পেশাদার ফুটবলে খেলোয়াড় 'দাস', জেতা ছাড়া তার কাছে অন‍্য বিকল্প নেই

Football: সত্যিই যখন খেলা ভালো হয়, আমি সেই অলৌকিক ঘটনার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই।

লেখকের স্বীকারোক্তি
উরুগুয়ের সব বাচ্চাদের মতো আমিও ফুটবলার হতে চেয়েছিলাম। খেলেছিও বেশ! সত্যি বলতে কী, আমি অসাধারণ খেলতাম, কিন্তু সে কেবল রাতে ঘুমের মধ্যে! দিনের বেলা যখন আমাদের দেশের ছোট ছোট মাঠগুলোয় খেলতে নামতাম, আমার পা দুটো কাঠের মতো শক্ত হয়ে থাকত।

খেলার ভক্ত হিসেবেও আমি খুব বেশি নম্বর পাব না। হুয়ান অ্যালবের্তো স্ক্যাফিনো আর হুলিয়ো সিজার আবাদি খেলত পেনারলের হয়ে, আমার শত্রুপক্ষ। আমি ছিলাম নাসিওনালের ভক্ত। পেনারলকে আমার সর্বস্ব দিয়ে ঘৃণা করতাম। কিন্তু ‘এল পেপে’ স্ক্যাফিনো অনবদ্য সব পাস দিয়ে নিজের দলের খেলা অর্কেস্ট্রার সুরে বেঁধে দিত, যেন সে স্টেডিয়ামের সবচেয়ে উঁচু মিনারে বসে সবটা দেখছিল। আর ‘এল পারদো’ আবাদি যেন লোককথার সেই একবারে সাত লিগ করে পা-ফেলার বুট পরে দৌড়ত, সাদা টাচলাইনের আগে পর্যন্ত বল গড়িয়ে নিয়ে যেত, দোলনার মতো মাঠের মধ্যে সামনে পিছনে ছুটে বেড়াত, বল কিংবা প্রতিপক্ষ কাউকেই পরোয়া করত না। এদের তারিফ না করে কোনও উপায় ছিল না যে! কখনও কখনও ওদের নামে চেঁচাতেও ইচ্ছে করত।

সময় বয়ে গেছে, শেষমেশ এখন আমি নিজের স্বাতন্ত্র মেনে নিতে শিখেছি: আমি ভালো ফুটবলের কাঙাল। আমি দু'-বাহু প্রসারিত করে দুনিয়ার সামনে যাই এবং নানান স্টেডিয়ামে গিয়ে মিনতি করি: ‘ঈশ্বরের দোহাই, যেন ভালো খেলা হয়’।

আর সত্যিই যখন খেলা ভালো হয়, আমি সেই অলৌকিক ঘটনার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই, তা সে-খেলা যে দল বা দেশই খেলুক না কেন।      

ফুটবল
ফুটবলের ইতিহাস বস্তুত মাধুর্য থেকে কর্তব্যের দিকে চলে যাওয়ার করুণ কাহিনি। খেলাটা যেদিন থেকে পয়সা কামানোর কারখানা হয়ে গেল, খেলার আনন্দ থেকে ফুটে ওঠা লাবণ্য যেন একেবারে মূল থেকে ছিঁড়ে গেছে। আমাদের এই শতাব্দীর ফেলো কড়ি মাখো তেলের দুনিয়ায়, পেশাদারি ফুটবলে যা কিছু অপ্রয়োজনীয়, তাকেই বাতিল জঞ্জাল জ্ঞান করা হয়, এক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় মানে, যা লাভজনক নয়।

বেলুন হাতে নিয়ে খেলার সময়ে মনের মধ্যে যে আশ্চর্য অনুভূতি আমাদের ছেলেবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় তা থেকে কী-ই বা রোজগার সম্ভব! একটা বেড়াল যেমন সুতোর গোলা নিয়ে খেলে। কোনও ব্যালেরিনা যেমন বেলুন কিংবা সুতোর গোলার মতো প্রায় ভারহীন একটি বল নিয়ে শূন্যে ভাসে। খেলছি এমনটা না-ভেবেই খেলে যাওয়া, কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই। কোনও ঘড়ি বা রেফারি ছাড়াই।

