কুমার সাহানি: ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যাত্রা
Kumar Shahani Movies: জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথের কাছে অন্তত 'চিত্ররূপময়' আর 'তাকিয়ে দেখার আনন্দ' পেয়েছিলেন, সাহানি সত্যজিতের কাছে 'সফিস্টিকেটেড রেসপন্স টু কালার' ব্যতীত কিছুই পেলেন না।
পশ্চিম রাজস্থানে সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে লিখতে বসলে ক্রমেই এ অঞ্চলের প্রাণঘাতী রোদ্দুর চারিদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বোঝা যায় চামড়া পুড়িয়ে দেওয়া মরুভূমির গ্রীষ্ম আসতে আর বেশি দেরি নেই। কুমার সাহানি, প্যারিসের Institut des hautes études cinématographiques-তে (IDHEC) সিনেমা চর্চা করতে করতে, তাঁর ফরাসি গুরু রবের ব্রেসঁর সঙ্গে ছবিতে কাজ শিখতে শিখতে, মে ১৯৬৮-র প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতেও আদতে যার অভাব বোধ করতেন ফরাসিদেশে, তা এই উপমহাদেশের সূর্যালোক। দেশে ফিরে এসে করা তাঁর প্রথম ছবি 'মায়া দর্পণ' (১৯৭২)-এর প্রেক্ষাপট রাজস্থান, সেখানে এই ট্রপিক্যাল রুক্ষ ঊষর দিগন্তের কর্কশ আলো তিনি ধরে রেখেছেন, যে আলো আর ভূমি তাঁর ছবিকে ক্রমেই বিমূর্ততার দিকে নিয়ে যায়। রাজস্থানের সে আলো ধীরে লাল থেকে সবুজের দিকে যাবে, যেমন করে ছবির মেয়ে তরন (অদিতি) নির্জলা রাজস্থান ছেড়ে শেষ দৃশ্যে অসমের ঘন সবুজ বনপাহাড়ের দিকে, নদীর বিরাট বিস্তারের উপরে ভেসে যেতে থাকে। নির্মল ভার্মার মূল কাহিনির শেষে যা ঘোষিতভাবেই স্বপ্ন, সাহানির ছবিতে তা ক্রমশই বাস্তবের সঙ্গে অবিভাজ্য হতে থাকে।
যখন সাহানি সরকারি অর্থে এই ছবি করার সুযোগ পেলেন, তাঁকে কালার ফিল্মে ছবিটি করার জন্য অনেকটা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সেটা জেনে অনেকে উৎসাহিত করেছিলেন তাঁকে এই মর্মে যে, 'রঙিন ছবি' চলবে ভালো। কথাটা সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করতেন সাহানি খানিক ঠাট্টার সুরেই, কেননা তিনি ঠিক কোন গোত্রের ছবি বানাতে চলেছেন সে সম্পর্কে এঁদের কোনও ধারণাই ছিল না। সেই ছবি, 'মায়া দর্পণ’, যখন শেষ হলো তখন তা কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারল না। সাহানির দীর্ঘ সংগ্রামের সেই শুরু। দেশি খবরের কাগজের পেশাদার চিত্র সমালোচকরা তাঁর ও মণি কাউলের ছবিকে অসহনীয় আখ্যা দিল। ফিল্মফেয়ারের পাতায় পাতায় এ ধরনের ছবির পেছনে সরকারি টাকা নষ্ট করা উচিত কিনা, ছবিতে সরকারি এজেন্সি (এফএফসি/এনএফডিসি) টাকা ভর্তুকি দেবে না ঋণ হিসাবে দেবে এই সব তর্ক চলল। অমল পালেকর যখন সাহানির দ্বিতীয় ছবি 'তরঙ্গ’-এ (১৯৮৪) অভিনয়ের জন্য ডাক পেলেন, তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বলল, এ তো খুব সহজ ব্যাপার! কুমার সাহানির ছবি মানে তো তোকে একদিক থেকে আরেকদিকে ক্রমাগত হেঁটে যেতে হবে। সাহানির বামপন্থী বন্ধুরা 'মায়া দর্পণ' দেখে সেটিকে মূলত এক 'সেন্সুয়াস' অভিজ্ঞতা বলে আখ্যায়িত করলেন এবং অত্যন্ত অস্বস্তি তৈরি হলো তাঁদের ছবিটি সম্পর্কে, সত্তরের দশকে সাহানির মতো একজনের কাছে এরকম 'রাজনীতি-রহিত' ছবি তাঁরা আশা করতে পারেননি। সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রবন্ধে মণি কাউলের 'উসকি রোটি' (১৯৬৯) ও 