সিনেমার কৌমার্যব্রত: কুমার সাহানি
Kumar Shahani: কুমার সাহানি চলে যাওয়ার জন্য বেছে নিলেন সেই শহর যা তাঁর গুরুর সাধনাস্থল। চলচ্চিত্রকার কুমার সাহানি ঋত্বিক ঘটকের কাছ থেকে কী শিখেছিলেন?
সম্ভবত ২০০৮ সাল, ওশিয়ান সিনেফ্যান চলচ্চিত্র উৎসবের দশম বর্ষপূর্তি চলছে। স্থান দিল্লির একটি অভিজাত হোটেলের পুলসাইড পানালয়। জুলাই মাসের সেই দহনক্লান্ত সন্ধ্যায় এক অলৌকিক বিস্ময়ে আমি সঙ্গী হয়ে যাই একটি প্রৌঢ় যুবাদলের। সেখানে ছিলেন সৈয়দ মির্জা, কুমার সাহানি, আদুর গোপালকৃষ্ণন, একটু পরে উৎসবের কিউরেটর হিসেবে পরিচিত যিনি অর্থাৎ মণি কাউল যোগ দিলেন। আমি দেখলাম সময় তরতর করে পিছিয়ে গেল। এই চলচ্চিত্র নির্মাতারা ক্রমাগত বলে চলেছেন তাঁদের ছাত্রজীবনের কথা এবং তাঁদের দ্রোণাচার্য শ্রী ঋত্বিক কুমার ঘটক কী অশেষ রত্নরাজি রেখে গেছেন তাঁদের জন্য। কুমারের সঙ্গে আমার সেই প্রথম নিবিড় আলাপ হলো।
প্রথমে জন আব্রাহাম বিদায় নিয়েছিলেন। তারপরে ক্রমান্বয়ে কে কে মহাজন, মণি কাউল, কুমার সাহানিও চলে গেলেন। পরিণত বয়সেই গেলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, চলে যাওয়ার জন্য বেছে নিলেন সেই শহর যা তাঁর গুরুর সাধনাস্থল। চলচ্চিত্রকার কুমার সাহানি ঋত্বিক ঘটকের কাছ থেকে কী শিখেছিলেন? আমার মনে হয়, তিনি চাইছিলেন জনৈকা রূপোপজীবিনীকে কৌমার্যের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। সিনেমাকে তিনি মনে করতে চাইছিলেন কুমারী মাতা- এই শিক্ষা অবশ্য তিনি পেয়েছিলে রবের ব্রেসঁর থেকে।
আরও পড়ুন- প্রচারের প্রলোভন সাহিত্যের জন্য মারাত্মক : মিলান কুন্দেরা
আসলে কুমার সাহানি এক প্রহেলিকা। একমাত্র ভারতীয় চলচ্চিত্রকার, যিনি আমাদের চলচ্চিত্রীয় আধুনিকতার দুই বিপরীতমুখী অভিভাবক ঋত্বিক ঘটক ও সত্যজিৎ রায়, দু'জনের দ্বারাই পরীক্ষিত হয়েছিলেন। সেই ১৯৭২ সালে ঋত্বিক সস্নেহে তাঁর সম্বন্ধে লিখিত মন্তব্য করেছিলেন, “কুমার সাহানি। পাঞ্জাব-কাশ্মীরের ছেলে। পায়ে 'পোলিও' আছে, দেহে খানিকটা অক্ষম। পরিচালক হিসেবে কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। ছবি আরম্ভ করেছে। ও পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটের প্রথম পুরস্কার, স্বর্ণপদক পেয়েছিল (তখন আমি ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত)। ওর উপরে আমার অগাধ ভরসা।" যেমন মণি কাউল সম্পর্কে বলেছিলেন, " 'উসকি রোটি' করেছে, দেখিনি এখনও। কাজ কিছু 'স্টিলটেড'। পোজ করবার প্রবণতা বেশি কিন্তু বুদ্ধিমান। বয়স বাড়লে মনে হয় ওই গোলমালগুলো কেটে যাবে।" কী জানি কী অজ্ঞেয় কারণে আমার মনে হয়, দু'বছর বাদে সত্যজিৎ রায় যে এই দু'জনকেই বিশেষ তিরষ্কার করার জন্য বেছে নিলেন তাঁর সুবিখ্যাত 'সওয়া-চার' নিবন্ধে তার অন্যতম কারণ এই দু'জন ঋত্বিকের শিষ্য হিসেবে ধুনি জ্বালিয়ে