ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক হাসিনার দেশে! ভারতকে কেন বর্জন করছে বাংলাদেশ?
Bangladesh Boycotts Indian Products: বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের একাংশ মনে করছে, আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করেছে ভারত সরকার।
ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক উঠেছে ওপার বাংলা থেকে। বাংলাদেশে গত বেশ কিছুদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ভারতীয় জিনিসপত্র বয়কট করার ডাক উঠেছিল। সোশ্যাল মিডিয়ার চৌহদ্দি ছেড়ে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক খাতে বাঁক বদলাচ্ছে এই বয়কটের আহ্বান। বাংলাদেশ ভারতের উপর নানা বিষয়েই নির্ভরশীল। বাংলাদেশে ব্যবহৃত বিবিধ পণ্যই ভারত থেকে আমদানি করা। তাহলে হঠাৎ এই বয়কটের ডাক কেন?
ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে বলে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই প্রচার করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ভারতীয় পণ্যের বদলে বাংলাদেশের বা অন্য দেশের পণ্য ব্যবহার করতে শুরু করেছেন তারা। রোজের ব্যবহারের যা কিছু ভারত থেকে আমদানি করা হয় সেগুলোর বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য ব্যবহারের ডাক দেওয়া হয়। এই পণ্যের মধ্যে সাবান, শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, টুথপেস্ট, বোতলের জল, জীবাণুনাশক, মশা মারার ধূপ থেকে শুরু করে গাড়ি বা মোটরসাইকেলের টায়ার, শিশুদের খাদ্যও রয়েছে।
ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে বাংলাদেশে ৯৭ ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে ভারত। যার বেশিরভাগটাই হচ্ছে তুলো, পোশাক তৈরির কাঁচামাল। এছাড়া আছে তেল ও অন্যান্য খনিজ জ্বালানি এবং খাদ্যশস্য। ভারত থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, সূর্যমুখী ও সয়াবিন তেলসহ ভোজ্য-তেল, চিনি, মধু, সফট ড্রিঙ্কস, চিপস, বিস্কুট, চকলেট ও ক্যান্ডি জাতীয় খাবারও আমদানি করা হয়।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশকে কোন পথে নিয়ে যাবেন শেখ হাসিনা?
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ধুয়ো তুলে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক আগেও উঠেছে। তবে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এ ধরনের আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে। গণঅধিকার পরিষদ নামে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মাইক হাতে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিতে দেখা যায়। গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টির মতো কয়েকটি দলের নেতা-কর্মীরা গত জানুয়ারি মাসে নির্বাচনের পর থেকে নানাভাবে ভারত-বিরোধী বক্তব্য পেশ করেছেন। বিরোধী দল বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতাও এই ভারতীয় পণ্য বিরোধী প্রচারের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। বিএনপি বলছে, বাংলাদেশে নির্বাচন হলেই ভারত অতি সক্রিয় হয়ে যায়। তাই বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি, ভোটদানের বঞ্চনা থেকেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী হাসান মাহমুদ অবশ্য বলছেন, ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারকে অস্থিতিশীল করে পণ্যের দাম বাড়ানো। ভারত থেকে প্রতি বছর ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্যে আমদানি করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করা হয়, সেই তালিকায় চিন আছে সবার আগে, তার পরেই ভারত।
তবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই প্রচারের ফলে খুব যে প্রভাব পড়েছে তাও না। আমদানি বা খুচরো পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্য বয়কটের নাকি তেমন প্রভাব পড়েনি। এই প্রচার শুরুর আগেও বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক ক্রেতা ভারতীয় পণ্য এড়িয়েই চলতেন। সেই মানুষরা কোনও নির্দিষ্ট প্রচার ছাড়াই এই পণ্য বয়কট করে এসেছেন বহুকাল ধরেই। নতুন করে এই বয়কটের ডাক দেওয়াতে ছোট ছোট দোকানগুলোতে প্রভাব পড়েছে। ভারতীয় পণ্য কম বিক্রি হচ্ছে সেখানে। বাংলাদেশি কোম্পানির কোল্ডড্রিঙ্কের বিক্রি সেখানে বেড়েছে। ভারত থেকে বহু পণ্য বাংলাদেশে আমদানি করা হয় ঠিকই, তবে প্রচারে যেসব পণ্য বর্জনের কথা বলা হচ্ছে, দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সেগুলোর অনুপাত খুবই সামান্য। ভারত থেকে বাংলাদেশের মূলত আমদানি হয় শিল্পের কাঁচামাল। বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়েই এই আমদানি চলে মূলত।
