আসল নাম রামকিষাণ যাদব! কীভাবে কোটি কোটি টাকার পতঞ্জলির ব্যবসা গড়লেন রামদেব?

Patanjali Ayurved Ramdev : পতঞ্জলিতে যারা কাজ করেন রামদেব এবং বালকৃষ্ণকে তাঁদের গুরু মানতে হয়। প্রতিবার এখানে প্রবেশের আগে চরণ স্পর্শ করতে হয় রামদেব ও বালকৃষ্ণের।

রামদেব বাবা। আসল নাম, রামকিষাণ যাদব। হরিয়ানার দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে চলে যান গুরুকুলে। সেখানেই বালকৃষ্ণের সঙ্গে আলাপ। ধীরে ধীরে যোগব্যায়াম শেখা, সন্ন্যাস গ্রহণ করা এবং রামদেব হয়ে ওঠা। হরিদ্বারে পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ কোম্পানি শুরু হয় ২০০৬ সালে রামদেব এবং বালকৃষ্ণের হাত ধরেই। এই পতঞ্জলির বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। রামদেব বিজেপি ঘনিষ্ঠ, রামদেব কেন্দ্র সরকারের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে হামেশাই ঘোরাফেরা, ওঠাবসা করেন। ভুয়ো বিজ্ঞাপন ছাড়াও একাধিক ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে পতঞ্জলির বিরুদ্ধে। আশ্চর্যজনকভাবে, অধিকাংশই ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। কী কী অভিযোগ? তার আগে পতঞ্জলির উত্থানের শুরুটা দেখে নেওয়া যাক।

পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ হরিদ্বারে অবস্থিত একটি ভারতীয় বহুজাতিক সংস্থা। ২০০৬ সালে রামদেব এবং বালকৃষ্ণ পতঞ্জলি আয়ুর্বেদের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রসাধনী থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদিক ওষুধ, খাদ্য পণ্য থেকে শুরু করে কাপড় কাচার, বাসন মাজার সাবান, কী নেই পতঞ্জলির! এই সংস্থার ৯৪ শতাংশ শেয়ার হোল্ড সহ কোম্পানির সিইও হচ্ছেন বালকৃষ্ণ। ২০২১ সালের তথ্য বলছে, বালকৃষ্ণের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! তবে সংস্থার মুখ কিন্তু রামদেব। পতঞ্জলিকে কীভাবে চালানো হবে সেইসব কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেন যোগগুরু রামদেব।

আরও পড়ুন- এই চটছেন, পরক্ষণেই যোগমুদ্রায়! রামদেব মানেই বিতর্ক

২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করলেও, ২০১৪ সালে দেশে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে পতঞ্জলির ব্যবসা ও খ্যাতি আকাশ ছোঁয়। ২০১৬ সালে পতঞ্জলিই হয়ে ওঠে ভারতের সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলির মধ্যে একটি। ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে পতঞ্জলির ব্যবসা হয়েছিল ১০,২১৬ কোটি টাকার। সেই সময় হিন্দুস্তান ইউনিলিভার, কোলগেট, ডাবর, আইটিসি এবং গোদরেজ সহ অন্তত ১৩ টি কোম্পানি পতঞ্জলির সাফল্যে প্রভাবিত হয়। মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে মাসকাবারির ফর্দ তালিকায় পতঞ্জলি হয়ে ওঠে অবধারিত নাম। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালের নভেম্বরে দিল্লিতে পতঞ্জলি পরিধান নামে একটি পোশাকের দোকানও খুলেছিল।

হরিদ্বারের পতঞ্জলি ফুড অ্যান্ড হারবাল পার্ক হচ্ছে এই কোম্পানির প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র। নয়ডা, নাগপুর, এবং ইন্দোরেও এর উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে। পতঞ্জলি ফুড অ্যান্ড হারবাল পার্কে ৩৫ জন পূর্ণ সময়ের, সশস্ত্র সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স (সিআইএসএফ) কমান্ডো পাহারায় রয়েছেন। ভারতে মাত্র ৮ টি কোম্পানিতেই সিআইএসএফ প্রহরায় রয়েছে।

রামদেবের বিরুদ্ধে একাধিক অপরাধের জন্য বিরোধী উত্তরাখণ্ড সরকার আগে ১০০টি মামলা দায়ের করেছে। কোম্পানির বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন ছড়ানোর যে সাম্প্রতিক অভিযোগ উঠেছে তা ছাড়াও অভিযোগ ছিল, পতঞ্জলি পণ্য বাজারজাত করার আগে মোটেই খতিয়ে দেখে না। নিজের পণ্য নিয়ে ভুয়ো প্রচার তো বটেই, অন্য প্রতিযোগী সংস্থাকে অপমান করারও অভিযোগ আছে পতঞ্জলির বিরুদ্ধে। দিল্লি হাইকোর্ট চ্যবনপ্রাশ ব্র্যান্ডের একটি বিজ্ঞাপনের প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল পতঞ্জলিকে কারণ তাতে প্রতিযোগী সংস্থাকে অপমান করা হয়েছিল। নিম্ন গুণমানের জন্য পতঞ্জলির আমলা জুস এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