বসে ছিলেন। বলাবাহুল্য, নিবন্ধটি ইংরেজিতে লিখিত, মূল নাম 'ফোর অ্যান্ড আ কোয়ার্টার'। আমার পাঠক ধরতেই পারবেন, সত্যজিতের প্রিয় ছবি ফেলিনির 'এইট অ্যান্ড হাফ'-কে স্মরণে রেখেই তিনি আধুনিকতার একটি মর্জিকে নস্যাৎ করার জন্য ডেকে নিলেন। সত্যজিতের অভিযোগ কী ছিল? মূলত তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে, কুমার এবং মণি ঋত্বিক ঘটককে প্রণাম করেন কারণ তিনি তাঁদের পুণেয় পড়িয়েছিলেন কিন্তু ঋত্বিকের কোনও গুণই তাঁরা পাননি, যেমন জোরালো বক্তব্য, বলিষ্ঠ চলচ্চিত্রায়ন, সামাজিক চৈতন্য। বরং তাঁদের ক্যামেরা সঞ্চালন এবং সম্পাদনায় ঋত্বিকের কোনও প্রভাব দেখা যায় না। উত্তরাধিকার শুধু পরিহাসহীনতা। কুমারের প্রথম ছবি 'মায়া দর্পণ'-এ ব্রেসঁর কথা ভাবা হয়। 'ম্যুশেত'-এর নায়িকাও অন্তর্গত রক্তপাত সহ্য করেন নীরবে। ব্রেসঁ অসামান্য তৎপরতা দেখিয়েছেন কিন্তু দর্শক তো বাইরে থেকে ইমেজকে পরীক্ষা করবেন, কুমার সাহানির ক্ষেত্রে সেই পরিসর অন্তর্হিত হয়ে যায়। কুমারকে আক্রমণ করে তিনি অধিকন্তু যোগ করেন যে, তাঁর রং এবং বিশিষ্ট অভিনয়ভঙ্গিও বাস্তব থেকে চরিত্রগুলিকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। আর মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতাও এখানে কাজে আসে না।
অনেকদিন পরে আমার সঙ্গে যখন কুমারদার দেখা হয়, তখন এই প্রসঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞেস করায় তিনি সহাস্য জবাব দেন, "আমরা বস্তুত মানিকদার সমালোচনাতে হকচকিয়ে গেলেও খুশি হয়েছিলাম কারণ আমরা যথার্থভাবেই ভারতীয় আভাঁ-গার্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলাম। তবে সুযোগ থাকলে আমরা সত্যজিৎ রায়কে আমাদের সঙ্গে বসিয়ে ছবিটা দেখতে বলতাম। আমরা বোঝাতে চাইতাম আমরা কী করতে চেয়েছিলাম।"
হয়তো সত্যজিৎ রায়কে বোঝাতে পারেননি কিন্তু কুমার এক অসম সাহসে সিনেমার নরকে নির্জন পথে জ্যোৎস্না আলোকে সন্ন্যাসী একা যাত্রী। পুণেতে ঋত্বিক ঘটকের কাছে তিনি শিখেছিলেন শব্দ কী করে শূন্যতার ডালপালা বিস্তার করে। ঋত্বিক তাঁদের বুঝিয়েছিলেন, সিনেমায় সবচেয়ে বড় ভুল শুদ্ধ টোনের দিকে ঝোঁক। আর আধুনিক মানুষ শব্দের সংকেত চায় কোলাহল মুক্ত কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কোলাহলই তো সঙ্গীত সৃষ্টি করে। সঙ্গীতের মূল কোলাহলই। আমাকে কথোপকথনের মুহূর্তে তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেক শব্দের নিজস্ব শৈল্পিক ক্ষমতা আছে। কিছুক্ষণ পরেই সেই ক্ষমতা হারিয়ে যাবে যদি আপনি তার আশেপাশের কোলাহলকে মেনে না নেন। মূলে যে ওভারটোনাল শব্দ তা নিজেই হারিয়ে যাবে এটা একটা বড় সমস্যা। বস্তুত তিনি স্মরণ করতে চাইছিলেন ওভারটোনাল মন্তাজ দিয়ে ঋত্বিকের বিখ্যাত তত্ত্বায়নকে। যখন পুণের পাঠ শেষ হলো, তখন বারীন সাহার