প্রেমে খুনই শেষ সত‍্য নয়, 'রক্তকরবী'-র বিশু পাগল তার প্রমাণ

Rabindranath Tagore: রাজাকে না হয় বদলে দিল নন্দিনী, বিশুর কী হলো

বিশুকে চেনেন?

গ্রামের ছেলে। গ্রামের অন্যান্য ছেলেদের মতো যে-মেয়েটিকে ঘিরে তার মনে তোলপাড় সেই মেয়েটি অন্যের প্রেম স্বীকার করেছে দেখে সে চলে গিয়েছিল। এলোমেলো, নিরুদ্দেশে।

তারপর?

তারপর একসময় বিয়ে করল আরেকজনকে। যতই হোক পুরুষের ঘা-খাওয়া অহং। এক জায়গায় আহত হলে অন্য জায়গায় অহং তৃপ্ত করতে চায়। ভাবে, দেখিয়ে দেব। দেখিয়ে হয়তো দেওয়া যায় তবে সবাই তা পারে না। বিশু অন্তত পারবে ভেবেও পারেনি। চেষ্টা করেছিল মাত্র। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান তো ‘সামাজিক চুক্তি’। যাকে বিয়ে করল, গ্রামের পাশের সদ্য গড়ে ওঠা খনিশহরে সে বড় চাকরি নিতে বলল তাকে, বিশু নিল।

তারপর কি they lived happily ever after?

না, বিশুর চাকরিটা পোষাল না। নৈতিকতায় আটকাল, নজরদারির কাজ সবার কি আর ভালো লাগে! একালে আমরা জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে নজরদারির আওতায় ঢুকে পড়েছি। আর বাইরে যেতে পারছি না। চতুর্দিকে একটাই বাণী ঘোষিত কিংবা অঘোষিত You are under CCTV surveillance। নজরদারির হাজারটা উপায়, হাজার রকম জাল। সেই জাল ছিন্ন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। যে নজরদার, সেও কিন্তু নজরদারির আওতায়। বিশু নজরদারির চাকরি ছেড়ে দিল। তবে বুঝতে পারল, চাকরি ছাড়লেও নজরদারির আওতাতেই রইল সে।

আরও পড়ুন: নির্ভেজাল, নিঃশর্ত বন্ধুত্বে বিশ্বাস করেননি সত‍্যজিৎ?

চাকরি ছাড়া বেকার পুরুষটির সামাজিক চুক্তিনিষ্ঠ বউটি তখন কী করল?

চলে গেল, চলেই গেল। বিশু কিছু করল না, বললও না। একা একা সেই খনিশহরে ভয়ে ভয়ে ফেকলুর মতো খোদাইকরদের সঙ্গে কোনওক্রমে জীবন কাটাতে লাগল।

তারপর খনিশহরে এল সেই মেয়েটি– যে মেয়েটিকে ভালবেসে না-পেয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিল, সেই মেয়েটি এল।

বিশুকে সেই মেয়ে নন্দিনী জিজ্ঞাসা করেছিল, গ্রাম থেকে হঠাৎ কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েছিল সে?

বিশু গানে-কথায় জানায় নিজের অতীত।

স্পষ্ট করে, নিত্যদিনের কেজো ভাষায় বলে না সে কথা। ভাবের ভাষায় বলে, ভেতরের ভাষায় বলে। কী বলে? সে খবর দেওয়ার আগে টিপ্পনী কিংবা একটু কমার্শিয়াল ব্রেকের মতো অন্য প্রসঙ্গ।

যতই হোক, এই গল্পটা নাটকের মধ্যে যিনি বুনে দিচ্ছিলেন, তিনি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর রকম-ফের আলাদা।

তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে। ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধের ভাঙনের অভিজ্ঞতা সেখানকার সাহিত্যে নানা টালমাটাল নিয়ে আসছে। মানুষের কাজকর্মের ইতিবাচকতায় আর বিশ্বাস করতে পারছে না তারা। মানুষ পশুর মতোই আহার-নিদ্রা-মৈথুন ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যহীন, মানুষ নিতান্তই হেতুবোধ ও হিতবোধশূন্য আদিমতা পরিচালিত জীব, একথা মনে হচ্ছে তাঁদের। মানুষ কদর্যভাবে খুন করতে পারে, হয়ে উঠতে পারে তীব্র প্রতিহিংসাপরায়ণ, যৌনতার ক্রুর প্রকাশে মানুষের দোসর মেলা ভার। আর এই আদিমতার সত্যকে ঢেকে রাখার কারণ নেই কোনও। বঙ্গদেশের তরুণ সাহিত্যিকরা মানুষের এই আদিম ইতিহাস-পূর্ব প্রাগৈতিহাসিক প্রকৃতির প্রকাশ ঘটাতে চাইছেন তাঁদের লেখায়। আর ভাবছেন এভাবেই অতিক্রম করা যাবে রবীন্দ্রনাথের ভাবের ভুবন।

রবীন্দ্রনাথ কী ভাবছেন?

