বাপের আবেগ বর্তায় ছেলের উপরে! ফুটবল আসলে যুদ্ধের পরম্পরা?

World Cup Football 2022: জয়ী দলের সমর্থকেরা ততক্ষণে পরাজিতের আপাত-দুর্ভেদ্য রক্ষণে ঢুকে পড়ে মহাকাব্যের এগারোজন নায়ককে কাঁধে তুলে নেয়। এই মহান কৃতিত্ব অনেক ঘাম, অশ্রু, রক্তপাতের সাক্ষী।

বিশেষজ্ঞ

খেলা শুরু আগেই সাংবাদিকেরা বেমক্কা প্রশ্ন করে বিরক্তি বাড়ায় : "আজ জিতছেন তো?" তাঁরা পালটা উত্তরও পায় চিত্তাকর্ষক : "জেতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব"।

পরবর্তীকালে রেডিও-টিভির লোকেরা খবরের কাগজের সাংবাদিকের জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। টিভির ধারাভাষ্যকারেরা দৃশ্যকে অনুসরণ করেন মাত্র, কেননা ওরা মাথা খুঁড়ে মরলেও চলমান দৃশ্যমালার সঙ্গে লড়ে জিততে পারবে না। অন্যদিকে রেডিওর ধারাভাষ্যকারদের কাপুরুষতা তুলনায় খানিক কম। একাজের রথী-মহারথীরা, যারা রহস্যের জাল বোনায় তুমুল পারদর্শী, তারা খেলোয়াড়ের চেয়েও বেশি দৌড়য়, বলের চেয়ে বেশি পিছলে-পিছলে যায়। মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো গতিতে তারা যে ধারাভাষ্য দেয়, খেয়াল করলে দেখবেন, তার সঙ্গে আপনার সামনে যে খেলাটা চলছে তার সামান্যই মিল। শব্দের ওই জলপ্রপাতে যে শটটা না কী আকাশছোঁয়া, সেটা হয়তো দেখবেন ক্রসবার ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। ওদিকে যখন শুনছেন গোলের জালে গা জড়িয়ে একটি মাকড়সা এদিকের বার পোস্ট থেকে ওই দিকের বার পোস্ট পর্যন্ত পরম নিশ্চিন্তে নকশা বুনছে আর গোলকিপার ক্লান্তিতে হাই তুলছে, তখন হয়তো দেখবেন দলটা হঠাৎ করে গোল খাবার মতো অবস্থায় পড়ে গেছে।

বিশাল স্টেডিয়ামে একটা উজ্জ্বল দিন কেটে যাওয়ার পর, সন্ধেবেলা শুরু হয় সমালোচকদের খেলা। ইতিমধ্যেই তারা বহুবার খেলোয়াড়দের খুঁত ধরতে চেয়ে ধারাবিবরণীও প্রায় থামিয়ে দিয়েছে কী করণীয় বুঝিয়ে ছাড়বে বলে মরিয়া তারা। ভাগ্যিস খেলোয়াড়েরা সেসব কথা শুনতেও পায় না। তাদের যত মনোযোগ তখন ভুল করায়। এইসব তত্ত্বকথা, ৩-২-২-৩ ফর্মেশনের ডব্লিউ-এম ছক ভালো, না কি এম-ডব্লিউ আসলে দুটো যে একই বস্তু, কেবল উলটো দিক থেকে দেখা, সেটা কে বোঝে আর কাকে বোঝায়! বিশেষজ্ঞরা যে ভাষা ব্যবহার করে তা বিজ্ঞানসম্মত ধারণাকে যুদ্ধের দামামা আর তুরীয় কবিতার ভাষা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা। ওরা সবসময় বহুবচনে কথা বলে। দুনিয়ায় বিশেষজ্ঞের সংখ্যাই যে বেশি সেটা নিশ্চয় আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে না।

আরও পড়ুন- দর্শক তো তার মুণ্ডু চায়, যন্ত্রণার বিনিময়ে কী পায় রেফারি?

