একদিকে উদ্দাম প্রেমের খোলা ময়দান, অন্যদিকে বিরহের নিভৃত কোণ

সুনীল-শক্তি দুই বন্ধু। বন্ধুতা কেবল সাদৃশ্যে হয় না, বৈসাদৃশ্যেও হয়। গালিবের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন শক্তি। লিখেছিলেন, সব সম্পর্ক ছিন্ন করবেন না, যদি আর কিছু না থাকে, তবে শত্রুতাই থাক।

সুনীল-শক্তির মদ্যপান নিয়ে, এতোল-বেতোল বন্ধুত্ব নিয়ে বাঙালি অনেক কথা বলেছে, কিন্তু তাদের কবিতার প্রেমের জগতের তুলনা নিয়ে তেমন কথা বা লেখা চোখে পড়ে না। তবে আলাদা আলাদা ভাবে দু'জনের প্রেমের কবিতা একসময় বাঙালি যুবক-যুবতীদের ঠোঁটে লেগে থাকত, এখনও হয়তো থাকে। সুনীলের নীরা প্রেমের প্রতিমা যেন, আর সুনীলের ভেতরের সেই বেকার ছটফটে যুবা যে নীললোহিত, নীলু, সে মাঝে মাঝেই চলে যায় দিকশূন্যপুরে। সেই ভৌগোলিক জায়গাটির কতগুলি বৈশিষ্ট্য আছে। সেখানে ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকার স্বীকৃত ও অস্বীকৃত– নিজেদের ঘর-বাড়ি আছে, বাগান আছে, কিন্তু প্রহরা নেই। চুরি হয় না। অথবা কেউ অপরের সম্পদ ভালবেসে ব্যবহার করতে চাইলে করতে দেওয়া হয়। সেই ব্যবহারের মধ্যে যে ইচ্ছে কাজ করে, তা খামখেয়ালি ও উদাসীন। সংসারী লোকের মতো সেখানকার লোকেরা রোজই অপরের জিনিস লুব্ধ হয়ে ব্যবহার করতে চায় না। এই উদাসীন জায়গাটি কোথায় কে জানে? তবে সুনীলের উপন্যাস পড়ে জানা যায়, নীলু বা নীললোহিত বাসে উঠে নেমে হেঁটে সেখানে চলে যায়।

সুনীল তাঁর ভালবাসার মধ্যে যে উদাসীন মুহূর্ত যাপন করতে চেয়েছিলেন, তা এই দিকশূন্যপুরের কল্পনায় মেলে। নীলু সেখানে এসে চুমু খেতে চাইলে অকপটে চুমু খেতে পারে। এই আদরের ক্রিয়াগুলি সেখানে যেন যৌনতা নয়– প্রেমের মুহূর্ত, উদ্‌যাপনের প্রকাশ। যে যৌনতা সন্তান-উৎপাদনশীল, সামাজিক, যা ব্যক্তি আর সম্পদের একক অধিকারে বিশ্বাসী, তার সঙ্গে দিকশূন্যপুরের ভালবাসার কোনও মিল নেই। সেই ভালবাসা ও সেই ভালবাসার ক্রিয়াগুলি দু'জনের স্বেচ্ছাসম্মত ও তারপর যখন পরস্পর পরস্পরের থেকে চলে গেল, তখন বেশ একটা ‘ফুরফুরে’ ভাব – কেউ শোক-তাপ করছে না, পরে আর এই মুহূর্ত ফিরে আসবে কি না, তা ভাবছে না, মুহূর্তটি ধারণ করেছে– আনন্দে, বাসনায়। এমন হতে পারা কঠিন, তবে হতে পারলে দুর্দান্ত! ভালবাসার নির্মোহ যাপনের পর তারা আটকে যাচ্ছে না ভালবাসার কাছে, তারপর আবার চলে যাচ্ছে নিজের নিজের সামাজিকতায়।

আমাদের সামাজিক পরিস্থিতি ও পরিবেশে দিকশূন্যপুর নেই। এ সুনীলের নির্মিত ও কল্পিত এক দেশ। সরল, উদার সেই দেশটি, আর সন্তান, শরীরের ব্যক্তিগত অধিকার ইত্যাদি প্রশ্নের বাইরের সে-দেশ। সুনীলের এই ইচ্ছাপূরণের দিকশূন্যপুর সম্পর্কে পাঠকের মনকেমন করতে পারে, সেই জায়গাটাকে পেতে ইচ্ছে করতে পারে, কিন্তু সুনীলের লেখার ও বলার গুণেই তীব্র বিষাদ, বিরহ-বিষণ্ণতা দিকশূন্যপুরের যাপনে জেগে ওঠে না। এমনকী, সুনীলের নীরা বিষয়ক বিরহ-কবিতাগুলিও মনকেমনের সুন্দর যাপন– লণ্ডভণ্ড তীব্র বিষাদ-বিপন্নতা সুনীলের প্রেমের কবিতার ভূষণ নয়।

সেই লণ্ডভণ্ড তীব্র জ্বরো বিষাদ শক্তির কবিতার অভিজ্ঞান। শক্তি দিকশূন্যপুরে যান না। তাঁর ছিল হৃদয়পুর। শক্তি 'হৃদয়পুর' শব্দটি গভীরভাবে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর 'ধর্মে আছো জিরাফেও আছো' বইতে। কবিতার বইটি তিনি ‘আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠকের’ হাতে তুলে দিয়েছিলেন। একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, এই বইয়ের কবিতাগুলিতে তিনি সচেতনভাবেই রবীন্দ্রনাথের ধরনের ছন্দ ও ভাষা একটু সরল করে ব্যবহার করেছিলেন।