কিন্তু খেলাটা ইদানীং একটা চোখধাঁধানো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামান্য কয়েকজন মুখ্য কুশীলব আর বিপুল-সংখ্যক দর্শক, এই হলো দেখার খেলা। আর এই চোখধাঁধানো খেলা পৃথিবীর সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসাও। যার মূল লক্ষ্য খেলাটাকে উদ্‌যাপন করা নয়, বরং খেলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। পেশাদারি খেলার দুনিয়ার মাতব্বররা ফুটবলের আনন্দকে দূরে ছুড়ে ফেলে, কল্পনাশক্তিকে খুন করে, স্পর্ধাকে হঠিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎগতির, নির্বোধ জানোয়ারের মতো নিছক শক্তি প্রদর্শনের ফুটবল খেলা প্রতিষ্ঠা করেছে।

সৌভাগ্যক্রমে, মাঠে গেলে এখনও দেখতে পাবেন, যদিও কালেভদ্রে, কিছু উদ্ধত হতভাগা যাবতীয় চিত্রনাট্য একপাশে সরিয়ে রেখে, ড্রিবল করে উল্টোদিকের গোটা দলটাকে কাটিয়ে-কাটিয়ে, রেফারিকেও কাটিয়ে, মাঠের ধারে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দর্শকদেরও কাটিয়ে, নিষিদ্ধ অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ বুকে জড়িয়ে নিয়ে জৈবিক সুখ পায়।    

খেলোয়াড়
উইং ধরে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়চ্ছে। একদিকে অপেক্ষা করছে স্বর্গীয় গরিমা; অন্যদিকে, ধ্বংসের রসাতল। ছেলেটি পড়শির ঈর্ষা: পেশাদার খেলোয়াড়। সে কারখানা কিংবা অফিস থেকে পালায়, আর ফুর্তিতে সময় কাটাবে বলে পয়সা পায়। তার কপালে লটারি লেগে গেছে। যদিও তাকে বালতি বালতি ঘাম ঝরাতে হয়, হারার বা ক্লান্ত হওয়ার অধিকারটুকুও থাকে না। কিন্তু খবরের কাগজে তার ছবি ছাপা হয়, টিভিতেও দেখায় তাকে, রেডিয়োয় নাম শোনা যায়। মেয়েরা তার নামে মূর্চ্ছা যায়, বাচ্চারা তার মতো হতে চেয়ে আকুল হয়। সেও কিন্তু একদিন নেহাতই আনন্দ পেতে বস্তির নোংরা রাস্তায় খেলা শুরু করেছিল। কিন্তু এখন বেচারা কর্তব্যের তাগিদে স্টেডিয়ামে স্টেডিয়ামে খেলে বেড়ায়। যেখানে ক্রমাগত জেতা ছাড়া তার কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই।

ব্যবসাদাররা তাকে কিনে নেয়, বিক্রি করে, ভাড়া খাটায়। আর সে সবটাই হতে দেয়, কেননা এর বদলে সে আরও নাম, আরও টাকার প্রতিশ্রুতি পায়। যত সফল হবে, তত বেশি টাকা রোজগার করবে। এই করতে করতে সে কয়েদির মতো হয়ে যায়। দৈনন্দিন জীবনে তাকে প্রায় ফৌজি অনুশাসন মেনে চলতে হয়। সঙ্গে আছে রোজের অনুশীলনের শাস্তি ভোগ করা এবং কর্টিজোন আর পেনকিলারের বোমাবর্ষণ সামলে ব্যথা কমিয়ে নিজের শরীরকেই বোকা বানানো। আবার বড় ম্যাচের আগে নিজেকে বন্দিশিবিরে অবরুদ্ধ করে ফেলে বাধ্যতামূলক পরিশ্রম করতে হয়, খেতে হয় বিস্বাদ খাবার, জল খেয়ে নেশা মিটিয়ে রাতে শুতে হয় নিঃসঙ্গ শয্যায়।

দাসপ্রথার প্রচলিত কানুনে মুক্তি আসে বার্ধক‍্যর হাত ধরে। কিন্তু একজন ফুটবলার বুড়ো হয়ে যেতে পারে তিরিশ বছরেই। তাদের পেশিগুলো কম বয়সেই হা-ক্লান্ত হয়ে পড়ে: ‘মাঠ ঢালু না হলে লোকটা গোল করতেই পারবে না।'