'দুভিধা' (১৯৭৩) এবং সাহানির ছবিটি সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোর মনোভাব প্রকাশ করলেন, সে নিয়ে ফিল্মফেয়ার পত্রিকায় অনেক চিঠিপত্র, তর্কাতর্কি চলল। জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথের কাছে অন্তত 'চিত্ররূপময়' আর 'তাকিয়ে দেখার আনন্দ' পেয়েছিলেন, সাহানি সত্যজিতের কাছে 'সফিস্টিকেটেড রেসপন্স টু কালার' ব্যতীত কিছুই পেলেন না। তাঁদের সামাজিক সমস্যা নিয়ে কোনও উৎসাহ না থাকা, ন্যারেটিভের প্রচলিত প্রায় সব চেহারা এবং অভিনয়ের বাস্তববাদী পদ্ধতি বর্জন ইত্যাদি সত্যজিতের কাছে সমস্যাজনক মনে হলো। মনে হলো, এই গোত্রের সিনেমা দর্শকের ভালো ছবি নিয়ে তৈরি হতে থাকা উৎসাহ তো নিভিয়ে দেবেই, সরকারি ফান্ডিং এজেন্সিও দ্রুত দেউলিয়া হবে।
আরও পড়ুন- বাংলা সিনেমা: যেটুকু যা ছিল, আছে, থাকবে
প্রবীণ শিল্পীর কাছে নবীন শিল্পীর নতুনতর কাজের সঠিক মূল্যায়ন না হওয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সহমর্মীদের কাছে কেন ছবিটির আবেদন ব্যর্থ হলো? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে সাহানির ছবিজীবনের পূর্বকথায়, সাহানির হয়ে ওঠার গল্পে। তাঁর তিন গুরুর একজন দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বি, যাঁর কাছে তিনি ভারতীয় মিথে, পুরাণকথায়, মহাকাব্যে ইতিহাসের পাঠ নেবেন। ফরাসি দেশে তাঁর শিক্ষক রবের ব্রেসঁকে Une femme douce (A Gentle Woman, 1969) নামক দস্তয়ভস্কি অ্যাডাপটেশনে সহায়তা করতে গিয়ে সাহানি দেখেছেন তাঁর কুলিশকঠোর austere স্টাইল, প্রচলিত ফিল্ম অভিনয়ের বিরোধিতা এবং এমন এক ইমেজ-নির্মাণ যা সাহানির সাংগীতিক মনে হয়েছিল। পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে তাঁদের ভারতীয় নবতরঙ্গের প্রজন্মের (মণি কাউল, জন আব্রাহাম, আদুর গোপালকৃষ্ণন প্রমুখের চলচ্চিত্রের শিক্ষা একই সময়ে) শিক্ষক ঋত্বিক ঘটকের নানা বৈশিষ্ট্য তাঁর সঙ্গে থেকে যাবে বাকি জীবন। 'মায়া দর্পণ’-এ 'মেঘে ঢাকা তারা'-র পাহাড়ি থিম মিউজিক মৃদু প্রশ্রয়ের সঙ্গে ফিরে আসে নেপথ্যে, আর প্রবলভাবেই আসে রাগ মলহার। সাহানি আর ভাস্কর চন্দভারকর ব্যাখ্যা করেন, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া ও জারিন দারুওয়ালার কাছে কেন মরুর দেশে বাঁশি ও সরোদে মলহার চাইছেন তাঁরা। একে তো তা 'মেঘে ঢাকা তারা'-কে উদ্ধৃত করে, তদুপরি বৃষ্টি যে দেশে নেই সে দেশে বৃষ্টির আকাঙ্খা থাকবেই। সাহানি তাঁর বামপন্থী বন্ধুদের বোঝাতে পারেননি কোশাম্বির মতো একজন মার্ক্সবাদীর কাছে কেন মিথের অন্তর্বয়ন শেখেন তিনি, কেমন করে তাঁর রাজনীতি হয়ে ওঠে কোশাম্বিয় (শব্দটি সাহানি আমার সঙ্গে এক দীর্ঘ টেলিফোন সাক্ষাৎকারে নিজেই ব্যবহার করেছিলেন)।
আরও পড়ুন- অনুরাগ ‘ঘটিয়া’ না বললে যেন জানাই হত না