শক্তির হৃদয়পুর সুনীলের দিকশূন্যপুরের চাইতে অন্যরকম। হৃদয়পুর দিকশূন্যপুরের মতো ফুরফুরে নয়। সেখানে পর্যটনের ইচ্ছে সকলের হবে না। সেই কারণ ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে/ বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ শক্তি জীবনানন্দের কবিতার গভীর পাঠক। তাই হৃদয়পুরের বেদনার কথা তিনি লিখতে চাইতেন। সে বাইরের জায়গা নয় ভেতরের জায়গা, সেখানে বাসে করে যেতে হয় না, ঘরে বসে নিজের ভেতরে চলে যাওয়া যায়। যেমন মনের মানুষের কাছে যান বাউলরা, তেমনই যেন।

book cover

'ধর্মে আছো জিরাফেও আছো'-র প্রচ্ছদ

বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। ১৯৬৩-র জুনে 'দেশ' পত্রিকায় শক্তি লিখলেন, ‘তখনো ছিলো অন্ধকার তখনো ছিলো বেলা/ হৃদয়পুরে জটিলতার চলিতেছিলো খেলা।' এই জটিলতা বিরহের, বেদনার। সেখানে নানা ঋতুর আনাগোনা। বিশেষ করে বর্ষা শক্তির হৃদয়পুরে গভীর, গহন। দূর বাগানের কেতকী ফুল সেখানে আকুল হয়ে ফোটে। এই বিরহ যার জন্য, বিরহী তাকে মনের ভেতরে ছবির মতো রাখে, বলে ‘অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে/ তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো’। অভিমানী স্মার্টনেস অবশ্য সেই বিরহীর আছে। জিজ্ঞাসা করতে পারে তাই, ‘লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা?’ চাইলে কি সে ফিরিয়ে দেবে স্মৃতি? দেবে, কিন্তু অপেক্ষা করবে তবু, বলবে ‘তু্মি যদি পারো ফিরে এসো কাছে সময় হলে।।’ এই যে অপেক্ষা, তা একার অপেক্ষা, নীরব অপেক্ষা, অপেক্ষায় বিখ্যাত না হওয়ার অপেক্ষা। কারণ ‘যত বড়ো রাজধানী/ তত বিখ্যাত নয় এ-হৃদয়পুর‌’।

 

book cover

তাঁর আত্মজীবনীর নামও রেখেছিলেন 'হৃদয়পুর'

শক্তি যখন এই হৃদয়পুরের কথা লিখছিলেন, তখন স্বাধীন ভারতের এক যুবার পক্ষে এই হৃদয়পুরের কথা লেখা সব দিক থেকেই খুব কঠিন। স্বপ্নভঙ্গের স্বাধীনতা যুবসমাজকে ক্রুদ্ধ ও অধিকারপরায়ণ করে তুলছিল। বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল কেউ কেউ। সেই সময় এমন অন্তর্গত বিষাদ-পদাবলি লেখা যেন নিজেকে অন্তর্গতে প্রত্যাহার করে নেওয়া। প্রেমের পর্যটন নয়, এ বিরহের একান্ত যাপন। এখানে একটা প্রশ্ন উঠে পড়ে। সুনীলের দিকশূন্যপুর একটি বেকার ছটফটে যুবার পর্যটন-ক্ষেত্র– তার খানিকটা সময় কাটানোর জায়গা, ফুরফুরে মুক্তির ঘরবাড়ি। কোনও রাগী যুবতী যদি এমন দিকশূন্যপুরের কথা লিখতে চাইতেন সে-সময়ে, তাহলে তিনি কীভাবে ভাবতেন বা পরিকল্পনা করতেন! নীললোহিত নামক ছেলেটির প্রাপ্তি ও মুক্তির জন্যই যেন দিকশূন্যপুরের খোলা মাঠের ও উদার সমাজের জন্ম। শক্তির হৃদয়পুর কিন্তু নির্দিষ্ট লিঙ্গের অধিকারী কবির ভাবনা নয়– এ এক বিরহীর, কাঙাল বিরহীর কল্পনা। সে মেয়ে হতে পারে, ছেলে হতে পারে– সে প্রেমে কাঙাল ও বিরহ-যাপনে একাকিত্বের অধিকারী হতে চাইলে হৃদয়পুরের কথা ভাবতে পারে, ভাবতেই পারে।

এখন কি এভাবে আর কেউ যাপন করতে চাইবেন শক্তির মতো বিরহ?

আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিল না আষাঢ়-শেষের বেলা
উদ্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী

বিরহের আনন্দ আছে। যে পায়, সে পায়। সেই আনন্দ দিকশূন্যপুরের মতো ফুরফুরে আনন্দ নয় অবশ্য। নিজের ভেতরে ডুবে থাকার বিরহানন্দ।

সুনীল-শক্তি দুই বন্ধু। বন্ধুতা কেবল সাদৃশ্যে হয় না, বৈসাদৃশ্যেও হয়। গালিবের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন শক্তি। লিখেছিলেন, সব সম্পর্ক ছিন্ন করবেন না, যদি আর কিছু না থাকে, তবে শত্রুতাই থাক। দিকশূন্যপুরের সঙ্গে হৃদয়পুরের সম্পর্ক শত্রুতার না মিত্রতার, তা কে জানে!

More Articles