মোদীকে অপয়া বলে ভোটে জেতা যায়?

Pappu and Panauti: সম্প্রতি শেষ হওয়া পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারে, নাম না করে, কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধি যখন এই ‘পনৌতি’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে যায়।

ভারতীয় রাজনীতিতে অপশব্দের প্রয়োগ কোনও নতুন বিষয় নয়। বহু নেতাই বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করার পরিবর্তে নানান সময়ে নানান অপশব্দ প্রয়োগ করেছেন। যাঁদের উদ্দেশ্য করে, নানান অপশব্দ ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে যেমন প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন বিরোধী দলগুলোর প্রধান মুখ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও, একুশ সালের বাংলার নির্বাচনের প্রচারের সময়ে রেয়াত করেননি বাংলার মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে। খুব খারাপ ইঙ্গিতে আক্রমণ করা হয়েছিল তাঁকেও। সেটা হয়তো অনেকেই ভুলে যাননি। কিন্তু ইদানীং একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে, যা এই অপশব্দ প্রয়োগে এক নতুন মাত্রা জুড়েছে। সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে, আগের সব কয়টি খেলায় অপরাজিত থাকার পরে, ফাইনালে যোগ্য দল অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হবার পরে, সমাজ মাধ্যম থেকে শুরু করে চায়ের আড্ডা, কিংবা বাসে ট্রামে বহু মানুষই প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে এই নতুন অপশব্দ- ‘পনৌতি’ বা অপয়া ব্যবহার করছেন। বহু মানুষের ধারণা হয়েছে, শেষ ম্যাচ অর্থাৎ ফাইনাল যদি গুজরাটে প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে না হতো, কিংবা সেদিন যদি তিনি নিজে খেলা দেখতে মাঠে না আসতেন, তাহলে হয়তো ভারত হারতো না। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি শেষ হওয়া পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারে, নাম না করে, কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধি যখন এই ‘পনৌতি’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে যায়। এখানে অবশ্য বলে নেওয়া জরুরি যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীও  প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ্য করে একটি মন্তব্য করেছেন, কিন্তু সেটি যত না অপশব্দ, তার থেকে অনেক বেশী রাজনৈতিক। তিনিও ঘুরিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সহযোগী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে এই হারের জন্য দায়ী করেছেন, কিন্তু তিনি বলেছেন, ‘পাপী’, যা অনেকাংশে সত্যিও বটে। গুজরাট গণহত্যার পাপ তো এই দু'জনের হাতে আজও লেগে রয়েছে, যা অনস্বীকার্য।

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে 'পনৌতি' বা অপয়া শব্দটি অত্যন্ত খারাপ একটি শব্দ। শুধু এই শব্দের জন্য, আমাদের দেশের এবং সমাজের কত মহিলার যে জীবন শেষ হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। একজন মহিলাকে যদি, অপয়া বা অলক্ষ্মী বলা হয়, তাঁর কী মানসিক অবস্থা হয়, তা কি আমরা জানি? অলক্ষ্মী মানেই অপয়া, মানেই ডাইনি। আমাদের দেশে বহু মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে অবধি মারা হয়েছে, সেই খবরও আমরা নানান সময়ে পেয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের বোঝার প্রয়োজন কেন এই অপশব্দটি সমাজের নানান স্তর থেকে এই মূহুর্তে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে ব্যবহিত হচ্ছে? আজকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এই মধ্যযুগীয় শব্দটি কেন আবার ঘুরে ফিরে আসছে এবং তা-ও শুধু রাজনৈতিক দল থেকে নয়, সমাজের ভিতর থেকেই উঠে আসছে? তার জন্য কে দায়ী  তা বোঝার দরকার, নাহলে বিশ্লেষণটি বিচ্ছিন্ন থেকে যাবে।

আরও পড়ুন: নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে খেলার জন্যই হার ভারতের! কেন এমন বলছেন মমতা?

