সেদিন রবি ঠাকুর মঞ্চ ছাড়তেই হইহই শুরু হয়েছিল

Valmiki Pratibha Rabindranath Tagore: দেখলাম, দস্যুপতি বাল্মীকির বেশে কবির প্রবেশ – লম্বা জোব্বা পরা, গলায় শঙ্খ ঝুলছে – ডাকাত ডাকবার।

আভিধানিক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ শব্দাম্বুধি উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর চার দশকের কর্মিষ্ঠ সাধনার ফলই বঙ্গীয় শব্দকোষ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই এই পর্বত গ্রন্থণের জন্য মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্রের কাছ থেকে তাঁকে প্রয়োজনীয় বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেন। পতিসরে ঠাকুরবাড়ির জমিদারির তদারকির কাজ থেকে তাঁকে শান্তিনিকেতনে শিক্ষক পদে নিয়োগ করেন তিনিই। একান্ত আলাপে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিপ্রায় জানান – "বাংলায় ভাল অভিধান নাই। তোমাকে সময়োপযোগী একখানি বাংলা অভিধান লিখতে হবে।" এই আদেশ শিরোধার্য করেই আনুমানিক ১৩১২ সনে হরিচরণ অভিধান রচনা শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স ওই ৩৭-৩৮। অভিধান রচনার কাজ শেষ হয় ১৩৩০ বঙ্গাব্দে! অভিধান লেখা শেষ হলেও তখনই তা ছাপার সামর্থ্য বিশ্বভারতীর ছিল না। বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এমন বিপুল কাজ, এই পরিমাণ শ্রম ও নিষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করে যাওয়ার কাজটি একাই করেছিলেন তিনি, দীর্ঘ দীর্ঘ বছরের নিবিড় সাধনায়! অনেক ছোটবেলা থেকেই জোড়াসাঁকোতে যাতায়াত ছিল তাঁর, দাদার সুবাদে। সেই জোড়াসাঁকোতেই হরিচরণ দেখেছিলেন কবির অভিনয়! বাল্মীকি প্রতিভার শেষ অভিনয় ছিল সেটিই। রবীন্দ্রনাথের প্রথম অভিনয় দেখার স্মৃতিচারণ পুনর্মুদ্রিত হলো ইনস্ক্রিপ্টের রবিবারের রোয়াকের এই পর্বে।

বাল্মীকির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়

অবনীন্দ্রনাথের ‘ঘরোয়া’য় দেখা যায়, কবির ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মধ্যে মধ্যে অভিনীত হত, সুতরাং এর অনেকবার অভিনয় হয়েছে; এর মধ্যে শেষ অভিনয় আমার প্রবন্ধের বিষয়।

আমার বয়স তখন ১৫-১৬ বছর – পাড়াগাঁয়ের স্কুলে পড়তাম – গ্রীষ্মের ও শীতের ছুটিতে কলকাতায় আসতাম। আমার বড়দাদা মহর্ষিদেবের সংসারে খাজাঞ্চি ছিলেন – কলকাতায় তাঁর বাসায় থাকতাম, কিন্তু আমার অধিকাংশ সময়ই তাঁর অফিসে কাটত। তাঁর কাছে কবির অনেক কথা শুনতে পেতাম। একবার শীতের ছুটিতে কলকাতায় এসেছি – বড়দাদার কাছে শুনলাম, বাবুদের বাড়িতে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র অভিনয় হবে – খুব ধুমধাম – প্রত্যহই রিহার্সাল হচ্ছে। কবির কলকণ্ঠের গানের ভূয়সী প্রশংসা আগেই লোকের মুখে মুখে শুনেছিলাম – শ্রবণপ্রত্যক্ষ করার ভাগ্য কখনও হয়নি। তাই অভিনয়ের কথা শুনে বড় আনন্দ হল। তখন বড়দাদা বললেন, “দুদিন অভিনয় হবে – প্রথম দিন সাহেব-সুবো, কলকাতার বড় বড় গণ্যমান্য লোক অভিনয় দেখবেন – পর দিনের অভিনয় সাধারণের জন্য, সে দিন তুমি গেলে দেখতে পাবে”। আমি সেই আশায়ই থাকলাম।