মতোই কুমার সাহানি প্যারিসে উচ্চশিক্ষার জন্য IDHEC-তে গেলেন, আর সেখানেই পেলেন তুলনাবিরহিত রবের ব্রেসঁ-কে। পরবর্তীকালে তিনি ব্রেসঁর 'ইউন ফাম দ্যুস'-এর সহকারী হিসেবে কাজও করবেন। রবের ব্রেসঁ কে? কুমার সাহানির সংক্ষিপ্ত উত্তর, "এক তপোক্লিষ্ট সন্ন্যাসী, যেন ভগবান তথাগত", যিনি ছায়াছবি থেকে সমস্ত আভরণ কেড়ে নিতে চান। যার 'বালথাজার' দেখলেই আমাদের মনে হয় 'আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলঙ্কার'। ঋত্বিক ঘটককে পরবর্তীকালে কুমার ব্রেসঁর 'ডায়েরি অফ আ কান্ট্রি প্রিস্ট' দেখেছেন কিনা জানতে চান। কুমারের নিজের কথায়, "আমি ঋত্বিকদাকে জিজ্ঞেস করি, কী ভাবছেন? বললেন, অন্য যে কোনও বামপন্থী মানুষের মতোই এটা আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। কুমার জানতে চান কীসের জন্য এই আকর্ষণ? ঋত্বিকের তাৎক্ষণিক উত্তর, “আহা ব্রেসঁ, ও সব মিলিয়ে অনেক আলাদা।"
অথচ কুমার যখন দেশে ফিরলেন, তাঁর প্রথম ছবি যা বানালেন তার নাম 'মায়া দর্পণ' (১৯৭২)। বলাই বাহুল্য, তবু এদেশে কেউ বলে না বলেই বলছি, এই নামকরণের মধ্যেই জঁ ককতো-র 'অরফি' ছবির ছায়াপাত আছে। কবিদের মৃত্যু ও সৌন্দর্যস্নান সম্পন্ন হতে পারে আয়নার ওপারে। কবিতা শুধুই দর্পণে ভ্রমণ। জঁ ককতো-র এই ছবি যুগে যুগে চলচ্চিত্রকারদের প্রভাবিত করেছে, সাহানি তা মাথায় রাখলেন। আর ব্রেসঁ তো ছিলেনই, যাকে গোদার বলেন দস্তয়ভস্কি যেমন রুশ গদ্য, বেথোভেন যেমন জার্মান সঙ্গীত, রবের ব্রেসঁ তেমন ফরাসি সিনেমা। যে ছবি তিনি করলেন, আমাদের নজরে এল, আখ্যানের প্রচলিত রূপ তিনি বিসর্জন দিচ্ছেন। বস্তুত এক মন্থর দৃষ্টিপাত, রং ও মুখের স্টাইলাইজড বিন্যাস মনে করাচ্ছে কুমার সাহানি আর চরিত্রনির্ভর আখ্যানে উৎসাহিত নন। পুণেতে ছাত্র থাকাকালীন, তিনি ঋত্বিক ঘটকের ফ্রেমগুলিকে পরীক্ষা করতেন যে মানুষ কীভাবে সমগ্র নিসর্গের একটি উপাদান হিসেবে সংযুক্ত হয়। সেইভাবেই তিনি রঙে, চরিত্রদের চলাচলে, মন্থর গতিতে এই ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন। ছবিতে শাহরিক সমস্যা, সামন্ততন্ত্র থেকে নাগরিকতায় উত্তরণ এই বিষয়ে সত্তর দশকে কুমার সাহানির বক্তব্য ছিল। কিন্তু নিসর্গ ও স্থানের বিন্যাস এতই অভিনব ছিল যে স্বয়ং সত্যজিতও আহত হয়ে বলেছিলেন, ছবিটিতে এই নগরদর্পণ এই এক্সপ্রেসিভ জেশ্চারের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছে। পরবর্তীকালে কুমার সাহানি একা একা ঘুরে বেরিয়েছেন পাহাড়ে, সমুদ্রে ও মনীষার শিখরে। তাঁর পরের ছবি 'তরঙ্গ'-এর টাকা সংগ্রহ করতে প্রচুর সমস্যা হয়। কিন্তু যিনি ঋত্বিক ঘটক, রবের ব্রেসঁ, আন্দ্রেই তারকভস্কি এবং পিয়ের পাওলো পাসোলিনির কাছে দীক্ষা নিয়েছেন তিনি ভ্রষ্টকুলায় বাণিজ্যসফল হতে রাজি ছিলেন না। আমাদের সৌভাগ্য, ভারতীয় সিনেমার এই দার্শনিক দৃশ্যের অত্যাচার