‘ওই লোকটা ! আরে গোলকিপারের হাতদুটো বেঁধে রাখলেও গোল করতে পারবে না।’

কিংবা তিরিশের আগেই যদি বলের তেমন ধাক্কা খায়, ভাগ্যের পরিহাসে পেশি যায় ছিঁড়ে, অথবা লাথি খেয়ে হাড় ভাঙে আর সেটা জোড়া না যায়! একটা খারাপ দিনেই খেলোয়াড় বুঝে যায়, সে জীবনটা একটিই মাত্র তাসের ওপরে বাজি রেখে ফেলেছিল। তার অর্থ, যশ সবই যায়। খ্যাতি, চপল নারীর মতো চঞ্চল, যাওয়ার আগে ‘প্রিয়তম’ বলে একখানা চিঠিও লিখে রেখে যায় না।    

গোলকিপার
ওরা তাকে দারোয়ান বলে, কিপার, গোলি, বাউন্সার কিংবা জালের কারবারিও বলে। কিন্তু তাকে অক্লেশে শহিদ বলা চলে। যে সবটা দেবে আর তারপরে অনুতাপে ভুগবে, অথবা ঘুষি মারার বালির বস্তা। ওরা বলে সে যেখানে হাঁটে সেখানে কখনও ঘাস গজায় না।

সে একা, দূরে দাঁড়িয়ে ম্যাচ দেখে বলে ধিক্কৃত। কখনও গোল ছেড়ে নড়ে না, তার একমাত্র সঙ্গী দু'-খানি গোলপোস্ট আর ক্রসবার। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে নিজেরই মৃত্যুপরোয়ানা হাতে নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে। রেফারির মতোই সে সাধারণত কালো পোশাক পরে। ইদানীং অবিশ্যি রেফারিকে কাকের মতো সাজতে হয় না, গোলকিপারও নিজের একাকিত্বে রঙিন পোশাক পরে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে।

সে গোল করে না; বরং গোল হওয়া আটকায়। কিন্তু ফুটবলের উৎসব হলো গোল করা: স্ট্রাইকার আনন্দের ফুলকি ছোটায়, গোলকিপার ভেজা কম্বলে সে স্ফুলিঙ্গ নিবিয়ে দেয়।

তার জার্সির পিঠে লেখা এক নম্বর। প্রথম কি তাকেই টাকা দেওয়া হয়? না, ওকেই প্রথম মূল্য চোকাতে হয়। গোলকিপার বেচারা একেবারে নন্দ ঘোষ, তার ভুল না থাকলেও তাকেই দোষী ঠাওরানো হয়। কোনও খেলোয়াড় ফাউল করলে গোলকিপারকে তার ঠেলা সামলাতে হয়। প্রকাণ্ড জালের সামনে তাকে একা জল্লাদের মুখে ছেড়ে দেওয়া হয়। যে বিকেলে দল খারাপ খেলে, সেদিনের আড্ডায় খাদ্য-পানীয়র যাবতীয় বিল তাকেই মেটাতে হয়। অন্যের পাপে তাকে অপেক্ষা করতে হয় উড়ন্ত বলের বৃষ্টির সামনে।

অন্য খেলোয়াড়রা কখনও-সখনও বা প্রায়শই বল উড়িয়ে দেয়, তারপর ফের নিজেদের গুটিয়ে আনে নয়নাভিরাম কোনও ড্রিবলে, বা অসামান্য একটা পাসে, চমৎকার ভলিতে। সে পারে না। দর্শকও কখনও গোলকিপারকে ক্ষমা করে না। সে কি অনুমানে ভুল করে গোল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল? হাস্যকর রকমের একা হয়ে গিয়েছিল? বল কি পিছলে যাচ্ছিল? তার ইস্পাতের মতো আঙুলগুলো কি আঠায় জড়িয়ে যাচ্ছিল? গোলকিপারের একটা ভুলে গোটা ম্যাচের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে, দল চ্যাম্পিয়নশিপ হেরে যেতে পারে। ভক্তরা তখন গোলকিপারের যাবতীয় গুণপনা ভুলে চিরকালীন অসম্মানের ঝুলি খুলে তার বাপান্ত করে। সেই অসম্মানের নরকযন্ত্রণা তাকে জীবনভর বইতে হয়।  

More Articles