বাড়িতে এই শেষ ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র অভিনয়ে খুব ধুমধামই হয়েছিল সত্য। এর পরে শান্তিনিকেতনে কবির উদ্যোগে মাঝে মাঝে ছাত্র-ছাত্রীদের এই নাটকের অভিনয় দেখেছি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে এ সব অভিনয়ের তুলনাই হয় না। তখন লর্ড ল্যান্স ডাউন বড়লাট। ‘ঘরোয়া’য় দেখা যায়, মহর্ষিদেব এই অভিনয়ের মূল কারণ, তাঁর কি খেয়াল হয়েছিল, লেডী ল্যান্স ডাউনকে পার্টি দেবেন, তাই তাঁর হুকুম ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র অভিনয় হবে। শ্রীমতী ইন্দিরা দেবীর (রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী) নিকট শুনেছি, সত্যেন্দ্রনাথ এক বার যখন বিলাত থেকে আসেন, সেই সময়ে সেই জাহাজে লেডী ল্যান্স ডাউন যাত্রী ছিলেন। কথোপকথন প্রসঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ লেডী ল্যান্স ডাউনকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আহ্বান করার কথা উত্থাপন করেন। বোধ হয় এ কথা ক্রমে ক্রমে মহর্ষিদেবের কানে উঠেছিল, তাই তাঁর এরূপ খেয়াল। মূল কারণ যাই হোক, এইবার ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র অভিনয় সর্ববিলক্ষণ – খুব জাঁকজমক হয়েছিল। অর্ধচন্দ্রাকারে নির্মিত রঙ্গমঞ্চের সুশোভন সজ্জা – নাটকীয় দৃশ্যপটে স্বভাবের অনুকরণে বনের নিখুঁত পরিপাটি – দস্যুদলপতি ও দস্যুদের অনুরূপ পোশাক পরিচ্ছদ, কবির দস্যুপতি বাল্মীকির সাজ, - আর আর অভিনেতা অভিনেত্রী, সকলেরই পাত্রোচিত বেশভূষা – সবই বেশ মনোমোহকর হয়েছিল – তাই বলি, এ অভিনয় সর্ববিলক্ষণ।

বড়দাদার সঙ্গে আমি অভিনয় দেখতে গেলাম। বাড়ির মধ্যে যে বিস্তৃত আঙিনা, দেখলাম তা শ্রেণীবদ্ধভাবে উপবিষ্ট দর্শকে পরিপূর্ণ – মাথায় মাথায় লাগালাগি – মাথায় মাথায় মাথাময় – ন স্থানং তিলধারণে। আঙিনার উত্তরে দালান – তার বারান্দায় কোন প্রকারে একটু স্থান হল। দূর হলেও সেখান থেকে রঙ্গমঞ্চ বেশ দেখা যাচ্ছিল। নাটক আরম্ভ হল। প্রথমে বনদেবীর নৃত্য – পরে দস্যুদলের আবির্ভাব। ..... আমি এসব দেখছিলাম বটে, কিন্তু মনে একটা কথা সর্বদাই জাগছিল – সেটা কবির কথা, কতক্ষণে বাল্মীকির বেশে কবিকে দেখব – কখন তাঁর কলকণ্ঠের গান শুনতে পাব। অত্যন্ত ঔৎসুক্য – তখন দেখলাম, দস্যুপতি বাল্মীকির বেশে কবির প্রবেশ – লম্বা জোব্বা পরা, গলায় শঙ্খ ঝুলছে – ডাকাত ডাকবার। একে কবির সহজ মনোমোহন রূপ, তাতে যৌবনের ললিত লাবণ্যচ্ছটা, অনুকূল পোশাক পরিচ্ছদে সৌষ্ঠবসম্পন্ন – তাতে আবার রঙ্গমঞ্চের পরিস্ফুট আলোকপ্রভা প্রতিভাত – সে সৌন্দর্য আরও মনোমোহকর হয়েছে। দর্শকেরা কবির সেই বাল্মীকি বেশ দেখে চিত্রার্পিতের মত নিস্পন্দ নির্বাক নির্নিমেষনেত্র। তখন কবির কলকণ্ঠে সঙ্গীত শোনা গেল – কবি গাইলেন,

