মঞ্চ নয়, রাস্তা দখল করে নাচ-গান-নাটক চলে ইউরোপের এই উৎসবে
নাটক, গানবাজনা বা ভেলকি যাই হোক, তা দেখানোর জন্য, শোনানোর জন্য দর্শক চাই, যে দর্শক রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়।
মঞ্চ থেকে নেমে আসছে, হল থেকে বেরিয়ে আসছে, আলো থেকে সরে যাচ্ছে শিল্পী, অভিনেতারা। নিতান্ত পোশাক আর যৎসামান্য সাজগোজে। নাটক, গানবাজনা বা ভেলকি যাই হোক, তা দেখানোর জন্য, শোনানোর জন্য দর্শক চাই, যে দর্শক রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। যে দর্শক টিকিটের চাপ নিতে পারে না, কিন্তু যে দর্শক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান যাদের কাছে সদাকাঙ্ক্ষিত। তাদের কাছে পৌঁছতে হবে, তাদের জন্য কাজ করতে হবে। এর আরেকটা সরাসরি দিক হলো, অর্থনৈতিক সমস্যা। তা হলো প্রযোজনার খরচ। দেখা গেল, থিয়েটার হল কিংবা এরিনা থিয়েটার ভাড়া করে অনুষ্ঠান করতে গেলে বিরাট আর্থিক সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। এই অবস্থাটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল এই শতকের গোড়ায় ইউরোপের আর্থিক মন্দার বাজারে। সেইসময় মূলধারার বাইরের কলাকুশলীদের সরকারি ভাতা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় কোনও কোনও দেশে।
এই যে বাইরে এল, খোলা আকাশের নিচে এল, অর্থনৈতিক কারণে এল, তার মানে এমনটি নয় যে, এমত গান ও নাটকের অনুষ্ঠানের এটাই সূত্রপাত। মঞ্চের বাইরে চাতালে, গাছতলায়, মিছিলে, মিটিং-এ গান ও নাটকের অনুষ্ঠানের একটা দীর্ঘ ধারাবাহিকতা আগে থেকেই ছিল। ছয়ের দশকেই রাজনৈতিক মুক্ত হাওয়ায় তার পালে বাতাস লেগেছিল। এবার সেখানে যুক্ত হলো প্রেক্ষাগৃহনির্ভর বেশ কিছু দল ও একক, মায় বিশিষ্ট ব্যক্তিসকল। পার্কে, স্কোয়ারে, জংশনে, কোনও বাড়ির চাতালে, ধ্বংসপ্রাপ্ত গির্জার সামনে-পিছনে, রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে পড়ে এই উদ্যোগ। বিশেষ করে বড় বড় শহরের বাইরে এই ধরনের পারফরম্যান্সের একটা জনপ্রিয়তা তৈরি হতে থাকে ক্রমশ।
গত পনেরো-ষোলো বছর ধরে লাগাতার ইউরোপের নানা দেশ ঘুরে লক্ষ করেছি, এই যে বিচ্ছিন্ন, ইতস্তত ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা শিল্পী-কলাকুশলীরা, যারা মঞ্চের বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তাদের একত্র করে ফি-বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের উৎসব। বড়-ছোট-মাঝারি নানা উৎসব। সেখানে যেমন ইউরোপের শিল্পীরা থাকে, তেমনই আসে সুদূর আফ্রিকা ও এশিয়ার নানা দল। এই দলগুলি মূলত ভ্রাম্যমান। গ্রীষ্ম অবকাশে (সামার টাইম) যখন এই উৎসবগুলো শুরু হয়, তখন এই দলগুলো ঘুরে ঘুরে উপস্থিত হয় একটার পর একটা উৎসবে, যার যেমন যেখানে নিমন্ত্রণ থাকে। এই উৎসব বা মেলা কি কার্নিভালগুলো আয়োজিত হয় দারুণ সব প্রাকৃতিক পরিবেশে। কোথাও কোনও হিলকের মাথায়, কোথাও বা পাহাড়তলির ওপর একটা সমতল ভূখণ্ডে আবার কোথাও নদীর পারে, কি সমুদ্রসৈকতে কিংবা জঙ্গলের কোলে। এই পর্ব শেষ করব ভেরোলি ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রিট মিউজিক অ্যান্ড থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের অভিজ্ঞতা দিয়ে। এই ফেস্টিভ্যালে একাধিকবার উপস্থিত হয়েছি।
