নলেনের স্বাদ নোনতা! শেষ পাতে গুড়ের বদলে কেমিক্যাল খাবে বাঙালি?
Nalen Gur: বাঙালি পোস্তর বদলে হিং খাচ্ছে, খাঁটি ঘি নাকি মেলে না বহুদিন, গুড়ের বদলেও কি কেমিক্যাল খেতে হবে?
চাঁচোলে নতুন গুড়ের সন্দেশ গিয়েছিল কলকাতা থেকে। ছেলেটা সেই সন্দেশ নিয়ে ছুটল সোজা রিনির কাছে। প্রেমিকাকে না দিয়ে সে সন্দেশ খাবে না। রিনি দু'খানা সন্দেশই টপ করে খেয়ে ফেলল। কিন্তু ছেলেটা যে একটাও সন্দেশ খায়নি তখনও, তাহলে কী ব্যবস্থা করা যায়? ছেলেটি যখন পরে বাংলা গদ্যের অন্যতম দিকপাল হবে, তখন সে লিখবে তার 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা'-য়, পাখি যেমন করে তার শাবককে খাওয়ায়, রিনি তেমন করে সন্দেশ পুরে দিল বালক শিবরামের মুখে। নতুন গুড়ের স্বাদে যে এমন দুঃসাহসিক চুম্বন মিশে যেতে পারে, তা বোধহয় শিবরাম চক্রবর্তীই দেখালেন প্রথম। একেই বোধহয় যথাযথ 'মিষ্টিমুখ' বলা চলে।
কলকাতায় শীত এমনিতে আসে একটু সাহেবি পন্থায়। বাঙালির তেরো পার্বণে যে গোটা শীতকালটাই একটা পার্বণ, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। যেসব এলাকায় শহুরে শীত পেকে ওঠে, সেখানে নাহুমস-এর কেকের স্বাদ রয়েছে, নিউমার্কেট থেকে কেনা টাটকা সসেজের স্বাদ আছে, টেরিটির ভোরবেলার ধোঁয়া ওঠা ডাম্পলিংয়ের স্বাদ আছে। কিন্তু সুকুমার রায় যখন ঘোষণাই করে গেছেন, 'ঝোলাগুড়' নির্বিকল্প, সেখানে কলকাতার কোণে কোণে এই সময় পাটালি থেকে নলেন গুড়ের কৌটো বা মিষ্টির দোকানের নতুন তাক ভরে ওঠার খবরও আসবে যে, তা বলা বাহুল্য।
দিনকয়েক হলো, পোস্ত-র দাম হয়েছে আকাশছোঁয়া। এই অবস্থায় বাঙালি মধ্যবিত্তর হেঁশেলে নাকি ব্যাপারটা ম্যানেজ দেওয়া হচ্ছে হিং দিয়ে, গুঞ্জন অন্তত তেমনই। গুড়ের ক্ষেত্রে এখনও তেমন কোনও গুড়গুড়-ঢাকঢাক নেই বটে, তবে দোকানে দোকানে গুড়ের নামে যা আসছে, তা আসল জিনিস তো?
এই প্রশ্নের উত্তর গুড়ের দোকানিদের কাছে স্পষ্টভাবে নেই। উত্তর কলকাতার এক প্রসিদ্ধ মিষ্টি-নোনতার দোকানে শীতের মরশুমি আবহে কচুরি-তরকারির সকালযাপনের পাশাপাশি গুড়ের সমাচার জানতে চাইছেন অনেকেই। তেমন এক দোকানে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, জয়নগর থেকে গুড় আসতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। আর গুড় আসে মুর্শিদাবাদের লালবাগ থেকেও। আপাতত নদিয়ার গুড় গুটি গুটি পায়ে এসে পৌঁছেছে দোকানপাটে। উত্তুরে বাঙালি বাজারশেষে ছোট ছোট কৌটোয় ভরে তা নিয়েই রওনা দিচ্ছে বাড়ি।
আরও পড়ুন :শীতের আমেজ আর খেজুর গুড়ের যুগলবন্দি খাদ্য-বেরসিকের মনেও পুলক ধরায়
কিন্তু গুড় যতই মিষ্টি হোক, খরিদ্দারের মুখে হাসি ফোটা নেহাত সহজ নয়। একজন সরাসরি বলে বসলেন, সব গুড়ে ফটকিরি দাদা!
দোকানি আপত্তি করলেন না। তবে নিজের দোকান বাঁচিয়ে রাখলেন। বললেন, এখানে সব অরিজিনাল।
কিন্তু সত্যিই কি গুড়ের নামে ফটকিরি বেচা হচ্ছে বাজারে? সেই বেজার মুখ খরিদ্দার খুবই উৎসাহ নিয়ে মুখ খুললেন এই বিষয়ে। বললেন, গুড় একটু মুখে দিয়ে দেখবেন দাদা, সেই মিষ্টত্বই নেই! এগুলোতে রং আর গন্ধ আনার জন্য কেমিক্যাল মেশাচ্ছে। স্বাদটাই নেই।
বাঙালি পোস্তর বদলে হিং খাচ্ছে, খাঁটি ঘি নাকি মেলে না বহুদিন, গুড়ের বদলেও কি কেমিক্যাল খেতে হবে?