রবীন্দ্রনাথ তো জানেন মানুষ পশুবৎ, ঈর্ষাপরায়ণ, খুনি। খনি শহরে রঞ্জন খুন হল। খুন হলো যৌন ঈর্ষায়– প্রাগৈতিহাসিক অধিকারপরায়ণ যৌন ঈর্ষা সেই খনিশহরের রাষ্ট্রপতিবৎ, খাতায়-কলমে প্রশাসনিক প্রধান রাজার মন দখল করেছিল। তাই নন্দিনী যাকে ভালোবাসত, যে ছেলেটির কাছে বিশু পরাভূত হয়েছিল, সেই রঞ্জনকে রাজা খুন করল। নন্দিনীকে রাজা পেতে চায়, পায় না, তাই রঞ্জনকে খুন করে। এই খুনি রাজার গল্পটুকু বলেই কিন্তু ছেড়ে দিলেন না রবীন্দ্রনাথ কিংবা এমন কোনও দৃশ্যের অবতারণা করলেন না যেখানে নন্দিনী রাজাকে প্রত্যাঘাত করে, খুনের বদলা নেয় খুন দিয়ে। এখানে রবীন্দ্রনাথ মানুষের পশুত্বকে দেখালেন, কিন্তু মানুষকে পশুত্বে আটকে রাখলেন না।

খুনি শাসককে ছেড়ে দিল নন্দিনী?

দিল। শুধু দিল না ‘সেই রাজা’র সঙ্গে পথে নেমে বিপ্লব সম্ভব করল।

‘সেই রাজা’?

না, ভুল হলো। এ-রাজা নয়তো সে রাজা। তার বদল হয়েছিল। রঞ্জনকে খুন করে সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল। রঞ্জনকে খুন করার কাজটা কিন্তু ঠান্ডা মাথার খুন নয়, সেই খুন মুহূর্তের উত্তেজনার ফল, রঞ্জনের প্রতি যৌন ঈর্ষার ফল। এই খুন রাজাকে সংশোধনের পথে এগিয়ে দিল। আর তাই নন্দিনী সেই খুনের ঘটনাটিতে আটকে না থেকে সংশোধিত রাজাকে সুযোগ দিল। রাজা নিজেই তার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, শাসনতন্ত্রকে ভাঙতে সে উদ্যত। এই বড়ো কাজ করে নিজের খুনের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় সে – সে সুযোগ থেকে নন্দিনী বঞ্চিত করেনি তাকে। রঞ্জনকে হারানোর দুঃখ বড়ো বিপ্লবের স্বপ্নে মিশিয়ে দিয়েছে নন্দিনী। মেনে নিয়েছে এ-রাজা সেই খুনি রাজা নয়।

রাজাকে না হয় বদলে দিল নন্দিনী, বিশুর কী হলো?

বিশু নন্দিনীকে বলেছিল, তৃষ্ণার জল যখন পাওয়া যায় না, তখন মরীচিকা সহজে ভোলায়। নন্দিনীকে না-পেয়ে সে যাকে বিয়ে করেছিল সে বিশুর তৃষ্ণার জল হয়ে উঠতে পারেনি, মরীচিকামাত্র ছিল। তাই মেয়েটি চলে গেছে, মিলিয়ে গেছে। তাকে মিলিয়ে যেতে দেখে বিমর্ষ বিশু কোনওক্রমে দিন কাটাচ্ছিল খনিশহরে। নন্দিনী ফিরে এসে আজ তার চোখ দিয়েছে খুলে। সে জানে নন্দিনীকে সে পাবে না, নন্দিনী রঞ্জনের কিন্তু সে নন্দিনীর সঙ্গে বিরহযাপন করবে, না-পাওয়া যাপন করবে। সেই না-পাওয়া যাপনের সূত্রেই সে নন্দিনীর পথে মিলে যাবে– সে বিপ্লবের বড় পথ। সেই পথে শেষ অবধি চলল বিশু নন্দিনীর না-পাওয়াকে স্বীকার করে, চলল নন্দিনী খুন হয়ে যাওয়া রঞ্জনের স্বপ্ন পূরণ করতে, চলল বদলে যাওয়া রাজা খুনের প্রায়শ্চিত্ত করতে। এ এক বড়ো প্রেমের আখ্যান – প্রেমের ঈর্ষা, জৈবতার খাঁচা থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার আখ্যান।

এ আবার হয় না কি? যত্ত সব আজগুবি অবাস্তব!

তাহলে কী সত্য? প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলে অ্যাসিড সত্য। তাহলে কী সত্য? খুন, খুন ও খুন সত্য।

সত্যের আমরা কি জানি?

সত্যের আমরা কিচ্ছু জানি না, প্রেমেরও কিচ্ছুটি জানি না।

More Articles