ফুটবলের চিকিৎসকদের দুর্বোধ্য ভাষা

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা আগে আপনাদের কাছে সূত্রাকারে বলি আজ বিকেলে য়ুনিদোস ভেনসেরেমোস ফুটবল ক্লাবের মাঠে যেরকম কৌশলগত, প্রায়োগিক এবং শারীরিক সমস্যা দেখা গেল তার প্রাথমিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা কখনই অতিসরলীকরণের দিকে হাঁটব না। সেটা এক্ষেত্রে ভীষণই বেমানান হবে। কোনও সন্দেহই নেই, এব্যাপারে আমাদের আরও গভীর ও বিশদে পর্যালোচনা করা উচিত। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে যতটা অস্পষ্টতা আর সংকট আছে তা নিরসন করা দরকার। নইলে ক্রীড়ামোদী জনতার জন্য আমাদের জীবনভরের সাধনা নেহাতই লোকদেখানো বলে প্রতিপন্ন হবে।

হোম টিমের এমন জঘন্য খেলার দায় শুধুমাত্র খেলোয়াড়দের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমরা নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতেই পারি, কিন্তু তারা আজকের খেলায় যতবার বল ধরেছে ততবার তাদের ঢিমেতালা গতি সত্যিই ব্যাখ্যার অতীত। উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী, অনুগ্রহ করে আমার কথা মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন, এই অতিরিক্ত শ্লথতাকে সাধারণীকৃত ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনও ভাবেই অনৈতিক সমালোচনা করা চলে না। না, না, কখনই না। গড্ডলিকা প্রবাহে আমরা গা এলিয়ে দিতে পারি না। আপনারা যারা আমাদের কাজ দীর্ঘ দিন ধরে দেখে আসছেন তারা নিশ্চয়ই একথা বুঝবেন। এটা শুধু যে আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য তা নয়, এমনকী আন্তর্জাতিক স্তরে কিংবা বিশ্বজুড়ে চালু কোনও খেলার ক্ষেত্রেও, যেখানেই আমাদের ডাকা হয়েছে আমরা গভীর অভিনিবেশে কাজ করে এসেছি। তাই, আমাদের কাজের ধারা অনুযায়ী, আমার প্রতিটি জিনিস বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করব: খেলার কৌশলগত দিকের সম্ভাব্য জৈবিক কার্যকারিতা যে আজকে আমাদের দলের খেলায় একেবারেই ফুটে ওঠেনি, তার সবথেকে সরলসিধে প্রমাণ শুধু তাদের অসহায় আত্মসমর্পণই নয়, তারা বিপক্ষের গোল লক্ষ্য করে আদৌ প্রত্যাশা অনুযায়ী আক্রমণ শানাতে পারেনি। আমরা এই কথাগুলো গত শনিবারও বলেছিলাম, আজ আবারও মাথা উঁচু করে কোনও রকম জড়তা ছাড়াই একই কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ আমরা চিরকাল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলে এসেছি। যাই ঘটে যাক আমরা সত্যিটা তুলে ধরবই। তার জন্য কষ্ট হবে, অনেকটা বদল সইতে হবে, হয়তো অনেক মূল্যও চোকাতে হবে। তবু সত্যিটা বলতেই হবে।

যুদ্ধের মাতন

ফুটবলের সঙ্গে যুদ্ধের শাস্ত্রাচারের ভীষণ মিল। মাঠের মাঝে হাফপ্যান্ট পরে এগারো জন খেলোয়াড় আসলে পাড়া-পড়শি, শহর কিংবা দেশের নির্ভরযোগ্য খাপ-খোলা তলোয়ার বিশেষ। ফুটবলের যোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্রের ঝনঝনানি ছাড়াই, সুরক্ষা-প্রতিরক্ষার বর্ম ছাড়াই ভিড়ের ভূত ভাগিয়ে ছাড়ে এবং বারবার নিজের পক্ষে মানুষের আস্থা ফেরায়: যখনই দু'পক্ষ মুখোমুখি হয়, প্রাচীন ঘৃণা ও ভালোবাসার যত পদাবলী বংশপরম্পরায় হস্তান্তরিত হয়। বাপের আবেগ বর্তায় ছেলের ওপরে, নইলে প্রতিরোধে বুক টান করে দাঁড়াবে কেমন করে!