‘এক ডোরে বাঁধা আছি মোরা সকলে।
না মানি বারণ, না মানি শাসন, না মানি কাহারে।।
কে বা রাজা, কার রাজ্য, মোরা কি জানি?
প্রতি জনেই রাজা মোরা, বনই রাজধানী’!ইত্যাদি।

এর পরে বাল্মীকির প্রস্থান। তার পরে, দৃশ্য কালী প্রতিমা – বাল্মীকির স্তবগান,

‘রাঙা পদ পদ্মযুগে প্রনমি গো ভবদারা।
আজি এ ঘোর নিশীথে পূজিব তোমারে তারা।।
সুরনর থরহর – ব্রহ্মাণ্ড বিপ্লব কর,
রণরঙ্গে মাতো মা গো, ঘোর উন্মাদিনী পারা’। ইত্যাদি

একে মধুর কণ্ঠ, তাতে সময়োপযোগী বাগেশ্রী রাগিণীর সুরে ছন্দোবন্ধনে – সেই স্তুতিগীতি স্বরসম্পদে সম্পূর্ণ হয়ে আসর একেবারে মাত করে ফেললে! গান গাওয়া শেষ হলো – বাল্মীকি নেপথ্যের অভিমুখ হলেই, দর্শকদের মধ্যে মহাকোলাহল উঠলো – ‘এনকোর’ ‘এনকোর’! সকলেই কবির সেই এক ফেরতা গান শুনে তৃপ্তি লাভ করতে পারেন নি, আবার শোনবার জন্যে সমুৎসুক! কবি কি করবেন – আবার ফিরলেন – গানের পূর্ববৎ আমুল পুনরাবৃত্তি হল – কবি নেপথ্যে অন্তর্হিত হলেন। আর ‘এনকোর’ হল না, কিন্তু সকলে অতৃপ্ত না হলেও, সুতৃপ্ত হওয়ার ভাব মুখে দেখা গেল না – আমি সামান্য শ্রোতা – দর্শক, আমার কথা কি বলবো! এর পরে সরস্বতীর আবির্ভাবে তদগতচিত্ত কবির রামপ্রসাদী সুরের শ্যামাসঙ্গীত,

‘শ্যামা এবার ছেড়ে চলেছি মা!
পাষাণের মেয়ে পাষাণী, না বুঝে মা বলেছি মা!
এতদিন কি ছল করে তুই, পাষাণ করে রেখেছিলি,
(আজ) আপন মায়ের দেখা পেয়ে, নয়ন জলে গলেছি মা’।
ইত্যাদি।

মধুর প্রসাদী সুর সহজেই শ্যামা সঙ্গীতের অনুকূল – তাতে কবির মধুর কণ্ঠে আরও মধুরতর হয়ে সঙ্গীত সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়েছিল। সে সময়ে এই দুটি গানের সুর আমার কানে এমন মিষ্টি লেগেছিল যে, তা বলবার নয়, অনুভবেরই বিষয়। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ অভিনয়ের কথা শুনলেই, এখনও কবিকণ্ঠে গীত এই দুটি গানের সুরের অনুরণন আগেই কানে বেজে ওঠে – সে এক কেমন মদিরভাবমাখা সুর!

‘রিমঝিম ঘন ঘনরে বরষে’ ইত্যাদি বর্ষণের গানের সময়ে রঙ্গমঞ্চে বৃষ্টিধারাপাত ক্ষণপ্রভা বিদ্যুতের ক্ষণপ্রভা বজ্রের কড়-কড় ঘোর শব্দ – মেঘাড়ম্বরে গড়গড় গম্ভীর গর্জনে বর্ষার মূর্তি, অনুকরণের সৌষ্ঠবে যেন স্বাভাবিক বলে বোধ হয়েছিল। ‘ঘরোয়া’য় দেখি, সাহেব-মেমরা এই দৃশ্যে স্বাভাবিকের অনুকরণ পটুতায় বড় খুশি হয়েছিলেন – হাততালির পর হাততালি পড়েছিল। এদিনও বর্ষার দৃশ্য অঙ্গহীন হয়েছিল বলে মনে হয় না, এর পরে ক্রৌঞ্চমিথুনের পালা – ব্যাধশরে ক্রৌঞ্চবধ – ক্রৌঞ্চীর করুণ বিলাপে করুনবেদী বাল্মীকির কণ্ঠ হতে ক্রৌঞ্চীশোকে অতর্কিতভাবে শ্লোকের উচ্চারণ – ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।....