আসলে গত নয় বছরে, আমাদের দেশের বর্তমান শাসকেরা এই অপবিজ্ঞান এবং অবৈজ্ঞানিক ধারণারই চর্চা করেছেন। তাঁদের উচ্চস্তরীয় নেতৃবৃন্দ কখনো বলেছেন, ময়ূরের অশ্রু থেকে প্রজনন হয়, তখন অন্য কেউ বলেছেন, গোরুর দুধে সোনা পাওয়া যায় এবং আরও নানান কিছু। কোভিডের সময়ে যখন চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা মানুষকে বাঁচানোর লড়াই করছেন, তখন তাঁদের এক সাংসদ বললেন, একটি বিশেষ সংস্থার পাঁপড় খেলে কোভিড নিরাময় হতে পারে। ঘটনাচক্রে তিনি এই মূহুর্তে ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের পূর্ণমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ঐ সময়ে, বাবা রামদেব, যিনি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজের একজন বড় কেউকেটা হয়ে উঠেছেন, তিনি একদিন বললেন, তিনি কোভিডের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলেছেন। যখন বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকেরা প্রতিবাদ করলেন এবং এই নিয়ে আদালতে গেলেন, যে এই সব বুজরুকি বন্ধ করা জরুরি। তখনও কিন্তু সরকার চুপ করেই থেকেছে এবং পরোক্ষ ভাবে এই অপবিজ্ঞানকে ঘুরিয়ে মদত দিয়েছে। যে সময়ে বিজ্ঞানের প্রসার এবং প্রচার করা জরুরি ছিল স্কুল স্তর থেকে, সেই সময়ে তাঁরা পাঠ্যসূচী থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যে সময়টা প্রযুক্তির যুগ, যে সময়টা মহিলা-পুরুষে ফারাক মুছে দেওয়ার সময়, সেই সময়টাতে আমাদের শাসকেরা বারংবার মহিলাদের পিছনে ঠেলে দেওয়া, তাঁদের পোষাক নিয়ে মন্তব্য, সব করেছে। বিলকিস বানুর ধর্ষকদের যদি গলায় মালা পরিয়ে সংস্কারী ব্রাহ্মণ বলা হয়, যদি ধর্ষণের জন্য মহিলাদের একা রাতে বেরোনো বা ছোট পোষাককে দায়ী করা হয়, তাহলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। তাঁরা পুরাণ এবং ইতিহাস গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে প্রতিনিয়ত। এইরকম অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণাই তো তাঁরা সমাজে দিতে চেয়েছেন, তাহলে আজকে 'গেল গেল' রব তুললে কী করে চলবে? রাফাল বিমান চালু করার সময়ে যদি দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ‘লেবু-লঙ্কা’ ঝুলিয়ে শুভ উদ্বোধন করেন, চন্দ্রযান আকাশে পাড়ি দেওয়ার আগে যদি ইসরোর বিজ্ঞানীদের মন্দিরে পুজো দিতে দেখা যায়, তাহলে কি বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার হয়? যেখানে বিজ্ঞানের আগে পুজোপাঠকে রাখা হয়, যেখানে ধর্মকে কুসংস্কারের আড়াল দিয়ে প্রচার করা হয়, সেই সমাজে পনৌতি বা অপয়া তো মানুষ অসচেতনভাবেই ব্যবহার করবে, এটাই স্বাভাবিক।

Rahul Gandhi calls PM Modi 'panauti' over World Cup final defeat is this a good example of political etiquette

 

রাজনীতিকে এই দীর্ঘ নয় বছরে  যেভাবে কলুষিত করা হয়েছে, যেভাবে বিরোধী দলের নেতা নেতৃদের মিম ছড়ানো হয়েছে, যেভাবে তাঁদের কখনো জার্সি গোরু, মুর্খদের সর্দার, কংগ্রেসের বিধবা, পাপ্পু কিংবা মমতাজ বেগম ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে, আজকে যদি সাধারণ মানুষের থেকেই এই অপয়া শব্দটি উঠে আসে, তখন কি তাকে কোনও আইন দিয়ে আটকানো সম্ভব? আমাদের দেশের রাজনীতির সংস্কৃতিতে কোনওদিন কি জীবিত কোনও নেতার নামে স্টেডিয়াম ছিল? হ্যাঁ, বিএসপির মায়াবতী কিংবা অন্য কেউ হয়তো নিজের মূর্তি গড়িয়েছেন জীবিত অবস্থাতেই, কিন্তু তা-ও কি ভালভাবে গ্রহণ করেছে মানুষ? সারা দেশের নানান কোণায়, আম্বেদকারের মূর্তি পাওয়া যা। তামিলনাডুতেও নানান জায়গায় পেরিয়ারের মূর্তির দেখা মিলবে, মহাত্মা গান্ধীর ছবি টাকাতেও হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটা কখনওই কোভিড সংশাপত্রে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ছবি দেওয়ার সঙ্গে কি তুলনীয় ? একজন রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতা তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে জায়গা পাওয়ার কথা, জোর করে কি সেই জায়গা পাওয়া যায়?