ছবির পর ছবিতে সাহানি ফিরে যাবেন হিন্দুস্তানি মার্গসঙ্গীতের অন্তহীন বিস্তারের কাছে, ভারতীয় মিনিয়েচার শিল্প, আজরাখ আর নয়নসুখ চিত্রের কাছে, সভ্যতার ইতিহাসকে ধরবেন অসংখ্য মেটিরিয়ালের সূত্রে (টেক্সটাইল, ভাস্কর্য, ধ্রুপদী ও লোকায়ত সঙ্গীত, অভিনেতাদের ভাস্কর্যপ্রতিম চলন), আর তাঁর ছবিতে এই সব উপাদান সিনেমার মতো এক নশ্বর মাধ্যমকে সংযোগ স্থাপন করাবে অনন্তের সঙ্গে। ইওরোপে এপিক ফর্ম চর্চায় দীর্ঘকাল নিয়োজিত থাকাকালীন সাহানি মিকলোস ইয়াংচোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেন হাঙ্গেরির অসীম দিকচক্রবাল কেমন করে তাঁর ক্যামেরায় সসীম হয়ে ওঠে, কীভাবে প্রলম্বিত টেক বা সিকোয়েন্স শট তৈরি হয় তাঁর ছবিতে তা নিয়ে (লং টেক প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, তারকোভস্কি বিষয়েও সাহানির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে)। তাঁর নিজের ছবিরও প্রলম্বিত টেকে আমরা শটের মধ্যে দিয়ে সময়ের প্রবাহ অনুভব করি। একক, প্রায় স্থিরচিত্রের মতো ইমেজ বনাম এক সিকোয়েন্সে ইমেজের বিস্ফোরণ সিনেমার এই দুই মেরুর মধ্যে সংযোগ আনতে পারে কেবল সঙ্গীতের বিমূর্ততা, এ কথা সাহানি বলেছেন নানা সময়। তাঁর অভিনেতারা অন্তহীন পথ চলে ছবির পর ছবিতে নানা ইতিহাস আর নানা ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে দিয়ে, তারা (যেমন মিতা বশিষ্ঠ বলেছেন এক সাক্ষাৎকারে) মহাজগতের অংশ হয়ে উঠতে থাকে। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আকীর্ণ তরঙ্গ (এমারজেন্সির সময় এবং পরের বম্বে শহর, শিল্পপতি পরিবারের রাজনীতি বনাম ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, অতিবামপন্থার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত) কোশাম্বিয় মিথের পাঠ আশ্রয় করে উর্বশী-পুরুরবা আখ্যানে প্রবেশ করে। 'খায়াল গাথা'-র (১৯৮৯) শরীর জুড়ে দেশীয় মিথ আর গ্রিক মিথ, হীর-রঞ্ঝা আর অরফিউস-ইউরিডিস একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। হ্যামলেট তিনি ছবি করতে পারেননি, কিন্তু 'তরঙ্গ'-এর হান্সা (কাওয়াল গান্ধীয়ক) বম্বের শিল্পপতির অন্দরমহলের কর্কশ সাদা দেওয়াল পেরিয়ে গিয়ে ওফেলিয়ার মতো এক ফুল্লকুসুমিত মৃত্যু বেছে নিয়ে জলে ভেসে থাকে। যেমন সুফি সন্ত 'খায়াল গাথা'-র ছেলেটিকে বলেন নদীর কাছাকাছি থাকতে, যাতে তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয়। তাই ছবি জুড়ে তাঁর চরিত্ররা জলপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে যেতে থাকে। আর তাদের অন্তহীন পদচারণা, যা বিদ্রূপের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল সাহানির জীবদ্দশায়, হয়ে ওঠে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যাত্রা, যেমন মায়া দর্পণে তরনের স্বপ্ন জুড়ে থাকে অ্যাপোক্যালিপটিক ইমেজের সারি ও নুরুদ্দিন পদমসীর 'ইমেজেস অব ভায়োলেন্স'।
এই ধ্বংসের মধ্য দিয়ে অবিরত হেঁটে চলার কথা আমার মনে পড়েছিল, পুনের ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভে সাহানির শেষ দীর্ঘ যে সাক্ষাৎকারটি পেয়েছিলাম টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সেটি পড়তে গিয়ে। খালিদ মোহামেদের নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে সাহানি দুঃখ করে বলেছেন ভারতীয় স্টেটের সাংস্কৃতিক বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা, যাতে তাঁর সম্ভাবনাময় ছাত্ররা আর ছবি করতে পারছে না। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের তারিখ ছিল ডিসেম্বর ৬, ১৯৯২।
(লেখক চলচ্চিত্র সমালোচক ও ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি যোধপুরের শিক্ষক)