মমতা-রাহুল নন, মোদিকে হারানোর যে একটিই দাওয়াই আছে দেশের হাতে...

PM Narendra Modi: বিজেপি হেরেছে বলে খুশি হয়ে রাহুল গান্ধির নাম না নিয়ে বা কংগ্রেসের নাম না উচ্চারণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুল কিছু করেননি।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদিক থেকে ঠিকই করেছেন। কর্ণাটকের নির্বাচনে কংগ্রেসের সাফল্যের পরে যে টুইটটি করেছিলেন, তাতে রাহুল গান্ধির নামোচ্চারণ করেননি। কংগ্রেসের নামও মুখে আনতে চাননি। শুধু বিজেপির পরাজয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। পরে অবশ্য কংগ্রেসকে নানা শর্ত দিয়ে জোট বার্তা দিয়েছেন।

তৃণমূল নেত্রী আজকাল আর আগের মতো আবেগের বশে খুব একটা কিছু করেন না। যা বলেন বা করেন তা বেশ ভেবে চিন্তেই করেন। কংগ্রেসের নাম না নেওয়া বা কয়েকদিনের মধ্যে আবার কংগ্রেসের সঙ্গেই শর্তাধীন জোটের বার্তা দেওয়া — এ সবের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চাল রয়েছে তো বটেই। কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে কোনও ব্যক্তির নাম না করে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি খুব একটা ভুল কিছু করেননি।

নরেন্দ্র মোদিকে হারাতে গেলে রাহুল গান্ধি-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে দিয়ে হবে না। চাই আরও বড় কিছু। কর্ণাটকের জয় দেখে ২০২৪ নিয়ে উৎসাহিত হওয়ার কারণ এখনও নেই। বরং তা থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি।

নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ হোক বা ২০১৯ — দুটো নির্বাচনই জিতেছেন ব্যক্তিত্বের জোরে। তিনিই 'সর্বশক্তিমান', তিনিই ভারতকে বিশ্ব দরবারে আবার শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করাতে পারেন, তিনিই পারেন সাধারণ মানুষের মুশকিল আসান হতে, তিনিই পারেন হিন্দু হৃদয় সম্রাট হতে। তিনিই শুরু এবং তিনিই শেষ কথা।

আরও পড়ুন- ইদ সবার উৎসব হোক, কেন চান না রাজনীতিবিদরাই?

মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও নতুন ভারতের স্বপ্ন তিনি ভারতবাসীকে দেখিয়েছেন। ভারতের লোকসভা নির্বাচনকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বি-দলীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে পর্যবসিত করেছেন। আসলে তো ৫৪৩টি আসনের জন্য ভারতবাসী ভোট দেন, তার মধ্যে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জেতে তারা সরকার গড়ে, সেই সরকারের একজন নেতা নির্বাচিত হন। তিনিই হন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ৫৪৩ আসনেই নিজেকে তুলে ধরেছেন। এদেশে মানুষ রাজনীতিতে ব্যক্তিপুজো করেই থাকে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ ইন্দিরা গান্ধি, জয়ললিতা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, লালু প্রসাদ যাদব এরকম অনেকে। কাজেই নরেন্দ্র মোদির 'পুজো' করতে তাদের অসুবিধা হয়নি।

মোদিকে যোগ্য সঙ্গত করেছে সংঘ পরিবার ও তাদের দেশজোড়া সংগঠন (বিজেপির থেকেও বড় সংগঠনের জাল সংঘ পরিবারের সংগঠনগুলির), প্রচারের জন্য টাকার জোগান, অমিত শাহের মতো নির্বাচন-কৌশলী এবং দেশবাসীকে সম্মোহিত করার জন্য রাজনৈতিক বক্তব্য।

এসবের মাঝে মোদির বিপরীতে রাহুল গান্ধি ডাহা ফেল করেছেন দুই দুই বার। ২০১৪ ও ২০১৯-এ। দু'টি নির্বাচনই মোদি বনাম রাহুলে পর্যবসিত হয়েছিল। সেখানে রাহুল দাঁড়াতেই পারেননি। অন্য বিরোধী নেতারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। রাহুল মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন।

গণ্ডগোলটি এখানেই। এই দেশে মোদির জনপ্রিয়তার ধারে কাছে এখন কোনও নেতাই নেই। বহু দূরে রাহুল গান্ধি, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরা অবস্থান করছেন।

সুতরাং কর্ণাটক জিতে উল্লাস করার কোনও কারণ নেই। সঙ্গত কারণের ভোট-পণ্ডিতরা বলছেন যে, বিধানসভার নির্বাচন ও লোকসভার নির্বাচন সম্পূর্ণ আলাদা। গতবারেও কর্ণাটকে কংগ্রেস ভালো ফল করেছিল এবং বিজেপির থেকে প্রায় দুই শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছিল (সংখ্যার বিচারে অবশ্য বিজেপি এগিয়েছিল। বিজেপি - ১০৪ ও কংগ্রেস - ৭৮)। লোকসভার নির্বাচনের ঠিক আগে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস জিতেছিল।

কিন্তু লোকসভায় গিয়ে বিজেপি কর্ণাটক থেকে ২৮টি আসনের মধ্যে ২৫টি জিতেছিল। মধ্যপ্রদেশে ২৯টির মধ্যে ২৮টি, ছত্তিশগড়ে ১১টির মধ্যে ৯টি এবং রাজস্থানে ২৫টির মধ্যে ২৪টি আসন জিতেছিল বিজেপি। উল্লেখ্য, এই সব রাজ্যেই কংগ্রেস সরকারে ছিল।