স্টেডিয়ামের চতুর্দিকের মিনার-পতাকা-ব্যানার মিলেমিশে যেন কেল্লার আবহাওয়া। সামনেই মাঠের চারধারে গভীর ও বিস্তৃত পরিখা। মধ্যিখানে ঘাসের বুকে লম্বা দুধসাদা রেখাটি বিতর্কিত ভূখণ্ডের সীমানা নির্দেশ করে। মাঠের দু'প্রান্তে সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটো গোলপোস্ট, কখন গোলার বেগে বল এসে উড়িয়ে নিয়ে যাবে এই আশঙ্কায়। আর গোলের ঠিক সামনের অংশটা ‘বিপজ্জনক এলাকা’।
খেলার শুরুতে মাঠের একেবারে মাঝেখানে এঁকে রাখা বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে দুই অধিনায়ক ছোট্ট ছোট্ট দলীয় পতাকা বিনিময় করে, প্রচলিত সৌজন্যের দাবিতে হাতও মেলায়। তারপর যেই বেজে ওঠে রেফারির বাঁশি, ঘূর্ণি বাতাসের টানে সাদা বলটা উড়াল দেয়। সামনে পিছনে পেন্ডুলামের মতো যায় আসে। কোনও খেলোয়াড় সেই মোহময়ীর জন্য ফাঁদ পাতে, তাকে সামনে বসিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে ঘুরে আসে এক চক্কর যতক্ষণ না উলটো দিক থেকে কেউ এসে বেদম কড়া ট্যাকল করে, আর সে হাত পা ছড়িয়ে মাঠের ওপর পড়ে। শিকার তক্ষুনি উঠে দাঁড়ায় না। সুবিশাল ঘাসের বিছানায় উপুড় হয়ে থাকে। এদিকে বিপুল সংখ্যক দর্শক মুহুর্মুহু বজ্রপাতের মতো গর্জে ওঠে। শত্রুপক্ষের সমর্থকেরা সুবচন উগড়ে দেয়:

"আবে ! ওকে মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দে"।

"মার, মার, মার শালাকে"।

যুদ্ধের ভাষ্য

চট করে খেলার চাল পালটে নিয়ে সময়োপযোগী বিকল্প কৌশলে আমাদের দল যখন হঠাৎ আক্রমণে ঝাঁপায়, প্রতিপক্ষ তখনও অপ্রস্তুত। নিষ্ঠুর সে তীব্র আক্রমণ। হোম টিম যখন শত্রুপক্ষের এলাকায় হানা দেয়, প্রাচীনকালে দুর্গপ্রাকার ভাঙার জন্য ব্যবহার করা ধাতব মুণ্ডুওলা শালবল্লার ভারী অস্ত্রের মতো আঘাতে আঘাতে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ফাটল ধরিয়ে বিপজ্জনক এলাকায় অনুপ্রবেশ করে। সামনে থাকা গোলন্দাজ অসামান্য শৈলীতে পায়ে গোলা নিয়ে দ্রুত শট নেবার মতো জায়গায় পৌঁছে যায়, মারণ অস্ত্রে শান দিয়ে আক্রমণকে পরিপূর্ণতা দেয় বিদ্যুদ্বেগের শটে। প্রতিপক্ষের রক্ষণ ততক্ষণে ধূলিসাৎ। পরাজিত সেনাপতি আর কেল্লার দায়িত্বে থাকা যেসব পাইক-বরকন্দাজকে এতক্ষণ মনে হচ্ছিল অপরাজেয়, তারা সব দু'হাতে মুখ ঢেকে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। ওদিকে ঘাতক বাহিনী তখন বাজপাখির মতো দু'দিকে ডানা মেলে দৌড় দিয়েছে উল্লসিত দর্শকের দিকে।

