বাড়ছে সমুদ্রের জলতল, কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতের অর্থনীতি?

ক্রমেই বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর, দায়ী কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়ন আর তার থেকে ঘটে হিমবাহের গলন। সমুদ্রপৃষ্ঠের জলস্তর বাড়লে কি কেবলই ক্ষতি হবে মানুষ ও জীববৈচিত্রের? বা এর প্রভাব কি কেবলই গিয়ে পড়বে উপকূলবর্তী অঞ্চলে? নাহ, এখানেই থামবে না প্রকৃতির পরুষ রূপ। এর প্রভাব পড়বে সারা পৃথিবীর অর্থনীতির উপর। বলার অপেক্ষা রাখে না, অর্থনীতির উপরেই কিন্তু দাঁড়িয়ে আছি আমি, আপনি, আমাদের এই পৃথিবী।

ইতিমধ্যেই ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভয়ানক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয় প্রত্যেক বর্ষায়। ভারত এবং এশিয়ার অত্যন্ত জনবহুল, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলিকে প্রায়শই ভয়াবহ বন্যার শিকার  হতে হয় প্রতি বছর। সুন্দরবন তার অন্যতম উদাহরণ। কত আশ্রয় জলের তলায় চলে যায়, চাষাবাদ, জীবিকা নির্বাহ, স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা সঙ্কটের মুখে পড়ে প্রতি বছর। মুম্বাই, চেন্নাইয়ের মত শহরও বাদ যাচ্ছে না বন্যার কবল থেকে।

ভারতে জিডিপি কমবে দুই থেকে চার শতাংশ বাৎসরিক হারে এই ভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকলে। বার্লিনের গ্লোবাল ক্লাইমেট ফোরামের গবেষক ড্যানিয়েল লিঙ্কের মতে নিত্যনৈমিত্তিক সাইক্লোন ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে তুলবে। তার সাথে বাড়বে বন্যার ঘটনা।

তাপমাত্রা এইভাবে উত্তরোত্তর বাড়লে, হিমবাহের গলন বাড়বে; ভাবলেই শিউরে উঠতে হয় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের উপকূলবর্তী এলাকার কী পরিণতি হবে। যে অঞ্চলগুলি পাকাপাকি ভাবে জলের তলায় চলে যাবে আগামী কয়েক বছরেই, সেই জায়গার বর্তমান এবং ভবিষ্যত বাসিন্দাদের আশ্রয়ের কী হবে? জমির উপর চাপ কতটা পড়বে তখন!

জার্নাল অফ সায়েন্টিফিক রিপোর্টে ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, আমরা এখনই সাবধান না হলে সারা বিশ্বের মোট দেশীয় পণ্যের কুড়ি শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই গবেষণার সাথে যুক্ত গবেষকদের মতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে যে উপকূলবর্তী অঞ্চলে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে, তাতে বিশ্বের অর্থনীতির ১৪.২ ট্রিলিয়ান ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেখানে ভারতীয় মুদ্রার হিসেবে এক ট্রিলিয়ান মার্কিন ডলার মানে এক লাখ কোটি টাকা। আগামী আশি বছরে কেবল উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঘটা বন্যার কারণেই ১৮৭ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে  এতদিন অপেক্ষা করতে হবে না, আগামী তিরিশ বছরেই উপকূলবর্তী এলাকাগুলি বন্যার আঘাতে ধসে গিয়ে জলের তলায় মিলিয়ে যাবে।

উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হবে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব উপকূল, ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম উপকূলবর্তী অঞ্চল।, কিন্তু তার থেকেও বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল। আর সেই তালিকায় সবার উপরে থাকছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন।

ইউনাইটেড নেশানস ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আই.পি.সি.সির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই শতকের মাঝামাঝি সময়তেই ভারতের ৩৫ মিলিয়ন (এক মিলিয়ন মানে দশ লাখ) অধিবাসী সমুদ্র উপকূলবর্তী বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আর এই দশকের শেষেই সেই সংখ্যাটা ৪৫ থেকে ৫০ মিলিয়নে পৌঁছবে।

তবে সমুদ্রের জলস্তর বাড়লে তো তার প্রভাব কেবল সমুদ্র উপকূলের সীমাবদ্ধ থাকে না, সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত নদীও উপচে ওঠে এর প্রভাবে। ভারতের মূল দুইটি নদ-নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অঞ্চলও ভাসবে সমুদ্রের জলতল বাড়লে। যেহেতু গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার মধ্যে দক্ষিণবঙ্গের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের অপেক্ষাকৃত কাছে, অশনি সঙ্কেত দেখতে পাচ্ছে দুই চব্বিশ পরগণা, দুই মেদিনীপুর, কলকাতা , হাওড়া এবং হুগলী।