অন্য দেশের তুলনায় কম সময়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করা সহজ বাংলাদেশে। সড়ক পথেই পরিবহণ সম্ভব বলে খরচও কম, সময়ও কম লাগে। পচনশীল পণ্য তাই সহজে ভারত থেকেই নিয়ে আসা হয়। তাই পণ্য বয়কটের ডাক দিলেই তা বাস্তবে সবটা বদলে দেবে এমন নয় বলেই মনে করছেন আমদানিকারকদের একাংশ।
‘ইন্ডিয়াআউট’ এবং ‘বয়কটইন্ডিয়ানপ্রোডাক্টস’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে যে পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হচ্ছে তার নেপথ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপকেই দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে বাংলাদেশের এই ভারতবিদ্বেষী প্রচারে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার প্রশ্ন নেই। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিতেই বলেছেন। ভারতীয় পণ্য বয়কট প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেতাদের আক্রমণ করেছেন। হাসিনার প্রশ্ন, “যারা বয়কটের ডাক দিচ্ছেন, তাদের স্ত্রীদের ক'টা ভারতীয় শাড়ি আছে?” একটি জনসভায় শেখ হাসিনা বলেন, "তাহলে তারা বউদের শাড়িগুলি এনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন? আপনারা বিএনপি নেতাদের এই প্রশ্নটা করেন। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন বহু মন্ত্রীরা ভারতে যেতেন। ওদের বউরা ভারত থেকে শাড়ি কিনে এনে এখানে বেচত। আমি নিজেও দেখেছি, পাঁচজন মন্ত্রীর বউ একসঙ্গে যাচ্ছে। আমি দেখে বললাম, কী ব্যাপার পাঁচ মন্ত্রীর বউ একসঙ্গে? কলকাতা বিমানবন্দরে আমার চেনাজানা ছিল, আমি বলেছিলাম যে এরা ক'টা স্যুটকেস নিয়ে আসে আর ক'টা নিয়ে ফিরে আসেন, তা জানাতে। ওরা বলেছিল, এরা একটা স্যুটকেস নিয়ে আসে আর সাত-আটটা নিয়ে ফেরে।”
আরও পড়ুন- বাংলাদেশে কি আসলে উত্তর কোরিয়া? হাসিনার হাসিতে যে সত্য লুকিয়ে
তবে এই ভারতবিদ্বেষের নেপথ্যে আছে গভীর কূটনৈতিক তরজা। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে মলদ্বীপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে ভারত বিরোধী অবস্থান নিয়ে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন চিনপন্থি নেতা মহাম্মদ মুইজু। মুইজু ক্ষমতায় আসার পর তিনিই প্রথম ইন্ডিয়া আউট প্রচারাভিযান শুরু করেন। ভারতকে তিনি সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের চাপ দেন। তখন থেকেই ভারতের সঙ্গে মলদ্বীপের সম্পর্কে ফাটল ধরে।
৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয় বিরোধী রাজনৈতিক জোট বিএনপি। ফলে একতরফা নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের একাংশ মনে করছে, আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করেছে ভারত সরকার। বাংলাদেশের নির্বাচনে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছে। নয়াদিল্লির কুটনৈতিক সমর্থনেই বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। এই নির্বাচনের পরপরই ‘ইন্ডিয়াআউট’ প্রচার শুরু হয়।
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৪০৯৬ কিলোমিটার। দুই দেশের এই সীমান্তে নানা হত্যাকাণ্ড ঘটছে গত অর্ধশতক ধরেই। সেসব নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েনও দেখা গেছে বিভিন্ন সময়। বাংলাদেশের ভারতবিদ্বেষী মনোভাবের অন্যতম এক কারণ সীমান্তের হত্যাকাণ্ড। গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে টানা ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সময়ে ভারতে বিজেপি ও কংগ্রেস দু'টি সরকারই শাসন করেছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে। তিস্তা চুক্তি না হওয়া নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা তো ছিলই। তবে সাম্প্রতিক ক্রিকেট ইস্যু, পেঁয়াজ রপ্তানিসহ নানা ইস্যুতেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণা জন্মেছে।