শিবরামের জীবনের প্রথম চুম্বন খাঁটি হয়েছিল খাঁটি নতুন গুড়ের দৌলতেই, কিন্তু কলকাতার মিষ্টির দোকানে নলেন গুড়ের সন্দেশ কি এল? আপাতত উত্তরের দোকানে নাকি গুড়ের সন্দেশ বারোমাস্যা। কিন্তু শীতের গুড় তো আর বারোমাস মিলবে না, তবে খাঁটি গুড়ের সন্দেশ কি মিলছে? আবারও তেমন বেজারমুখ কিছু খদ্দেরেরই দেখা পাওয়া গেল। গুড়ের রসগোল্লাও এখনও দেখা দিচ্ছে না হাঁড়ির ফাঁক দিয়ে। রসগোল্লার ক্ষেত্রে এ এক বাঁধাধরা বর্ণবাদ। রসগোল্লার রংয়েই তার গুড়ত্ব স্পষ্ট হয়। এখনও সেই রং না ধরলেও দোকানিরা আশ্বস্ত করছেন, শুভস্য শীঘ্রম।
গুড়ের খাঁটিত্ব বুঝতে গেলে রীতিমতো মিষ্টির কনোসিয়ের হতে হয়। 'চন্দ্রবিন্দু'-র অ্যালবামে তাঁর লেখা গান হোক, গদ্যের ভাঁজে হোক বা সিনেমার পর্দায়- অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় যে সুচারু মিষ্টিরসিক, তা বেশ বোঝা যায়। সুদূর জর্ডন থেকে ধরা দিলেন ফোনে। সখেদেই বললেন, 'যে জিনিস সিজনাল, অথচ পাওয়া যায় বারোমাস, তা আর খাঁটি থাকতে পারে না। গুড়ের অবস্থাও হয়েছে তাই, ফলে তার স্বাদও হয়ে উঠেছে নেহাত অসময়ে পাওয়া কমলালেবুর মতো। গুড় যেভাবে পাওয়া যেত, খেজুর গুড় যেভাবে সংগ্রহ করা হত, তার ধারা বদলে গেছে সম্পূর্ণ! ফলে শীতের গুড় আর সেই স্বাদে ধরা দেয় না। নকুড় বা ভীমনাগের মতো মিষ্টির দোকানে গুড় আসত কালীপুজোর পর, সেটাই দস্তুর। আমি যেহেতু মিষ্টি ভালবাসি দস্তুরমতো, আমি খোঁজ নিয়েছি, এল কিনা গুড়ের মিষ্টি। এবারে যা দেখলাম, এখনও চালু হয়নি। গুড়ের জোগানে যে গুরুতর সমস্যা হয়েছে, এই তার প্রমাণ। আমি এখন কলকাতার বাইরে। শীতের সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয়ই গুড় এসেছে, ফিরে গিয়ে তার দেখা পাব, এই আশা করি।'
আরও পড়ুন : শীতের আমেজ আর খেজুর গুড়ের যুগলবন্দি খাদ্য-বেরসিকের মনেও পুলক ধরায়
বাঙালির শীতের সঙ্গে ক্রিসমাসের ক্যারল জড়িয়ে, অঞ্জন দত্তর গান জড়িয়ে, পার্ক স্ট্রিটের মোচ্ছব জড়িয়ে। বাঙালি চিরকালই আন্তর্জাতিক, তাকে ঠেকায় কে! এবারে আবার ভরা শীতে বিশ্বকাপ। মরশুমি এই আবহটা নেহাত মন্দ লাগছে না। কিন্তু গুড়ের মতো খাঁটি বাঙালি শীতের মাপক বোধহয় আবহাওয়া দফতরের কাছেও নেই। কিন্তু এই মিষ্টি পাতে আসার নেপথ্যে রয়েছেন বাংলার শিউলি-রা, আখচাষিরা। তাদের খবর কলকাতার নাগরিক মন বিশেষ রাখে না, আখচাষিদের নিয়ে গদ্যকার সৈকত রক্ষিতের গল্প যে গুটিকয় মানুষ পড়েছেন, তাঁরা ছাড়া। কিন্তু কলকাতায় নতুন গুড়ের খবর আসে বেশ সোচ্চারেই, পাটালি হাতে নিলেই তা ভেঙে যাচ্ছে কি না, তাও পরখ করার ব্যাপার থাকে এই সময়। শক্ত পাটালি রাতের মধুরেণ সমাপয়েৎ-এ মোটেও তেমন সুখ দেয় না।
যে জিনিস সিজনাল, অথচ পাওয়া যায় বারোমাস, তা আর খাঁটি থাকতে পারে না। গুড়ের অবস্থাও হয়েছে তাই, ফলে তার স্বাদও হয়ে উঠেছে নেহাত অসময়ে পাওয়া কমলালেবুর মতো।
কলকাতার এই গুড়-সংস্কৃতিতে বালি যেন না পড়ে, তা দেখার বিষয় বইকি। গুড়চাষের কিসসার কথা বললে, সাহিত্য-অনুরাগী অনেক বাঙালিরই হয়তো ঝট করে মনে পড়তে পারে নরেন্দ্রনাথ মিত্রর 'রস' গল্পটি। খেজুর গুড়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া মানুষী সম্পর্কের জটিল টানাপোড়েন, যৌন ঈর্ষার ওঠানামা যেমন নোনতা, তেমন নোনতা স্বাদ গুড়ে না-মেলাই মঙ্গলের। কড়াইশুঁটির কচুরির পাশাপাশি পাতে গুড় গড়াগড়ি খাবে না, গুড়ের গূঢ় রহস্যে ডুবিয়ে খাওয়া যাবে না রুটির টুকরো, এতে কি আর শীত জমে? তাই অবশ্যম্ভাবীভাবে খাঁটি গুড়ের পিয়াসী হয়েই থাকবে কলকাতাবাসী। সঙ্গে সন্দেশ-রসগোল্লায় গুড়সন্ধানীও হবে তারা। কাজেই আসল হোক বা নকল, গুড়-পার্বণ এল বলে, নিঃসন্দেহে বলা যায়।