পারমাণবিক শক্তি মানেই পারমাণবিক বোমা নয়: আজীবন বলতেন বিজ্ঞানী বিকাশ সিনহা

Physicist Bikash Sinha: পারমাণবিক নীতি নির্ধারণের বিষয়ে যখন সরকারের শরিক দল বামফ্রন্ট সমর্থন তুলে নিয়েছিল, তিনিই কিন্তু সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অটুটভাবে।

পর পর দু'বার আলাপ সামনে থেকে। প্রথমটা ছিল বছর দুয়েক আগে হেদুয়া পার্কে এক বিজ্ঞানমেলা প্রদর্শনীতে, আর দ্বিতীয়বার এই বছরের জানুয়ারিতে। ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারের উদ্যোগে আয়োজিত এক নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার কনফারেন্সে দেখা। সাদা চুল ভর্তি মাথা, এক পা এক পা করে ডায়াসে ওঠা দেখে কে বলবে তিনিই বক্তব্য রাখবেন প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা! ছোট ছোট বাক্যে বলতে শুরু করলেন মহাবিশ্বের জন্ম বৃত্তান্ত। না, শুধু তাত্ত্বিক বিজ্ঞানই নয়, মাঝে মধ্যেই বলে চলেছেন ইঙ্গা, ফ্রেনা বিভিন্ন ডিটেক্টরের কার্যকলাপ। কীভাবে ধরা যায় মহাবিশ্বের শুরুর অবস্থা এই পৃথিবীতে বসে, তারই হদিশ দিয়ে গেলেন ঘণ্টাখানেক ধরে। বয়সের ভারে শরীর নুয়ে পড়লেও নতুন কিছু করে দেখানোর আবেগ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কণ্ঠস্বরে। সামনে বসে আছেন বয়োজ্যেষ্ঠ, বয়ঃকনিষ্ঠ, বিভিন্ন বয়সি, দেশ বিদেশে কর্মরত প্রথিতযশা এক ঝাঁক পদার্থবিদ, তাঁদের কেউ কেউ আবার তাঁরই ছাত্র। যে প্রতিষ্ঠানের ডায়াসে দাঁড়িয়ে তিনি বক্তব্য রাখছেন, সেখানে পরমাণু ভাঙবার যন্ত্রটি (সাইক্লোট্রন) বসানোর মূল উদ্যোক্তাও তিনিই। হ্যাঁ, তিনিই বিকাশ সিনহা। সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারের এক সময়ের যৌথ অধিকর্তা। সামনে থেকে ভারতের নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা ও কণাপদার্থবিদ্যা চর্চার জগৎকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন প্রায় তিন দশক ধরে।

সদ্য ১১ অগাস্ট না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। মুর্শিদাবাদের কান্দি রাজ পরিবারের সন্তান বিকাশ সিনহা। প্রেসিডেন্সির পাঠ শেষে পাড়ি দেন কেমব্রিজে। মন্ত্রীর বাড়ির ছেলে, রাজ পরিবারের সন্তান, এসব পরিচয় দূরে ঠেলে মেতে ওঠেন মহাবিশ্বের সৃষ্টি, বিকাশ ও বিবর্তনের রহস্য সন্ধানে। কেমব্রিজে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। যেমন ফিরেছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু, জন্মভূমিতে বিজ্ঞান চর্চা করবেন বলে। দেশে ফিরে দেখাহয় আর এক কাজপাগল পদার্থবিদ রামান্নার সঙ্গে। তাঁর কথায় আকৃষ্ট হয়ে ১৯৭৬ সালে যোগ দেন ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে। সেই শুরু, তারপর একের পর এক পালক জুড়তে থাকে ভারতীয় উচ্চ শক্তির পদার্থবিদ্যার চর্চার মুকুটে। মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে কলকাতায় বসেছিল এশিয়ার প্রথম সাইক্লোট্রন। সাহার যোগ্য উত্তরসূরি বিকাশ সিনহার হাত ধরে কলকাতার ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারে অতি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সাইক্লোট্রন স্থাপিত হয়।

প্রথম থেকেই অঙ্ক ও বিজ্ঞান, বিশেষত তাত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিল তাঁর। সেই টানেই ধীরে ধীরে যুক্ত হয়ে পড়েন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শুরুর সময়ের গবেষণায়। তাঁর কাজের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে 'কোয়ার্ক–গ্লুয়ন প্লাজমা' বা 'কিউ. জি. পি'। বিগ ব্যাং অর্থাৎ মহাবিশ্বের শুরুর কিছুক্ষণের ভেতরে এই পদার্থর দেখা মিলেছিল বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান। কী সেই বস্তু? একটু স্থূল ভাবে বললে এটি কোয়ান্টাম ক্রোমো-ডাইনামিক্সের (আধুনিক পদার্থবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা) একটি বিশেষ দশা, যেটি কিনা অতি উচ্চ ঘনত্বে ও তাপমাত্রায় দেখতে পাওয়া যায়।