শুধুই কি স্থানাভাব বা খাদ্যাভাব ঘটবে সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়লে? তা কিন্তু না। এর সরাসরি প্রভাব হিসেবে দেখা যাবে পানীয় জলের সঙ্কট। ২০৫০ সালের মধ্যেই চল্লিশ শতাংশ ভারতীয় তীব্র জলকষ্টের সাথে দিনযাপন করবেন।

সমুদ্রপৃষ্ঠের ক্রমবর্ধমান উচ্চতা, এদিকে ক্রমহ্রাসমান ভূ-গর্ভস্থ জল, একসাথে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ভারতের চাষাবাদ। আই.পি.সি.সি-এর রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে এই ঠিক পূর্বে উল্লেখিত বিষয়গুলির সম্মিলিত প্রভাবে গম, ডালজাতীয় শষ্য, ভুট্টা এবং অন্যান্য শষ্যের ফলন প্রতি বছর নয় শতাংশ হ্রাস পাবে। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে ভুট্টার ফলন কমবে সতেরো শতাংশ।

এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উপকূলবর্তী অঞ্চলের মৎসশিল্প। সমুদ্র এবং নদ-নদীর জলতল বাড়লে মাছের বাৎসরিক গতিপথ বদলাতে পারে, ফলে সারা ভারতেই তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।

ভারতের অধিকাংশ উপকূলবর্তী অঞ্চল মৎসশিল্পের পাশাপাশি পর্যটনশিল্প নির্ভর। জলবায়ু পরিবর্তন আঁচড় বসাবে সেই শিল্পেও।

 ভারত কৃষিপ্রধান দেশ, চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্থ হলে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে, সাথে পাল্লা দিয়ে কমবে জিডিপি। বলার অপেক্ষা রাখে না, খাদ্যসঙ্কটও বাড়বে হু হু করে, যার আঁচ সবার আগে লাগবে দেশের প্রান্তিক মানুষের গায়ে। কারণ জিডিপি কমলে কিন্তু সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্ররাই। তবে বাদ যাবে না নিম্ন থেকে উচ্চ মধ্যবিত্তরাও।

জিডিপি কমলে ক্রমেই জাতীয় আয় হ্রাস পেতে শুরু করবে, জীবনধারণের মাপকাঠি তলানিতে ঠেকবে - তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে বেকারত্ব। শুধু এখানেই শেষ নয়, জাতীয় আয় হ্রাস পেলে চাকরি হারাবে বহু মানুষ। জিডিপি কমলে মাথা পিছু আয় কমে, আর তার কারণে সরকারি খাতে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণও কমে। আর সেই অভাব পূরণের জন্যে উত্তরোত্তর মূল্যবৃদ্ধি হতে শুরু করে।

একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, জলবায়ু পরিবর্তন কেবল আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে না, ধীরে ধীরে কিন্তু দেশকে আরও দারিদ্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে বলে রাখা ভালো, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বাস্থ্যের অবনতি সবচেয়ে বেশী দেখা যায় এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে - ক্ষতির দিক থেকে দেখলে এখানে ভারত এগিয়ে রয়েছে। এমনও একদিন দেখতে হবে যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে আমাদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটল, কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম জাতীয় আয়ের হ্রাসের কারণে হাসপাতালগুলিতে আর উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই।

হ্যাঁ, এই সবের  পেছনে হাত থাকবে জলবায়ু পরিবর্তনের, আর থাকবে সমুদ্রস্তর বৃদ্ধি পাওয়ার মত ঘটনার, যেগুলোকে আমরা এখনও অবহেলা করছি।

ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্নের প্রফেসার আয়ান ইয়ং-এর মতে, রাজনৈতিক নেতাদের নজর ভবিষ্যতের আশঙ্কার দিকে ঘোরাতে হয়, তাহলে কিন্তু আমাদেরকে তাদের শর্তানুযায়ী চলতে হবে। ড: ইয়াং সরাসরি না বললেও, ওনার কথায় যেন আভাস পাওয়া যায় যে, অর্থনৈতিক ক্ষতি যদি রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থে আঘাত না হানে, তাহলে তাঁদের সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই কম।

More Articles