এর পরে সরস্বতীর আবির্ভাব, পরের দৃশ্যে লক্ষ্মী আবির্ভূতা – লক্ষ্মীর পরীক্ষা। ইন্দিরা দেবী মূর্তিমতী ইন্দিরা হয়েছিলেন। ধনরত্নরাশি ধুলিরাশিভূত ভারতীগত চিত্ত বাল্মীকি কবি বীতস্পৃহ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ – অনাদৃতা লক্ষ্মীর তিরোভাব, তাই কবিকণ্ঠে কমলার বিদায়ের গান,

‘দেবী গো, চাহি না চাহি না, মণিময় ধুলারাশি চাহি না,
তাহা লয়ে সুখী যারা হয় হোক, - হয় হোক –
আমি দেবী, সে সুখ চাহি না!
যাও লক্ষ্মী অলকায়, যাও লক্ষ্মী অমরায়,
এ বনে এস না এস না,
এস না এ দীন জন কুটীরে!
যে বীনা শুনেছি কানে, মন প্রান আছে ভোর,
আর কিছু চাহি না চাহি না!

এইবার শেষ দৃশ্য – বিদায় সমাদর – প্রিয়তম বরপুত্রকে বর দিতে সরস্বতীর বর দিতে সরস্বতীর পটভূমিকায় আবির্ভাব! দেবী সর্বশুক্লা – শুক্লবর্ণ – শুক্ল বাস – শুক্ল হাস – শুক্ল পদ্মে সমাসীনা – শুক্ল হস্তে তুষারসারশুভ্র শুক্ল বীণা – সর্বাঙ্গ শুক্ল পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত – কেবল বীণার তারে সংলগ্ন বাঁ হাতের শুক্ল বাঁকা আঙুলগুলি অবধি কনুই পর্যন্ত সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল – যেন ভুজাকারে কোঁদা তুষারদণ্ড, ডান হাত বীণার অন্তরালে – তত সুস্পষ্ট নয়। দূরে ছিলাম – বোধ হল, যেন মৃন্ময়ী সরস্বতী প্রতিমা! অনির্বাচনীয় শোভা! সরস্বতী পদ্মাসন থেকে উঠলেন, হাতের বীণা বাল্মীকির হাতে দিলেন, বললেন,

‘আমি বীণাপাণি, তোরে এসেছি শিখাতে গান,
তোর গানে গলে যাবে সহস্র পাষাণপ্রাণ!
যে রাগিণী শুনে তোর গলেছে কঠোর মন,
সে রাগিণী তোর কণ্ঠে বাজিবে রে অনুক্ষণ।
বসি তোর পদতলে কবি বালকেরা যত,
শুনি তোর কণ্ঠস্বর শিখিবে সঙ্গীত কত।
এই যে আমার বীণা, দিনু তোরে উপহার,
যে গান গাহিতে সাধ, ধ্বনিবে ইহার তার’!

বীণাপাণির শুভক্ষণে উচ্চারিত এই বরবাণী বরপুত্র কবির জীবনে সত্যসত্যই বর্ণে বর্ণে সার্থক হয়েছিল’!

এই প্রবন্ধে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র যে সব দৃশ্য বর্ণনা করলাম তাহা আমার প্রত্যক্ষ। দেখার পরে প্রায় ৬০ বৎসর অতীত হয়েছে, সব মনে না থাকা আশ্চর্যের বিষয় নয়। যে কয়টি দৃশ্য মনে ছিল, তাহাই লিখলাম – পর পর বিষয়গুলির বর্ণনার কোন অভিপ্রায় নাই।

 


মূল বানান অপরিবর্তিত রাখা হলো

More Articles