আরও পড়ুন: নিজের হাতে তৈরি দলই কোণঠাসা করে দিয়েছিল শম্ভু মিত্রকে
১৮ বছর আগে যখন এই উৎসব শুরু হয়েছিল, তখন স্ট্রিট থিয়েটার একটা আন্দোলনের চেহারা নিয়েছিল ইউরোপের দেশে দেশে। আজ ভেরোলি-র উৎসবে শুধু থিয়েটার নয়। এখানে আসছে গানবাজনার দল, অ্যাক্রোব্যাটস, ম্যাজিশিয়ান, জাগলার আর আগুনের ভেলকি দেখানোর দল। তার পরিধি বেড়েছে অনেকটাই। মধ্য ইতালির লাজিও প্রদেশে পাহাড়তলির গায়ে ঝুলে আছে ছবির মতো প্রাচীন এই শহর। রোম থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরত্বে। প্রায় বাইশ হাজারের কিছু বেশি লোক এখানে বাস করে। এখানকার আঞ্চলিক শহর প্রশাসন এই উৎসবের আয়োজন করে। সকাল সকাল উৎসব শুরু হয়ে যায়। একই সঙ্গে এগারোটি স্থানে নাটক ও গানের আসর বসে। দু'-একটা মাথা ঢাকা মঞ্চ থাকলেও পারফরমেন্সের জায়গাগুলো হলো বিভিন্ন রাস্তার মোড় কিংবা কোনও প্রাসাদোপম বাড়ির সামনের চাতাল অথবা কোনও প্রাচীন বৃক্ষের ছায়ে।
এই উৎসবের পরিচালক আলেকজান্দ্রো জিল্লি একজন নাট্য বিশেষজ্ঞ ও কবি। একসময় মঞ্চসফল বহু নাটকের পরিচালক জিল্লি এখন অল্টারনেটিভ পারফরম্যান্সের প্রাণপুরুষ। আমাকে শেষবেলায় বললেন, "কী বুঝছ? ছয় বছর আগে যখন তুমি প্রথম এসেছ, তার থেকে এই ফেস্টিভ্যাল বহরে অনেকটা বেড়েছে না? অন্যদিকে সরকারি টাকার ভালোরকম কাটছাঁট হয়েছে। কিন্তু মানুষ এই ইন্টারঅ্যাক্টিভ পারফরম্যান্সই বেশি পছন্দ করছে। একটা অন্ধকার ঘরে বসে একতরফা বকবক শুনতে রাজি নয় আজকের দর্শক। এই উৎসবের জনপ্রিয়তা আজ তাই-ই প্রমাণ করছে।"
সত্যিই ৭৫ বছর বয়স্ক তুখড় সংগঠক এই জিল্লির সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় নেই। এই উৎসব আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল। নাচে-গানে, দেহের ভাষায় মুখরিত দেড় হাজার বছরের এই পাহাড়তলির ছোট্ট শহর ভেরোলি। রোমানদের পত্তন করা এই শহর। সেই সময়কার স্থাপত্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। ইউরোপ ও আফ্রিকার পারফরম্যান্সের শ্রীক্ষেত্র এই নাট্য ও গানের মেলা। দারুণ ব্যবস্থাপনা। মাত্র জনাছয়েক মানুষের সারা বছরের পরিশ্রম।
আবারও বলি, জিল্লির মতো সংগঠক না থাকলে এমন অভূতপূর্ব উৎসব সংগঠিত করা অসম্ভব। তথাপি জিল্লির বক্তব্য, "নোবডি ইজ ইনডিস্পেন্সিবল।" অনেকটা সময় কাটিয়েছি ওঁর সঙ্গে। আবার পরের বছরের অপেক্ষা। সেবার উপস্থিত ছিল সব মিলিয়ে ৩২টা দল। কোনও দলে ১৫/২০ তো কেউ দল বেঁধেছে স্বামী-স্ত্রীতে, কোনও পারফরমার আবার একাই একশো। শুধু ভেরলি নয়, আশপাশের বিভিন্ন শহর থেকেও হাজার হাজার মানুষ দেখতে আসে এই ফেস্টিভ্যাল। একথাও চুপিসারে বলে রাখি, এই বিরাট আয়োজন পাঁচদিন ধরে দেখতে দেখতে মনে হয়েছে যে মানুষ আলোচনা, সমালোচনা, সংলাপের ঝড় আর প্রতিবাদের ভাষাকে তেমন আমল দিচ্ছে না।
বরং সেইসব জায়গাতেই ভিড় হচ্ছে যেখানে শরীরের ভেলকি আর হাস্যরসাত্মক অনুষ্ঠান চলছে। বিশ্বজুড়েই কি তাহলে প্রমোদে ঢেলে দেওয়া মন? মানুষ এমন অনুষ্ঠানই দেখছে, যা শেষ হলেই ভুলে যাওয়া যায়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কী আর করা!
পৃথিবীর এখন গভীরতম অসুখ যে...