ফেসবুক-ইনস্টা নিষিদ্ধ, গুগলকে হুমকি–উত্তর কোরিয়ার পথেই হাঁটতে চলেছে রাশিয়া?

যুদ্ধের দামামা বেজেছে প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল। একদিকে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের সম্মুখে তাদের গতি যেমন শ্লথ হয়েছে, দিনের পর দিন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলাতেও রাশিয়া বিপর্যস্ত। অপরদিকে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে প্রতিরোধকে আরও জোরদার করে তুলেছে ব্রিটেইন, ফ্রান্সের মতো দেশগুলি। দেশের ভিতরেই যুদ্ধবিরোধী প্রবল প্রতিরোধ ছড়িয়ে পড়েছে রাশিয়ার। এইসব যাবতীয় সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ক্রমেই মরিয়া হয়ে উঠছে রাশিয়া। অন্তত সাম্প্রতিক সামাজিক মাধ্যমের তুমুল নিন্দা ও নিষিদ্ধ করার ঝোঁক সেই অনুমানকেই সমর্থন করছে। বাক স্বাধীনতা সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়ায় অত্যন্ত কম। বিরোধী পক্ষের স্বর চেপে দেওয়ার অভিযোগ বহুদিন থেকেই তাদের বিরুদ্ধে। আবার বিরোধী নেতাকে বিষপ্রয়োগে খুন করার অভিযোগও রয়েছে। রয়েছে জেলেন্সকি প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার অভিযোগও। বহুদিন ধরে আমেরিকার মতোই সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল রাশিয়ার। এইবার সেই অভিযোগ আরও জোরদার ভিত্তি পেল।

গত শুক্রবার রাশিয়া গুগলকে হুমকি দিয়েছে। তাদের বক্তব্য রাশিয়ার নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ঘৃণা ছড়াচ্ছে গুগল। অবিলম্বে তা বন্ধ না করলে গুগলকে ব্যান করবে রাশিয়া। রাশিয়ার বা রাশিয়ার বাইরে গুগলের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি। রাশিয়ার তরফে অভিযোগ হিসেবে জানানো হয়, গুগলের নানা বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত বেলারুশ এবং রাশিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা, রেলপথকে বন্ধ করার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। এবং অচিরেই তা বাস্তবে পরিণত হয়। এই ঘটনাই প্রমাণ করে আমেরিকার এই টেক-জায়েন্টটি কতটা রাশিয়া বিরোধী!  আরও বলা হয়, “ইউটিউবের কার্যকলাপ অবিকল সন্ত্রাসবাদীদের মতোই, রাশিয়ার নাগরিকদের জীবন ও স্বাস্থ্য–উভয় ক্ষেত্রেই তা ক্ষতিকর।”

আরও পড়ুন-ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা? ঠিক কী পরিমাণ পারমানবিক অস্ত্র মজুত করেছেন রাষ্ট্রনেতারা?

এই ধরনের ‘ভুয়ো প্রচার’ নিয়ে রাশিয়ার কর্মকর্তারা অত্যন্ত বিরক্ত। এবং মাধ্যম নিয়ন্ত্রক স্পষ্ট জানান বিশেষভাবে এই ধরনের ভিডিও সম্প্রচার এখনই বন্ধ করা দরকার গুগলের। প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যে রাশিয়ার রাষ্ট্র প্রযোজিত যাবতীয় মাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইউটিউব। ফলে, রাশিয়ার যোগাযোগ নিয়ন্ত্রক ও রাজনৈতিক নেতারা চাপ সৃষ্টি করে চলেছে ইউটিউবের উপর ক্রমাগত। মেটার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা নানা রাশিয়া বিরোধী পোস্ট করে চলেছেন। তাই নিয়েও অসন্তুষ্ট রাশিয়া। বিশেষত, ইউক্রেনের বাসিন্দাদের ‘রাশিয়ান আক্রমণকারীদের মৃত্যুকামনা করি’ জাতীয় পোস্ট মেটা করার অনুমতি দিচ্ছে এই ধরনের অভিযোগ আনছে তারা। মস্কো গত সপ্তাহেই ইন্সটাগ্রাম নিষিদ্ধ করেছে। রাশিয়ান মিডিয়ার উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করায় ফেসবুককেও ব্যান করেছে তারা।

