেরার অভিজ্ঞতা চমকে দেবে

Punjab Women Sold in Muscat: বন্দি করে রাখা ওই ৩৫ জন মহিলাকে দিনে ন্যূনতম সেটুকু খাবারই দেওয়া হতো যাতে না খেয়ে কেউ মারা না যান।

মাস মাইনে ৩০ হাজার টাকা। কাজ বলতে, অন্যের দেখভাল, বাড়ির কাজকর্ম, পরিচারিকার যা যা দায়িত্ব হয় তেমনই আর কী। তবে যেতে হবে বিদেশে, ওমান। অভাব ডেকে আনে প্রয়োজন, আর প্রয়োজনের ছায়া হয়ে আসে বেপরোয়া চাহিদা। সাহসে ভর করে বেপরোয়া মানুষ প্রয়োজন মেটাতে ঢুকে পড়ে এমন গোলকধাঁধায় যেখান থেকে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখা যায়। যেমন দেখলেন পঞ্জাবের কাপুরথালার এক অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের মহিলা, অভাব আর প্রয়োজনের ছকে পড়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যার সঙ্গী হয়ে রইল আজীবনের। ওমানের রাজধানী মাস্কটে কীভাবে দিন কাটিয়েছেন, কীভাবে বেঁচে ছিলেন সেই অভিজ্ঞতার প্রতিটি বর্ণনা শিউরে তোলার মতো। এখনও ক্রীতদাস প্রথা ঘুচল না, পোশাক পালটে এখনও চলছে মানুষের কেনাবেচা। পঞ্জাবের এই মহিলাকেও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল, বাধ্য করা হয়েছিল 'অনৈতিক কার্যকলাপে'।

এই মহিলা দেশে ফিরেছেন ২ মাস পরে। ২ মাসে তাঁর অন্তত ২ বছরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে। ফিরে এসে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি জানিয়েছেন, পঞ্জাব থেকে মহিলাদের পরিচারিকার চাকরির অজুহাতে ওমানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে সেই দেশে গিয়েই বদলে যাচ্ছে সব প্রতিশ্রুতি। চাকরির পরিবর্তে এই মহিলাদের স্থানীয় মানুষদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে এবং তাঁদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তাহলে সবটা বুঝেও কেন প্রতিবাদ করছেন না তারা? ওই মহিলা জানিয়েছেন, দেশে ফেরার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেই হুমকি দেওয়া ও মারধর করা হয়। প্রতিরোধ করলেই দীর্ঘদিন ধরে না খেতে দিয়ে রেখে দেওয়া হয় মহিলাদের।

আরও পড়ুন- অনলাইন কেলেঙ্কারির ফাঁদ পেতে ভয়াবহ মানুষ পাচারচক্র! বাংলাদেশে বিছিয়ে রয়েছে যে জাল

কীভাবে এই চক্রে পড়লেন তিনি? তাঁর মামীই নাকি কাজের অজুহাত দেখিয়ে মাস্কটে পাঠান ওই মহিলাকে। কাজের বিনিময়ে মাসে ৩০ হাজার টাকা! আর কাজ বলতে স্থানীয় এক হাসপাতালের কেয়ারটেকার। উপার্জনের স্বপ্নে গত ১৬ মার্চ ওমানে আসেন তিনি। পঞ্জাব থেকে ওমান আসার বিষয়টি দেখভালের জন্য ছিলেন এক ট্রাভেল এজেন্ট। সেই মহিলা আবার তাঁর কাছ থেকে যাতায়াত, পাসপোর্ট, ভিসা, সমস্ত ব্যবস্থাপনার জন্য ৭০,০০০ টাকা নিয়েছিলেন। এই ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমেই পরে মাস্কটের কিছু স্থানীয় লোকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় পঞ্জাবের বাসিন্দা ওই মহিলাকে।

