রাম মন্দির: বিরোধী দলগুলিকে নগ্ন করে দিল নতুন ভারত
Opposition is Ideologically Bankrupt: সবথেকে বড় কারণ দেশের রাজনৈতিক দলগুলির আদর্শগত দেউলিয়াপনা। তারা স্রোতে ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু কিছু আঁকড়ে ধরতে পারছে না।
হৈ হৈ করে অযোধ্যায় রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। সারা দেশে উৎসবের রব। জাতীয় উৎসবের মতো ছুটি ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে। দিকে দিকে রামনাম হচ্ছে। সারা দেশে অকাল দিওয়ালির ঘোষণা হয়ে গেছে। দোরে দোরে দিয়া জ্বলে উঠবে।
পুরো ঘটনাটিই হচ্ছে নির্বিঘ্নে। কোথাও কোনও বিরোধ নেই। যদিও দেশের শঙ্করাচার্যরা অযোধ্যার নির্মীয়মাণ রাম মন্দিরে রামলালার প্রাণ-প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানকে শাস্ত্র-বিরোধী বলেছেন, যদিও দেশের অধিকাংশ বিরোধী দলের নেতা এই অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে যাচ্ছেন, তবু এ'গুলো ঠিক রাম মন্দির নির্মাণের বিরোধিতা নয়। এই অবস্থান শুধুই রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়া নিয়ে।
এর সবথেকে বড় কারণ দেশের রাজনৈতিক দলগুলির আদর্শগত দেউলিয়াপনা। তারা স্রোতে ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু কিছু আঁকড়ে ধরতে পারছে না। রাম-আবেগকে তারা না রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করতে পারছে, না জোর গলায় এর বিরোধিতা করতে পারছে।
এ'কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদকে গুঁড়িয়ে দিয়ে রাম মন্দির নির্মাণ ভারতবর্ষে একটি নতুন ইতিহাস তৈরি করছে। আমরা ইতিহাস বইতে পড়েছি বা সিনেমায় দেখেছি কীভাবে রাজা-বাদশারা ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করেছেন। কিন্তু আধুনিক, স্বাধীন গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে রাজনৈতিক দলের এবং অনেকাংশে কেন্দ্রের শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় এমন একটি ঘটনা বিরল। ভারতবর্ষে এ'টা অভূতপূর্ব ঘটনা।
এ'টা ঠিকই যে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত ভেঙে ফেলা মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির তৈরির নির্দেশ দিয়েছে। সুতরাং আইনগত ভাবে এর বিরোধিতার কোনও জায়গা আর নেই। কিন্তু এ'কথাও ঠিক যে, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলাকে 'অন্যায় কাজ হয়েছিল' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই রায়ে এ'টাও বলা হয়েছে যে, বাবরি মসজিদের তলায় কোনও রাম মন্দিরের কাঠামো রয়েছে কিনা বা এই জায়গাতেই ভগবান রামচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল কিনা, তার অকাট্য বা বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টেও তার চূড়ান্ত প্রমাণ নেই।
তবু বিশ্বাসের জায়গা থেকে সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং তাকে হাতিয়ার করে মন্দির হচ্ছে। এর প্রতীক তাৎপর্যকে উপেক্ষা করে গেলে চলবে না।
১৯৯২-উত্তর ভারতে তবুও পাড়ায়-রাস্তায় আলোচনা হত যে, অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানে হাসপাতাল বা স্কুল-কলেজ হোক। এতে বিতর্ক খতম হবে। কারণ সেই হাসপাতাল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব ধর্মের মানুষের কাজে আসবে। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনাগুলি দেখেই এমন আলোচনা হত।