ও দৃশ্যের কুচকাওয়াজ পার হয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর মেধা ও শ্রমকে আজীবন ব্যবহার করেছেন। কোশাম্বির ছাত্র হয়েছেন। না হলে তিনি রবীন্দ্রনাথের 'চার অধ্যায়' নির্মাণের সময় জীবনানন্দের পংক্তি উদ্ধৃত করতেন না। সিনেমা সমকালীনতা দাবি করে, সিনেমার স্থান ও কাল যে অন্য বর্ণমালার অঙ্গীভূত এ কথা সহজীবিদের বোঝানোর সময় তাঁর প্রযত্ন ছিল অকপট।
আরও পড়ুন- বাংলা সিনেমার উচ্চতা থেকে পতন নিয়ে দু’চার কথা
সেই আকুতির দৃষ্টান্ত মিলেছে এদেশের চলচ্চিত্রের নানা শিক্ষায়তনে। পুণেতে সিনেমার ইন্সটিটিউটে তো বটেই, কলকাতায় যাদবপুরে, এসআরএফটিআই, রূপকলা কেন্দ্রে তাঁর যাতায়াত ছিল অবিরত। বস্তুত ছাত্রদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ে সাহানির উৎসাহের অন্ত ছিল না। একথা রূপকলাকেন্দ্রে চলচ্চিত্র সম্মেলনে যেমন সত্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও তেমনই সত্য। এ আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোপকথনের সময় খেয়াল করেছি, তিনি চান এমন এক ইমেজ যা সালঙ্কারা কিন্তু আড়ম্বরবর্জিত, যা একান্তভাবেই ভারতীয়। এই জন্যই ব্রেসঁর মিনিমালিস্টিক রীতি থেকে তিনি সরে এসেছেন। আর তিনি বুঝেছেন, ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্র যা উপহার দেয় ইতিহাসকে তা ব্যবহার করতে হবেই। ফলে আপাতভাবে তাঁকে আমাদের রিক্ত সন্ন্যাসী বলে ভাবার কোনও কারণ নেই। আচার্য ঋত্বিক ঘটকের মতোই তিনি আদিবাসীদের নৃত্যছন্দে একটা নিজস্বতা দেখেছিলেন যা স্বয়ংসম্পূর্ণ। ঋত্বিকের অযান্ত্রিকে শব্দ সংক্রান্ত যে কাজ, তা ছিল কুমার সাহানির নিত্যপাঠ্য। মূল আবেগের জায়গা থেকে যা একেবারে বিমূর্ততার শিখরে নিয়ে যায় এবং উল্লাসে পরিণত হয় শেষ পর্যন্ত সেই অনুভূতি ঋত্বিকের চলচ্চিত্র থেকে তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, আমরা আনন্দের সাধনে বিশ্বাসী।
কী শিশুসুলভ উদ্দীপনায় কুমারদা কলকাতার ছাত্রছাত্রীদের কাছে সিনেমার মর্মার্থ তুলে ধরতেন। রূপকলাকেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীদের তিনি বলেছিলেন, আমাদের গুরু আমাদের মধ্যে উদ্দীপনা ছড়িয়ে দিতে পারতেন, একটা সাধারণ শটকেও মনে হতো স্বর্গ মর্ত্যের সুরেলা মূর্চ্ছণা। আমি তত যোগ্য নই। কিন্তু আমিও বোঝাতে চাই যে, 'খেয়ালগাথা' শেষ পর্যন্ত তো একটা স্থাপত্য যা অনন্তে মিশে যায়। ছায়াছবির পার্থিব হাতছানি সত্ত্বেও কুমার সাহানি বোধহয় অনন্তেই মিশে গেলেন। খানিকটা ঋত্বিক ঘটকের প্ররোচনাতেই তাঁর প্রতিটা ফ্রেম emptiness ও nothingness-এর তফাত বুঝতে চাইত, এ এক বৌদ্ধ সর্বজনীনতা। ঋত্বিক সারাজীবন তাঁর চলচ্চিত্রে ও দর্শনে বৌদ্ধ শূন্যতাকে খুঁজে পেতে চাইছিলেন। কুমার সাহানি ঋত্বিকের একজন প্রকৃত উত্তরসাধক। হয়তো দামোদর কোশাম্বিরও।