ভিকনতাক্তে নামক একটি সাইট তৈরি করেছে রাশিয়া। এটিকে ফেসবুকের বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে। এবং গত ২৪ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকেই বেড়ে চলেছে এর ব্যবহার। ৩ লক্ষ ব্যবহারকারী বাড়িয়েছে যুদ্ধের মরশুমে সাইটটি। গত ১৪ মার্চ রাশিয়ায় ইন্সটাগ্রাম নিষিদ্ধ হলে ভিকনতাক্তের স্থানীয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৮.৭ শতাংশ। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যবহারকারীর নজির তৈরি করেছে সাইটটি। বর্তমানে পাঁচ কোটি মানুষ সাইটটি ব্যবহার করেন। গত নভেম্বরেই রাশিয়ার গ্যাজপ্রম মিডিয়া ‘ইয়াপ্পি’ নামে একটি ভিডিও-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম রিলিজ করেছে। যা টিকটিককে পাল্লা দিচ্ছে। রাশিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদওয়েদেও গত শুক্রবার বিদেশী সামাজিক মাধ্যমগুলির কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন। যদিও যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে মেটা এবং ইউটিউবের রাশিয়ার বাজারে ফেরার পথ খানিক খোলা থাকার আভাসই দিয়েছেন তিনি। “বাকস্বাধীনতার রক্ষকেরা রাশিয়ার সেনাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া গুরুতর খুনের হুমকিকেও ওই নামে চালাতে চাইছে।” —সম্প্রতি নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে লেখেন দিমিত্রি। তাঁর বয়ান অনুযায়ী নিজস্ব সামাজিক মাধ্যম গঠনের ক্ষমতা রাশিয়ার রয়েছে। পশ্চিমের একচ্ছত্র আধিপত্য আর চলতে দেওয়া যাবে না।

উপরে পরিবেশিত যাবতীয় তথ্য আমাদের একটা অনিবার্য ‘দেজা ভু’-এর দিকে ঠেলে দেয়। এই একই ঘটনাচক্র ইতিপূর্বেই দেখেছি আমরা। ২০১৬ সালে এই সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধ করা নিয়ে ব্যাপক ট্রোলের মুখে পড়তে হয় উত্তর কোরিয়াকে। এ কথাও ঠিক, বরাবরই পশ্চিমঘেঁষা সংবাদ মাধ্যম সাজিয়ে গুজিয়ে উত্তর কোরিয়াকে রম্য রচনা হিসেবে উপস্থাপিত করে এসেছে এ কথা যেমন সত্য তেমন বহু অবাস্তব খবরও প্রচার হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। গত বছরেও সাউথ কোরিয়ার মাধ্যম ব্যবহার নিয়ে নতুন আইন প্রণীত হয়েছে সেখানে। নাবালকেরা সে আইন লঙ্ঘন করলে তাদের অভিভাবকদের ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৬ সালেই সরকারিভাবে ঘোষণা করে ফেসবুক, ট্যুইটার, ইউটিউব ও সাউথ কোরিয়ান সাইট নিষিদ্ধ করেন কিম। ইন্টারনেট পরিষেবা উত্তর কোরিয়ায় খুব কম মানুষ ভোগ করেন। যেটুকু করা যায় তাও সরকারের অনুমতিসাপেক্ষ। বর্তমানে চাপের মুখে সেই একই পথেই যেন হাঁটছে রাশিয়া।

তবে বিকল্প বাজারের অনুসন্ধানও করছে তারা। এই ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার একটা বড় মাপের পার্থক্য রয়েছে। যদিও সামাজিক মাধ্যম ব্যান বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপই। ব্যান না করেও বিকল্প বাজারের মাধ্যমে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হওয়ার সুযোগ রাশিয়ার ছিল, কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতি এই ধরনের পদক্ষেপ নিতে উস্কানিই দিয়েছে রাশিয়াকে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এই বাকস্বাধীনতা কতটা পরিসর দেয় মানবতাকে, কতটা উত্তর কোরিয়ার দিকে ঝোঁকে, কতটা পশ্চিমী বাজারকে টেক্কা দিতে পারে বা কতটা নিজেরটুকু বাঁচিয়ে অপরকে ধ্বংস করার অপার অনুমতি দেয়—তা আখেরে সময়ই বলবে।

More Articles