আরও পড়ুন: রামমন্দির: গণতন্ত্রের কবরে ধর্মতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা
২০১৪-উত্তর ভারতে এই আলোচনা আর হয় না। হওয়ার জায়গাও নেই। গত দশ বছরে দেশের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে এবং দুর্বল বিরোধীদের সাহায্যে এক নতুন ভারত তৈরির কাজ চলছে। বিভিন্ন দিক থেকে এই কাজ এগিয়ে চলেছে। এক দিকে সংখ্যাগুরু হিন্দুত্ববাদী মনোভাব দেশের রাজনীতি ও সমাজনীতিতে জাঁকিয়ে বসেছে। ঔপনিবেশিক মানসিকতা সরিয়ে দিয়ে বা সেই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে ভারতের সনাতন সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তোলার যজ্ঞ শুরু হয়েছে। সে'খানে সংখ্যালঘুরা ব্রাত্য হয়ে গেছে ধীরে ধীরে। সমাজের সর্বস্তরে সব বিষয়ে তীব্র মেরুকরণ হয়েছে। মধ্যপন্থার কোনও রাস্তাই নেই। 'বহুত্ববাদ' শব্দটিই হয়ত খুব তাড়াতাড়ি অপ্রচলিত একটি শব্দ হয়ে থেকে যাবে অভিধানের পাতায়।
যাঁদের এই নতুন ভারতবর্ষকে দেখতে, রাম মন্দিরে প্রাণ-প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানটিকে নিয়ে অস্বস্তি হচ্ছে বা বিরক্ত লাগছে, তাঁরা আসলে পুরনো চশমা পরে বদলে যাওয়া ভারতকে দেখছেন। তাঁরা বেড়ে উঠেছেন নেহরু-মডেলে। ২০১৪-র আগে পর্যন্তও সেই নেহরু-মডেলের ছাপ ভারতের রাজনীতি ও সমাজনীতিতে ছিল। যদিও তার ক্ষয় শুরু হয়েছিল আশির দশক থেকেই।
কী এই নেহরু-মডেল? একেই তো ক্রমাগত আক্রমণ করতে থাকেন নরেন্দ্র মোদীরা! স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ভারতকে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মতো করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর আধুনিকতার ভাবনা তৈরি হয়েছিল পশ্চিমী শিক্ষা ও গণতন্ত্রের ধাঁচে। ধর্ম নয়, বহু ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্ম-জাতের দেশে সংবিধানকেই সবার উঁচুতে রাখার ভাবনাই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর রাজনীতিতে। ভারত শুধুমাত্র কোনও একটি বিশেষ ধর্মের মানুষদের দেশ হবে না — এ'কথা দেশের সংবিধানেই স্বীকৃত হয়েছে। স্বাধীন ভারতের নেতারা এই ব্যবস্থাকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
মামুদ গজনির সময় থেকে ঔরঙ্গজেবের শাসনকাল পর্যন্ত সোমনাথের শিব মন্দির বারে বারে আক্রান্ত হয়েছিল। সেই মন্দির নতুন করে তৈরি করার কথা ঘোষণা করেছিলেন নেহরু ক্যাবিনেটের মন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই পটেল। সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না করলেও নেহরু সেই কাজে সরাসরি সরকারের যুক্ত থাকার ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিলেন। এমনকি সেই মন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদকে উপস্থিত না থাকতেও অনুরোধ করেছিলেন নেহরু।
ধর্মাচরণকে ব্যক্তিগত স্তরে সীমাবদ্ধ রাখা, সরকারকে কোনও বিশেষ ধর্মের অনুষ্ঠানে সরাসরি যুক্ত করা থেকে বিরত রাখা, সব ধর্মের প্রতি সমানতাই ছিল নেহরুর আদর্শগত অবস্থান। নেহরু-মডেলে বেড়ে উঠতে থাকা অনেকেই এই আদর্শগত অবস্থানকেই ভারতের সরকারি অবস্থান বলে মেনে এসেছে। একেই আধুনিক ভারতের পথ বলে ধরে এসেছে।
তা হলে ২০১৪-র পর থেকে এই আদর্শগত অবস্থান ভেঙে চুরমার হয়ে গেল কী করে? মসজিদ ভেঙে সে'খানে মন্দির তৈরি করা নিয়ে উন্মাদনা তৈরি হল কী করে?