কাজেই মোদির সঙ্গে ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে নামতে গেলে বিরোধীরা হোঁচট খাবেনই। কর্ণাটকে লড়াই কোনও মুখ নিয়ে হয়নি। সেখানে গিয়েও মোদি শেষ বেলায় নিজেকে বেচে এসেছেন। তার ফল বেঙ্গালুরু শহরাঞ্চলে কিছুটা পেলেও, বিজেপির শেষ রক্ষা হয়নি।

সুতরাং বিরোধীদের পুরো লড়াই ব্যক্তি-কেন্দ্রিক থেকে ইস্যু-কেন্দ্রিক করতে হবে। মোদির সঙ্গে নয়, বিজেপি সরকার-বিরোধী ইস্যু নিয়ে লড়তে হবে। কর্ণাটকে কংগ্রেস সেই লড়াই লড়েছে।

কারণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির লড়াইয়ে মোদির থেকে বিরোধী নেতারা এমনিতেই পিছিয়ে রয়েছেন। যদিও ভারত জোড়ো যাত্রার পর এবং কর্ণাটকে কংগ্রেসের সাফল্যের পরে রাহুল গান্ধি 'পাপ্পু'-তকমা ঘুচিয়েছেন, কিন্তু তাতেও মোদির সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন।

কঠিন ইস্যু-ভিত্তিক লড়াইও। এমনিতে বিরোধী দলের নেতারা নিজের নিজের এলাকায় তাদের ক্ষমতা জাহির করতে ব্যস্ত। একে অপরের সঙ্গে বনে না , এমন রাজনৈতিক দল অনেক রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত পাঁচ বছরে এই প্রথম কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের বার্তা দিয়েছেন। ওড়িশার নবীন পট্টনায়েক নিজের জয় নিয়েই খুশি। কংগ্রেসের সঙ্গে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এক মঞ্চে যান না। একইরকম ভাবে ভারত রাষ্ট্র সমিতির কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের সঙ্গে কংগ্রেসের বনিবনা নেই। উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী আজকাল সবাইকে এড়িয়ে চলেন।

আরও পড়ুন- মমতা-বর্জিত একনায়কতন্ত্রের চেষ্টা আদৌ সফল হবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের?

আর মোদি বা তাঁর সঙ্গীরা যে কথা বারবার জিজ্ঞাসা করেন, "মোদির বিরুদ্ধে কে?" তার যথাযথ উত্তর বিরোধীদের কাছে থাকে না। ভোটের পরে দেখা যাবে বলে বিরোধীরা সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যান। সত্যিই ভোটের পরেই দেখা যাবে বিরোধীরা বিজেপিকে হারাতে পারল কিনা। পারলে কে সবচেয়ে বেশি আসন পেল। তারপরে দেখা যাবে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন।

কিন্তু তার আগে যদি বিরোধীরা একজোট হয়ে বিজেপি-বিরোধী এজেন্ডা তৈরি করেন। তাতে অর্থনৈতিক ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ইস্যুগুলিকে ভোঁতা করার চেষ্টা করেন, তাহলে কাজের কাজ কিছু হতে পারে। গোটা দেশ জুড়ে বিজেপি-বিরোধী দলগুলি এক সুরে প্রচারের তার বেঁধে নিতে পারে। যে যেখানে যতটা পারল আসন-সমঝোতা করতে পারে। যার যেখানে বেশি শক্তি সেখানে লড়াই করে বিজেপি হারাতে পারে। কিন্তু কখনই মোদির সঙ্গে ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে যাওয়া চলবে না।

কৃষক আন্দোলনের সাফল্য বা সিএএ নিয়ে আন্দোলনের পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে ইস্যু-ভিত্তিক লড়াইয়ে কতটা চাপে পড়ে সরকার।

আসলে গান্ধির অসহযোগ আন্দোলন হোক বা হালের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃষি জমি নিয়ে অনশনই হোক, প্রচলিত আন্দোলন-প্রতিবাদের ধারা থেকে সামঞ্জস্যহীন কোনও প্রতিরোধ তৈরি হলেই রাষ্ট্র বিপাকে পড়ে।

কাজেই বিজেপি হেরেছে বলে খুশি হয়ে রাহুল গান্ধির নাম না নিয়ে বা কংগ্রেসের নাম না উচ্চারণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুল কিছু করেননি। তার পিছনে মমতার যাই উদ্দেশ্য থাকুক না কেন।

প্রশ্ন এটাই যে লোকসভা নির্বাচনের আগে কি বিরোধীরা সর্বসম্মতভাবে বিজেপি-বিরোধী এজেন্ডা ও সরকারে এলে কী করবে, সেই ইস্তাহার প্রকাশের মতো কঠিন কাজটি করে উঠতে পারবেন? একে অপরের ধানে মই না দিয়ে এই কাজটি কি সম্ভব হবে? নাকি দেশ জুড়ে বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেই ইস্যু-ভিত্তিক লড়াইয়ে বিজেপি বাজিমাত করে দেবে? গোপন বোঝাপড়ায় কি বিরোধী-ঐক্য আবার হোঁচট খাবে? উত্তরগুলির জন্য আগামী এক বছর রাজনীতির ময়দানের উপর চোখ রাখতে হবে।

More Articles