জগন্নাথের রথ এক ইসলাম সম্প্রদায়ের ভক্তের সমাধির সামনে এসে থামে আজও

অনেকেই হাত লাগান রথের রশিতেও। এই দিনটি নেত্র উৎসব বা নব যৌবন বেশ হিসেবে পালন করা হয়।

আবার চেনা ছবি। পুরীতে আগের মতো উৎসবের মেজাজ। রথের রশিতে পড়বে টান। আজ ১ জুলাই, রথযাত্রা।

রথযাত্রার আগের দিন, ৩টি রথ নিয়ে আসা হয় মন্দিরের সিংহ দুয়ারের বাইরে। প্রথমে জগন্নাথ দেবের রথ। এরপর দেবী সুভদ্রা এবং বলভদ্রের রথ নিয়ে আসা হয়। এদিনই রথের রশিতে টান দিয়েছেন অনেকেই। যদিও এদিন রথে ছিল না বিগ্রহ। বিগ্রহ ছাড়াই এদিন তিনটি রথ নিয়ে আসা হয়। এদিন এই দৃশ্য দেখার জন্য সকাল থেকে ভিড় করেছেন সাধারণ মানুষ। অনেকেই হাত লাগান রথের রশিতেও। এই দিনটি নেত্র উৎসব বা নব যৌবন বেশ হিসেবে পালন করা হয়।

রথযাত্রা বলতেই সবার আগে নাম আসে পুরীর। কারণ, পুরীকে অনুসরণ করেই বাকি সব জায়গায় রথযাত্রা হয়। আর, সব কিছুরই একটা ইতিহাস আছে। কিন্তু, কবে থেকে পুরীতে রথযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়।

এক্ষেত্রে অনেকেই ভরসা রাখেন ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’-এর ওপর। এই পুঁথি অনুযায়ী, মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নর আমলে জগন্নাথদেব, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি তৈরি হয়। একইসঙ্গে রথযাত্রাও চালু হয়। বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের দাবি, ১০৭৮ সালে তৈরি হয়েছিল পুরীর জগন্নাথ মন্দির। ১১৭৪ সালে মেরামরির পর তা বর্তমান জগন্নাথ মন্দিরের চেহারা নেয়।

কিন্তু, আবার ‘রথ চকদ’ নামে আর একটি গ্রন্থে আছে যে আটের শতকে রাজা যযাতি কেশরী রথযাত্রা উৎসব উদযাপন করেছিলেন। সেই সময় তিনি শ্রীজগন্নাথদেব, বলরাম এবং সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

‘মাদলা পঞ্জী’ নামে একটি কালানুক্রমিক বিবরণমূলক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আগে শ্রীজগন্নাথ মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দিরে যাওয়ার পথে ‘মালিনী নদী’ নামে একটি নদী পড়ত। ওই নদী ‘বডা নাই’ বা বড় নদী নামেও পরিচিত ছিল। ওই সময়ে রাজার ছয়টি রথ এই রথযাত্রায় অংশ নিত। শ্রীজগন্নাথদেব, বলরাম এবং সুভদ্রা এবং সুদর্শন চক্রকে ওই নদীর দিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি রথ ব্যবহৃত হত। তারপর বিগ্রহগুলি নদীর অপর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হত নৌকোয় চাপিয়ে। সেখান থেকে গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত শ্রীজগন্নাথদেব, বলরাম এবং সুভদ্রাকে বহন করার জন্য আরও তিনটি রথ থাকত।

আরও পড়ুন-স্বয়ং জগন্নাথের লীলা না কি অন্য অলৌকিক— পুরীর মন্দিরে যে রহস্যের উত্তর পাওয়া যায়নি আজও 

পৌরাণিক কাহিনি

পুরাণ অনুযায়ী একদা সুভদ্রা নিজের বড়ভাই কৃষ্ণ ও বলরামের কাছে নগর দেখার ইচ্ছা জাহির করেন। তখন দুই ভাই ও বোন রথে বসে নগর ভ্রমণের জন্য বের হন। পথে গুন্ডিচায় নিজের মাসির বাড়ি যান তাঁরা। এখানে ৭ দিন থাকেন তাঁরা। এ সময়ে নগরের যাত্রা পূর্ণ করে পুরী ফিরে আসেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী তার পর থেকেই এখানে রথযাত্রার আয়োজন করা হয়ে আসছে। পুরীর রথযাত্রা বিশ্ববিখ্যাত। তবে শুধু পুরীই নয়, দেশের বিভিন্ন ইস্কন মন্দিরে রথ যাত্রার আয়োজন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে সাড়ম্বরে পালিত হয় রথ। পশ্চিমবঙ্গের মাহেশ, মহিষাদলের রথযাত্রা অত্যন্ত বিখ্যাত।

