"স্বাধীনতা! স্বাধীনতা!" পরাধীন রামনাথের চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল স্বাধীন আফগানভূমিতে
প্রসেনজিৎ চৌধুরী: স্বাধীনতা! স্বাধীনতা! সাইকেল থামিয়ে চিৎকার করলেন পরাধীন ভারতের নাগরিক ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস। স্বাধীন আফগানিস্তানের হাওয়া তাঁকে ঘিরে নিচ্ছিল। একটু দূরে পিছনে ফেলে এসেছেন নিজের দেশ ভারতের সীমান্ত চেকপোস্ট। তিনি যাচ্ছিলেন কাবুল-কান্দাহার-গজনী ছুঁয়ে মধ্য এশিয়ার দিকে। পথে পড়ছে এই স্বাধীন দেশ। এখানে না খেতে পাওয়া লোকেরা যেন স্বাধীনচেতা ভারতীয় রামনাথের চোখে বিস্ময়মূর্তি।
কালচক্রের হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছে ভারত যখন পরাধীনতার নাগপাশে ধুঁকছিল, কিছু সশস্ত্র বিদ্রোহ অসফল হয়েছিল, রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করছিল করছিল, ঘরে ঘরে কেরাণীর দল ব্রিটিশ শাসনে মশগুল ছিলেন- তখন দো নলা ও এক নলা বন্দুকের অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের শক্তি, অদম্য সহ্যশক্তি নিয়ে লড়াই চালাচ্ছিলেন আফগানিরা। তাদেরও প্রতিপক্ষ ব্রিটিশ। বারবার লড়াই, বারবার পিছু হঠা। কিছুক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া। দুরন্ত কঠিন এই আফগানি জীবন। একদিন ব্রিটিশরা মানল আফগানিস্তানকে কব্জা করা যাবে না। সন্ধি চুক্তিতে সেই দুর্গম ভূমিতে আফগান কর্তৃত্ব মেনে নিল ব্রিটিশরা। "তৃতীয় আফগান-ইঙ্গ যুদ্ধ" অন্তে আফগানিস্তান সেই থেকে স্বাধীন দেশ। এ ঘটনা ১৯১৯ সালের।
![](https://media.inscript.me/wp-content/uploads/2021/08/IMG_20210805_204057-220x300-1.jpg)
'এক গোলি এক দুশমন' যেখানকার নীতি সেখানে লড়াই তো কঠিনই হবে। তবে ব্রিটিশ জাত সহজে আফগানিদের ছেড়ে দিতে নারাজ। শুরু হলো কূটনৈতিক অবরোধ। কাবুলের তখ্ত ঘিরে সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। ভাইয়ে ভাইয়ে রেষারেষি সিংহাসন দখল, গলা কেটে নেওয়া আর ব্রিটিশদের গোপন কলকাঠি নাড়া, সবমিলে আফগানিস্তান জুড়ে উনিশ শতক থেকে বারবার পালাবদল হতে থাকে। যার পরিণতিতে তিনটে যুদ্ধ। সর্বশেষ স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে ১৯১৯ সালে ভারত-আফগান সীমান্তে বসল চেকপোস্ট। এপারে ব্রিটিশ শাসিত ভারত ওপারে আফগানিস্তান। (১৯৪৭ সালের পর এটি হয়েছে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত )
রামনাথের দেখা সেই আফগানিস্তানের স্বাধীনতার শতবর্ষ পালিত হয়েছে ২০১৯ সালে। এই গত একশ বছরে আফগানিস্তান দখল নিতে যেমন ব্রিটিশরা পারেনি, তেমনই টিকে থাকতে পারেনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, তার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাল ছাড়ল। এই একশ বছরের মধ্যে বিশ্বে একমাত্র তালিবান জঙ্গি সরকার হয়েছিল আফগানিস্তানেই। নব্বই দশকের সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গি শাসনের পর ফের একবার কাবুল ঘিরে তালিবানি অট্টহাসি চলছে।
ফিরে যাওয়া যাক রামনাথ বিশ্বাসের সাইকেলে আফগানিস্তান ঘোরার দিনগুলিতে। তিনি এই দেশ ঘুরছেন। প্রতিমুহূর্তে ভারতের সঙ্গে তুল্যমূল্য আলোচনার প্রসঙ্গ লিখছেন রোজনামচায়। সেই লেখায় ধরা থাকছে আফগান জীবনের ছন্দ।
![](https://media.inscript.me/wp-content/uploads/2021/08/IMG_20210805_203654-255x300-1.jpg)