একসময়ে ইন্দিরা গান্ধীও নিজেকে ইন্ডিয়া মনে করেছিলেন, মানুষ তাঁকেও রেয়াৎ করেনি। 'হীরক রাজার দেশে' ছবিতে, সত্যজিৎ রায় এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের কথা বলেছেন, যিনি নিজের মূর্তি নিজে গড়ে, নিজে তা উদ্ধোধন করার কথা ভেবেছিলেন। মানুষ যে তা মেনে নেয় না, তা-ও দেখিয়েছেন সত্যজিৎ বাবু। আমাদের লোকায়ত সাহিত্যে এমন অনেক শব্দ আছে, যা ভদ্র সমাজে ব্রাত্য হলেও, সমালোচনা করার জন্য অন্তজ মানুষ ব্যবহার করেই থাকেন। মনসামঙ্গল কাব্যের উদাহরণ দেখলেই বোঝা যায়, এই ধরনের অপশব্দ খুবই সাধারণ বিষয়। দেবী মনসা, মা মনসা বা মা বিষহরি নামেই পূজিতা। এরকম একটা বিশ্বাস করা হয় যে, তিনি সর্পভয় থেকে আমাদের রক্ষা করেন। 'মনসামঙ্গল কাব্য'-এ উল্লেখ রয়েছে, চাঁদ সদাগর এর স্ত্রী সনকা দেবী মনসার পূজা করাতে সদাগর বিরক্ত হন এবং দেবী মনসাকে অবহেলা করে চ্যাংমুড়ি কানি বলেছিলেন। দেবী মনসাকে পূজা করার প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে, নিজের ঔদ্ধত্য প্রকাশে চাঁদ সদাগর বলেন, "যে হস্তে পূজিয়াছি দেব শূলপাণি, সে হস্তে না পূজিব চ্যাংমুড়ি কানি"। চাঁদ সদাগর শিবের পূজারী ছিলেন। তাই, যে হাত দিয়ে তিনি দেব শূলপাণী অর্থাৎ শিবের অর্ঘ্য দিয়েছেন, সে হাত দিয়ে, দেবী মনসার পূজা করবেন না। দেবী চণ্ডীর শলাকার আঘাতে মনসার একটি চোখ নষ্ট হয়ে, ছোট হয়ে যায়। চ্যাং মাছ বলতে একধরনের মাছ রয়েছে (একে টাকি মাছ, লাটি বা ল্যাটা মাছ ও বলা হয়)। এই মাছের চোখ, মাথার তুলনায় ছোট হয়। ‘চ্যাঙমুড়ি কানি’ শব্দটিও একটি অপশব্দ।

আরও পড়ুন:প্রশ্ন করলেই রাজরোষ! স্বাধীন মিডিয়াকে কেন ভয় পাচ্ছে মোদি সরকার?

আসলে মানুষ নিজেই নানান সময়ে এই সমস্ত শব্দ প্রয়োগ করে থাকেন, নিজেদের রাগ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা প্রকাশ করতে, তাই আজকে ‘অপয়া’ শব্দটি নিয়ে আজকের শাসকদল যতই আপত্তি তুলুক, এই শব্দটি নিজের নিয়মেই আরও প্রচার পাবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সমস্যা তখন হবে, যখন যাঁকে উদ্দেশ্য করে এই পনৌতি বা অপয়া শব্দটি বলা হয়েছিল, তা উল্টে বুমেরাং হয়ে, যে বা যাঁরা এই শব্দটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বিঁধেছিলেন, তাঁর দিকে ফিরে আসবে। ঠিক এখন যেমন ছত্তিসগঢ়, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের পরাজয়ের পরে, রাহুল গান্ধির দিকেই এই তিরটা ধেয়ে আসছে। আসলে অপশব্দ, সাধারণ মানুষ বললে সেটা সমস্যার হয় না, কিন্তু রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা সেই শব্দ যদি ব্যবহার করেন তা অসুবিধা তৈরি করতে পারে।

More Articles