পরমাণুকে উত্তপ্ত করলে তার ভেতরে থাকা ইলেকট্রন, প্রোটন কাঁপতে শুরু করে। এ অবস্থায় আরও শক্তি দিলে ইলেকট্রন বন্ধন ছিন্ন করে মুক্ত হয়ে যায়। আরও তাপ দিলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসও ভাঙতে শুরু করে, ফলত প্রোটন, নিউট্রনগুলি স্বাধীনভাবে ঘুরতে থাকে। ক্রমশ উষ্ণতা আরও বাড়ালে নিউক্লিয়নগুলি গলতে শুরু করে, যা কোয়ার্কের (কণা জগতের মৌলিক উপাদান এই কোয়ার্ক) জন্ম দেয়। এই সময় স্বাধীন নিউক্লিয়ন ও কোয়ার্কের ভেতরে গ্লুওন বিনিময় হয়। এই অবস্থারই নাম 'কোয়ার্ক গ্লুওন প্লাজমা' বা 'কিউ. জি. পি'। সাধারণত বিগ-ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী মনে করা হয়, সৃষ্টির আদিকালে গোটা ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এই কোয়ার্ক-গ্লুয়ন প্লাজমার আবরণ ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১০ সালে সার্নে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে ALICE পরীক্ষার মাধ্যমে পদার্থের এই কিউ. জি. পি দশার প্রমাণ মেলে। প্রখর মেধার অধিকারী বিকাশ বুঝেছিলেন এই কিউ. জি. পি নিয়ে ঠিকমতো নাড়াঘাঁটা করতে পারলে মহাবিশ্বের আদি অবস্থার সম্পর্কে ধারণা আরও স্বচ্ছ হবে। কিউ. জি. পি ছাড়াও তিনি কাজ করেছেন নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। পারমাণবিক শক্তিকে কী করে জনজীবনে কাজে লাগানো যায়, সে চিন্তা সবসময়ই ঘুরপাক খেয়েছে তাঁর মাথায়। প্রায়ই বিভিন্ন সেমিনারে বলতেন, "পারমাণবিক শক্তি মানেই পারমাণবিক বোমা নয়।" তাই মনমোহন সিংহ সরকারের সময়, পারমাণবিক নীতি নির্ধারণের বিষয়ে যখন সরকারের শরিক দল বামফ্রন্ট সমর্থন তুলে নিয়েছিল, তিনিই কিন্তু সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অটুটভাবে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন নতুন নতুন বিষয়, তা নিউক্লিয়ার মেডিসিনই হোক বা কোনও রেডিও আইসোটোপের ব্যাবহার, সবকিছু নিয়েই তিনি ছিলেন সমান আগ্রহী।

শুধু বিজ্ঞান চর্চাই তো করেননি। এত বড় তাত্ত্বীয় পদার্থবিদ হওয়ার পরও পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে উৎসাহ দিয়ে গেছেন জীবনভর, ক্ষেত্র বিশেষে দিয়েছেন নেতৃত্বও। বিজ্ঞানকে জনমানসে ছড়িয়ে দিতে তাঁর ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিরলস ভাবে মাতৃভাষায় লিখে গেছেন অনেক ছোট বড় প্রবন্ধও। যার ফসল, 'স্থান কাল ও বিশ্বলোক' এবং 'সৃষ্টি ও কৃষ্টি বন্ধনহীন গ্রন্থ' দু'টি। বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পাশাপাশি তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন উপাচার্যের, কেন্দ্র সরকারের বিজ্ঞান উপদেষ্টার, আরও অনেক কিছু। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে পেয়েছেন বহু পুরস্কার: পদ্মভূষণ, রবীন্দ্র পুরস্কার আরও কত সম্মানই তাঁর জীবন আলো করেছে! সবচেয়ে বড় পুরস্কার এই যে, উপমহাদেশের পদার্থবিদ্যার ছাত্র ছাত্রীরা কসমোলজি অর্থাৎ বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে কাজ করার সময় একঝাঁক নোবেলজয়ী পদার্থবিদদের কাজের মাঝে দেখতে পাবেন জ্বলজ্বল করছে সিনহা এট অল!

 

More Articles