“আমি ১৬ মার্চ ওখানে যাই, তখন সেখানকার এজেন্টরা আমার পাসপোর্ট এবং ফোন নিয়ে চলে যায় আর আমাকে একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। আমাকে কোনও খাবার দেওয়া হয়নি। পরে আমি দেখতে পেলাম যে পঞ্জাবের আরও ৩৫ জন মহিলাকেও সেখানে আটকে রাখা হয়েছে। আমি ওই মহিলাদের সঙ্গেই ছিলাম। আমি যখন এজেন্টদেরকে হাসপাতালের সেই কেয়ারটেকারের চাকরির কথা জিজ্ঞেস করি তখন তারা আমাকে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করে," দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন ওই মহিলা। কোনও রকমের বেআইনি, অনৈতিক কাজে জড়াতে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। ফলে যা হওয়ার তাই! ব্যাপক মারধর করা হয় তাঁকে।

সেদেশে বসেই কোনওরকমে মামীকে ফোন করেন তিনি। প্রত্যুত্তরে মামী জানান, এজেন্টরা যা বলছে সেই নির্দেশ মেনে চললেই মঙ্গল। 'মঙ্গল'-এর হিসেবনিকেশও দিয়েছেন তিনি। বন্দি করে রাখা ওই ৩৫ জন মহিলাকে দিনে ন্যূনতম সেটুকু খাবারই দেওয়া হতো যাতে না খেয়ে কেউ মারা না যান। এই সময়ে দাঁড়িয়েও, চারদিকে এই ধরনের হাজারো খবর জানা সত্ত্বেও কী করে অন্ধভাবে ভরসা করে বসলেন বিদেশ বিভুঁইয়ের এজেন্টদের! ওই মহিলা জানিয়েছেন, এমন যে ঘটে তা জানতেনই না তিনি। কোনওদিন কোনও খবর তিনি দেখেননি। এই ধরনের ঘটনা সম্পর্কে অবগতই নন কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গেও তাঁর কোনও যোগাযোগ নেই। পাঁচ বছরের কন্যার ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের জীবন প্রায় খোয়াতে বসেছিলেন তিনি। মেয়ের জন্য সুখের বন্দোবস্ত করতেই চেনা পরিধি ছেড়ে টাকা রোজগার করতে দূরে চলে যেতে রাজি হয়ে যান।

আরও পড়ুন- পান থেকে চুন খসলে ইলেকট্রিক শক! বিদেশে চাকরির নামে যেভাবে নয়া দাসত্বের শিকার ভারতীয়রা

২ মাস প্রায় নরক গুলজারের পর ওই মহিলার স্বামী হরদীপ সিং, ১৬ মে বলবীর সিং সিচওয়ালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রাজ্যসভার সদস্য সন্ত বলবীর সিং সিচেওয়ালের প্রচেষ্টায় পাঁচ দিনের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসেন ওই মহিলা, সুস্থভাবে। বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই মহিলাকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নেন বলবীর সিং সিচওয়াল। তিনি জানিয়েছেন, এই ধরনের এজেন্টরা এই মহিলাদের সঙ্গে সাধারণত দুই বছরের চুক্তি করে, তাই ফিরতে চাইলেও সব প্রতিরোধ বিফলে যায়। এখনও মাস্কটে আটকে পড়ে আছেন এই মহিলার মতোই অনেকে। অন্যের কাছে বিক্রি হয়ে, বেঁচে থাকার বিনিময়ে যে কোনও কাজে রাজি হতে বাধ্য হয়ে এখনও নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে সুদূর ওমানে আটকে পড়ে রয়েছেন অনেকেই। দেশে ফেরার কোনও আশার আলো তাঁদের ছুঁতে পারেনি এখনও।

পঞ্জাবের নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী ডঃ বলজিৎ কৌর জানিয়েছেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। তাঁর মতে, পরিচারিকারা নিজেরাও বিদেশে যেতে চান কিন্তু এর নেপথ্যের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেন না। কীভাবে তাদের বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শোষণ করা হয়, তা জানতেও পারেন না। বলজিৎ কৌর জানিয়েছেন, এই মহিলারা কেন বিদেশে যেতে চান তার মূল কারণের দিকে নজর দিতে হবে। এজেন্টরাই এই ধরনের কাজের পিছনে রয়েছে। তাই অপরাধীদের ধরতে হবে সবার আগে। সরকার ও এনজিওগুলির একসঙ্গে কাজ করার কথাও জানিয়েছেন বলজিৎ।

More Articles