পতঞ্জলিতে যারা কাজ করেন রামদেব এবং বালকৃষ্ণকে তাঁদের গুরু মানতে হয়। প্রতিবার এখানে প্রবেশের আগে চরণ স্পর্শ করতে হয় রামদেব ও বালকৃষ্ণের। শ্রমিকদের মাইনে প্রতি মাসে ৬,০০০ টাকা। দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ, সপ্তাহে ছয় দিন। তবে কারখানায় শ্রমিক হিসেবে মেহনত নয়, এই কাজ করাকে বলতে হয় 'সেবা'। সুতরাং এখানে মাইনে বাড়াতে বলার কোনও দাবিই ধোপে টেকে না।

রামদেবের দিব্য ফার্মেসি উত্পাদিত পণ্যগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে দিব্য পুত্রজীবক বীজ। এটি নাকি প্রাকৃতিক ভেষজ যা বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করতে পারে। পতঞ্জলি ফার্মেসির বেশ কিছু দোকানে 'এই ওষুধ খেলে ছেলে সন্তান জন্মাবে' বলে প্রচার করেও এই বীজ বিক্রি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ২০১৬ সালে, উত্তরাখণ্ডের স্বাস্থ্য বিভাগ বলে, এই ওষুধটি প্রি-কনসেপশন এবং প্রি-ন্যাটাল ডায়াগনস্টিক টেকনিকস অ্যাক্ট, ১৯৯৪ লঙ্ঘন করেছে।

২০১৮ সালে হরিদ্বারের বেশ কিছু গ্রাম থেকে অভিযোগ আসতে থাকে পতঞ্জলি নিজের কারখানার বর্জ্য পদার্থ গঙ্গায় ফেলে দিচ্ছে। তবে রামদেবের প্রভাবের কারণে স্থানীয় সরকার কারখানার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

আরও পড়ুন- ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দেন রামদেব! বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করল সুপ্রিম কোর্ট

২০১৫ সালের ১৫ পতঞ্জলি ইন্সট্যান্ট নুডলস বাজারে আনে। ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া জানায়, পতঞ্জলি বা আয়ুষের কাছে ইন্সট্যান্ট নুডলস তৈরির কোনও লাইসেন্সই নেই।

পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ ২০২০ সালের জুন মাসে, অর্থাৎ কোভিড যখন তুঙ্গে তখন করোনিল নামে একটি ওষুষের ঘোষণা করে। রামদেব দাবি করেছিলেন, করোনিল করোনা নিরাময় করছে। এই ওষুধ কার্যকরি কিনা, নিরাপদ কিনা তা প্রমাণ করার জন্য কোনও ক্লিনিকাল তথ্যই ছিল না। গবেষণাগারে পরীক্ষায় দেখা গেছে যে ওষুধটিতে এমন কোনও উপাদানই নেই যা করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা বা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারে। তবে করোনিল নিষিদ্ধ হয়নি। ভারত সরকার পতঞ্জলি আয়ুর্বেদকে করোনিলকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী (নিরাময় নয়) পণ্য হিসেবে বাজারজাত করার অনুমতি দেয়।

পতঞ্জলির বিরুদ্ধে দলিতদের জমি জোর করে অধিগ্রহণেরও অভিযোগ রয়েছে। ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, উত্তরখণ্ডের তেলিওয়ালা গ্রামে আইন ফাঁকি দিয়ে দলিতদের জমি ছিনিয়ে নিয়ে, মানুষকে ভূমিহীন করে পতঞ্জলি গোয়াল ও ভেষজ খামার গড়ে।

লোকসভা ভোটের আগেই পতঞ্জলি আয়ুর্বেদের বিজ্ঞাপন ভুয়ো বলে জানিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত! রামদেব ও আচার্য বালকৃষ্ণের বিরুদ্ধে আইন অবমাননার নোটিশ জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। আদালত কেন্দ্র সরকারের কাছেও নোটিশ পাঠিয়ে জানতে চেয়েছে এই দু'জনের বিরুদ্ধে ঠিক কী ব্যবস্থা করার কথা ভাবা হচ্ছে? তবে সকলেই জানেন, রামদেবের সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠতা অসীম। রামদেবের ফেসভ্যালু ব্যবহার করে বিজেপি। ফলে ভুয়ো বিজ্ঞাপন বিষয়টিও আগের বহু অভিযোগের মতোই চাপা পড়ে যাবে কিনা সেটিই প্রশ্ন, এমন প্রশ্ন যার উত্তর সকলের জানা।

More Articles