প্রতিপক্ষ কিন্তু পালায় না। তবে তাদের ছত্রভঙ্গ দশা হোম টিমের পরিখায় আর ত্রাস সঞ্চার করতে পারে না। তবু তারা বারবার আমাদের সুসজ্জিত রক্ষণের দেওয়ালে মাথা ঠোকে। যেন ভেজা বারুদ ঠুসে বন্দুক চালায়, আমাদের বাহিনীর শৌর্যের সামনে তাদের আক্রমণ একেবারে নির্বিষ ঠেকে। লড়াইতে আমাদের দু'জন যখন আহত হয়ে মাঠ ছাড়ে, সমর্থকেরা প্রতিপক্ষের যাবজ্জীবন চায়। কিন্তু যুদ্ধে এমন নৃশংসতায় কাতর হলে চলে না। অবিশ্যি ফুটবলের ভদ্রলোকি নিয়মকানুনের পক্ষে তা ভালো বিজ্ঞাপন নয়। তবু খেলা চলতেই থাকে।
শেষমেশ বধির ও অন্ধ রেফারি যখন লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘোষণা করে, তীব্র বাঁশির আওয়াজ পরাজিত দলকে শেষ বিচারের বাণী শুনিয়ে দেয়। জয়ী দলের সমর্থকেরা ততক্ষণে পরাজিতের আপাত-দুর্ভেদ্য রক্ষণে ঢুকে পড়ে মহাকাব্যের এগারোজন নায়ককে কাঁধে তুলে নেয়। এই মহান কৃতিত্ব অনেক ঘাম, অশ্রু, রক্তপাতের সাক্ষী। আমাদের দলের অধিনায়ক পিতৃভূমির পবিত্র পতাকা গায়ে জড়িয়ে দু'হাতে ট্রফি তুলে ধরে। রুপোর কাপে চুমু খায়, সে বড় দ্যুতিময় চুম্বন!

আরও পড়ুন- ফুটবলে নায়কের জেল্লা বেশিদিন থাকে না

স্টেডিয়াম

কখনও ফাঁকা স্টেডিয়ামে ঢুকেছেন? একবার চেষ্টা করে দেখুন না। মাঠের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ান আর চুপটি করে শুনুন। দুনিয়ায় ফাঁকা স্টেডিয়ামের থেকে বেশি শূন্যতা আর কোথাও অনুভব করবেন না। জনশূন্য গ্যালারির থেকে নিঃশব্দ আর কিছুর অস্তিত্ব নেই।
ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে, ১৯৬৬-র বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের জয়ে সমর্থকের উল্লাসের আওয়াজ আজও প্রতিধ্বনিত হয়। যদি খুব মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করেন তাহলে ১৯৫৩-র গোঙানির আওয়াজও পাবেন, যেবার ইংল্যান্ড হাঙ্গেরির কাছে পর্যুদস্ত হল। মন্তেভিদেয়োর সেন্তেনারিও স্টেডিয়াম সেই কবে থেকে ফুটবলে উরুগুয়ের সোনালি দিনের কথা ভেবে স্মৃতিকাতর হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলেছে। মারাকানা স্টেডিয়াম ১৯৫০-এর বিশ্বকাপে ব্রাজিলের পরাজয়ের শোক এতদিনেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বুয়েনস আইরেসের বোমবোনেরা স্টেডিয়ামে এখনও পঞ্চাশ বছর আগেকার ঢোল পেটানোর আওয়াজ শোনা যায়। অ্যাস্তেকা স্টেডিয়ামের বুকের মাঝখান থেকে মেহিকোর প্রাচীন ক্রীড়ার আচার মেনে স্তবগানের সুর ভেসে আসে। বার্সেলোনার কাম্প নৌ-এর কংক্রিটের গ্যালারিগুলো কাতালানে কথা বলে ওঠে। বিলবাওয়ের সান মেমেস বাঙ্ময় হয় ইস্কারা বুলিতে। ইতালির মিলানে এখনও জুসেপ্পে মেয়াত্‌জার আত্মা গোল করেই চলে আর নিজের নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৭৪-এর বিশ্বকাপের ফাইনাল, জার্মানি যে ম্যাচটা জিতেছিল, তা দিনের পরে দিন রাতের পর রাত ধরে মিউনিখের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে চলতেই থাকে। সৌদি আরবের রাজা ফাহাদ স্টেডিয়াম মার্বেলে মোড়া, ওখানে বসার জন্য স্বর্ণখচিত বক্সের আয়োজন, মেঝে আগাগোড়া দামি কার্পেটে মোড়া। কিন্তু সে বড়োই কাঙাল, তার কোনও স্মৃতি নেই, তাই বলার মতো কোনও গল্পও নেই।

 

More Articles