তার সবচেয়ে বড় কারণ এই নেহরু-মডেলের উপর দেশের রাজনৈতিক দল এবং অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস হারানো। এই বিশ্বাসে ক্ষয় শুধুই যে ২০১৪-র পর থেকে নেহরুকে নরেন্দ্র মোদীদের ক্রমাগত আক্রমণের মধ্যে দিয়েই হয়নি। এই ক্ষয় খোদ নেহরুর কংগ্রেস দলের মধ্যে থেকেই শুরু হয়েছে। তাতে যোগ্য সঙ্গত করেছে অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলিও।
আরও পড়ুন: রামমন্দির চত্বরে ঘুরছেন থর, আয়রনম্যানেরা! দেখে ঘুম উড়ল অযোধ্যাবাসীর
১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট যখন রায় দিল মুসলমান ভদ্রমহিলা শাহ বানুর প্রাক্তন স্বামীকে দেশের আইন মেনে খোরপোষ দিতে হবে, তখন গোঁড়া মুসলমানেরা রে রে করে উঠলেন। এ যে মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনের (পার্সোনাল ল) উপর আক্রমণ! তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মুরুব্বিদের শান্ত করতে সংসদে নতুন আইনই পাশ করিয়ে নিলেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে উল্টে দিল সেই আইন।
আবার এই রাজীব গান্ধীই যখন দেখলেন শাহ বানু কাণ্ডের পর দেশের সংখ্যাগুরুরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তখন ফৈজাবাদ আদালতের নির্দেশ মতো বিতর্কিত বাবরি মসজিদের চত্বরের তালা খুলে দিলেন ১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। অথচ তাঁর দাদু জওহরলাল নেহরু ১৯৪৯ সালে যখন দেখেছিলেন কেউ বাবরি মসজিদের মূল গম্বুজের নিচে রামলালার মূর্তি রেখে এসেছেন, তখন বিতর্ক এড়াতে সেই চত্বরে তালা লাগিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ, অযোধ্যার এই বিতর্কিত স্থানকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা কম হয়নি এই দেশে।
এই রাজীবই বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে রাম মন্দিরের শিলান্যাসের অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিয়েছিলেন। আর এক কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাও নাকি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, যখন বাবরি মসজিদ ভাঙা শুরু হয়েছিল, তখন পুজো করতে বসে গিয়েছিলেন। ভাঙার পর্ব শেষ হওয়ার পর তিনি পুজো থেকে ওঠেন।
এই কংগ্রেস দলই ২০২৪-এ এসে শঙ্করাচার্যদের বক্তব্যকে হাতিয়ার করে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে না বলে ঘোষণা করে। এ'টিকে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বলে এড়িয়ে যায়। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করার সাহস দেখাতে পারে না। আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তবুও একটি সংহতি মিছিলের কথা ঘোষণা করেন। কারণ হিন্দুত্ব নিয়ে, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির যোগ নিয়ে তাঁদের আদর্শগত অবস্থানটিই খুব নড়বড়ে।
আরও পড়ুন: মোদি মূর্তি ছোঁবেন, তাই শঙ্করাচার্যরাই যাবেন না রাম মন্দিরের অনুষ্ঠানে! কেন?
আসলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঢাল করে দেশের অ-বিজেপি দলগুলির মধ্যে সংখ্যালঘুদের তোষণই নেহরু-মডেলকে দুর্বল করে দিয়েছে গত চার দশক ধরে। আর বামপন্থীরা তো ভারতের অন্তর্নিহিত ধর্ম-বিশ্বাসকেই অস্বীকার করে গেছেন তাঁদের রাজনীতিতে। তাঁদের সামাজিক কল্যাণমূলক রাজনীতিকে দক্ষিণপন্থী দলগুলি মিশিয়ে দিয়েছে ধর্ম এবং পুঁজিবাদের সঙ্গে। নতুন মোড়ক আকৃষ্ট করেছে দেশের বৃহদংশকে এবং সবচেয়ে বেশি করে দেশের যুবক-যুবতীদের।
আর সামাজিক তীব্র মেরুকরণে মধ্যপন্থী কংগ্রেস তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে ধীরে ধীরে। রাহুল গান্ধী শত চেষ্টা করেও বিজেপি-বিরোধী কোনও রাজনৈতিক আলেখ্যকে দাঁড় করাতে পারছেন না তাঁর নিজের দলের মধ্যেই।
তবে কি দেশের কোথাও কোনও ক্ষোভ নেই বিজেপিকে নিয়ে? নিশ্চয়ই রয়েছে। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ তো বিজেপিকে ভোট দেননি। কিন্তু তাঁরা নীরব হয়ে রয়েছেন। যেমন দেশের সংখ্যালঘুরাও নীরব হয়ে গিয়েছেন। এঁদের হয়ে নির্বাচনী রাজনীতি ও দেশের রাজনৈতিক পরিসরে কথা বলার লোক নেই। কারণ বিজেপি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ব্যাঙ্কের ভয়ে, আদর্শহীনতায় বিরোধী দলগুলি 'এক ভারত, এক ধর্মে'র দিকেই হাঁটছে।
সুতরাং, নতুন ভারতকে দেখতে গেলে এবং আরও একটি নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখাতে গেলে নতুন চশমা পরতেই হবে!