এই স্বাধীনতার আকাঙ্খা আসলে তাঁর গোপন বৈপ্লবিক গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সংযোগ ও বামপন্থী রাজনৈতিক চিন্তার ফল। তাঁর সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণের বিভিন্ন পর্বে বারবার এমন স্বাধীনচেতা সমাজতান্ত্রিক ভাবনা এসেছে। তিনি নিজেও সেটি স্বীকার করেছেন।
তবে রামনাথ বিশ্বাসের আগে তিরিশের দশকে আফগানিস্তানের অন্দরের কথা সরস কলমে লিখে বাংলাভাষী পাঠককুলের কাছে চিরন্তন 'দেশে বিদেশে' বইটি উপহার দিয়েছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁর উপলব্ধি, তুষার ঢাকা মাঠের উপর থেকে বিমানের জানালা দিয়ে শেষবারের মতো দেখা তাঁর আফগানি সখা আব্দুর রহমানের ময়লা পাগড়ি যেন বরফের চেয়েও শুভ্রতর।
মুজতবা আলী ও রামনাথ বিশ্বাস দু'জনেই পরাধীন দেশের নাগরিক হয়ে স্বাধীন দেশ আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন। মুজতবা আলী তাঁর সাহিত্যের কারণে বিশেষ সমাদৃত। রামনাথ বিশ্বাস পরিচিত তাঁর ঘোরাঘুরির কারণে। একাধিক বই লিখেছেন। সবগুলো বই পাঠকদের চিন্তার খোরাক হয়েছে। তাঁর লেখা 'আফগানিস্থান' বই প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। এই বইটি তাঁর বিশ্বভ্রমণ পর্বের সর্বশেষ অবদান।
!["স্বাধীনতা! স্বাধীনতা!" পরাধীন রামনাথের চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল স্বাধীন আফগানভূমিতে](https://media.inscript.me/wp-content/uploads/2021/08/IMG_20210805_204838-300x212-1.jpg)
ছবি সৌজন্যে: Google
রামনাথ বিশ্বাস প্রথমবার সাইকেলে বিশ্বযাত্রা করেন ১৯৩১ সালে। সিঙ্গাপুর থেকে সাইকেলে চড়ে তিনি মালয় (মালয়েশিয়া), শ্যামদেশ (থাইল্যান্ড), ইন্দোচীন ( ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া), চিন, কোরিয়া, জাপান থেকে কানাডায় পৌঁছান।
১৯৩৪ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিশ্বযাত্রা করেন।পারস্য (ইরান), ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া (এখন অস্তিত্বহীন) হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া (চেক প্রজাতন্ত্র), জার্মানি, হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস), বেলজিয়াম, ফ্রান্স হয়ে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড সাইকেলে ভ্রমণ করেন।
রামনাথ তৃতীয়বার বিশ্ব ঘুরে আসেন ১৯৩৮ সালে। সেবার তিনি আফ্রিকা মহাদেশে পাড়ি দেন। কেনিয়া, উগান্ডা, নিয়াসাল্যান্ড, রোডেসিয়া (এখন জিম্বাবোয়ে) হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছান। এখান থেকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৪০ সালে দেশে ফিরে আসেন।
অত:পর ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা পেল। পাকিস্তান তৈরি হলো। রামনাথ বিশ্বাস প্রথম কয়েক বছর পূর্ব পাকিস্তানের দিকে পড়া পৈত্রিক ভিটেতেই ছিলেন। পরে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এরপর তাঁর ভ্রমণ কাহিনি প্রকাশ হতে থাকে কলকাতা থেকে।
রামনাথ লিখেছেন,- "আফগানিস্থান স্বাধীন দেশ। সে দেশ সম্বন্ধে প্রতিকূল কিছু লিখলে তার প্রতিবাদ করার লোক আছে। সে জন্যই হয়তো আফগানিস্থানের বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখতে সাহস করে না। কিন্তু ভারতেরই অন্ন খেয়ে ভারতবাসীরই আর্থিক সাহায্য পেয়ে অনেক বিদেশী পর্যটক অবশেষে বই লেখেন, তখন ভারতের বিরুদ্ধে নানা অসত্য এবং কাল্পনিক তথ্য প্রচার করতে কুন্ঠিত হন না।"
১৯৫৫ সালে প্রয়াত হন বাংলাভাষায় 'লাল চীন' শব্দটি নিয়ে আসার কারিগর রামনাথ বিশ্বাস।