সমাধিতে এসে থেমে যায় জগন্নাথের রথ

নগর যাত্রার সময় জগন্নাথের রথ তাঁর এক ইসলাম সম্প্রদায়ের ভক্তের সমাধির সামনে এসে কিছু ক্ষণের জন্য থেমে যায়। প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী জগন্নাথের এই ভক্তের নাম সালবেগ। জগন্নাথের দর্শনের জন্য মন্দির পৌঁছতে পারেননি তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়। তাঁর এই সমাধির সামনে এসে জগন্নাথের রথ নিজে থেকেই দাঁড়িয়ে পড়ে। শত চেষ্টা করও কিছু ক্ষণের জন্য রথের চাকা ঘোরানো যায় না। তার পর সালবেগের আত্মার উদ্দেশে শান্তি কামনা করলে রথ এগোতে শুরু করে। তার পর থেকেই প্রতিবছর সালবেগের সমাধিতে রথ থামানো শুরু হয়।

সকাল থেকে হোমযজ্ঞ, নিবেদন করা হয় ৫৬ ভোগ। রূপোর হাত পরানো হয় দারু বিগ্রহকে। নবযৌবন উৎসব উপলক্ষে সকাল থেকেই মন্দির চত্বরে ছিল ভক্ত সমাগম। কী এই ৫৬ ভোগ?

জগন্নাথ হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণু বা তাঁর অবতার কৃষ্ণের একটি বিশেষ রূপ। তাঁকে তাঁর দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে পূজা করা হয়। পুরীতে রথযাত্রা উৎসবে রথে আরূঢ় জগন্নাথ বিগ্রহ। জগন্নাথের মূর্তি সাধারণত কাঠে তৈরি করা হয়। জগন্নাথের মধ্যে বিষ্ণুর সকল অবতারের চিহ্ন আছে। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে তাঁকে বিষ্ণুর এক একটি অবতারের মূর্তিতে পুজো করা হয়। ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত করা হয় তাঁকে। আর সেই কারণে তাঁকেও অর্পণ করা হয় ছাপান্ন ভোগ।

কথিত আছে, ভগবান বিষ্ণু মর্ত্যলোকে এসে তাঁর চার ধামে যাত্রা করেন। এই চার ধাম হল- বদ্রীনাথ ধাম, দ্বারিকা ধাম,পুরী ধাম এবং রামেশ্বরম। প্রথমে হিমালয়ের শিখরে অবস্থিত বদ্রীনাথ ধামে স্নান করেন, তারপর গুজরাটের দ্বারিকা ধামে গিয়ে বস্ত্র পরিধান করেন, ওড়িশার পুরী ধামে ভোজন করেন আর সবশেষে রামেশ্বরমে গিয়ে বিশ্রাম নেন। আর পুরী ধামে যেখানে তিনি ভোজন করেন সেখানে ভোগের কোনও চমক থাকবে না এটা কখনও হয়। সেখানেই তাঁকে ছাপ্পান্ন ভোগ দেওয়া হয়।

পুরাণে ৫৬ ভোগ

পুরীর মন্দিরে বাইরে থেকে আনা কোন খাবার জগন্নাথকে দেওয়া যায় না। নির্দিষ্ট জায়গা থেকে সংগ্রহ করা কাঁচা জিনিস রান্নাঘরে রান্না করে মহাপ্রভুকে দেওয়া হয়। জগন্নাথের ভোগে মূলত দুই ধরনের খাবার দেওয়া হয়। ভাত, ডাল, তরকারি, খিচুড়ি জাতীয় রান্না করা খাবার যাকে ‘শঙ্খুড়ি’ বলা হয়। আর খাজা, গজা, খই, মুড়কি জাতীয় শুকনো খাবার যাকে বলা হয় শুখুলি। পুরানের কাহিনী অনুযায়ী শ্রী কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বত তুলে ধরে মহাপ্রলয় থেকে প্রাণীকূলকে রক্ষা করেছিলেন। এই ভাবে সাত দিন কনিষ্ঠ আঙ্গুলে পাহাড় তুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। শ্রীকৃষ্ণ প্রতিদিন আট বার খেতেন। তবে এই সাত দিন তিনি কিছুই খাননি। সাতদিন পর প্রলয় বন্ধ হলে তিনি পাহাড় নামিয়ে রাখেন। তখন গোপবাসীগণ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাঁকে সাতদিনের আট রকমের মোট ৫৬ রকমের রান্না করে ভোগ নিবেদন করেন। সেই থেকেই ৫৬ ভোগ চলে আসছে।

রথযাত্রার সবচেয়ে ঐশ্বরিক চিত্রগুলির মধ্যে একটি হল যখন ভগবান জগন্নাথ তার ভাই বলরাম এবং বোন সুভদ্রার সঙ্গে তিনটি রথে চড়ে। তিনটির রথ আলাদা এবং দেশ-বিদেশের কয়েক লক্ষ ভক্ত এই রথের দড়ি টানতে মন্দিরে উপস্থিত হন। হাজার মানুষের আবেগ সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলে তিন-রথ। ভক্তিরসে জারিত হয়ে রথের রশিতে টান দেন ভক্তরা। সমুদ্র তীরে তখন উৎসবের আকুলতা।

More Articles