নিলামে উঠল নোবেল, ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে যে সাহসী পদক্ষেপ নিলেন রাশিয়ার এই সাংবাদিক

হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে অভিনব এক পদক্ষেপ নিয়েছেন রাশিয়ার নাগরিক নোবেলজয়ী সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ। মুরাতভ নিজের নোবেল পুরস্কারটি নিলামে চড়ালেন ইউক্রেনের যুদ্ধদুর্গত শিশুদের সহায়তা করতে।

 

গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে। রাশিয়া বনাম ইউক্রেনের যুদ্ধ কবে শেষ হবে, এ-ব্যাপারে এখনই নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। ইউক্রেনে রাশিয়ার ভয়াবহ হামলার পর থেকে যুদ্ধপীড়িত ইউক্রেন থেকে নাগরিকরা পালাচ্ছেন প্রাণের তাগিদে।

বর্তমানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রিত ৭০ লক্ষরও বেশি ইউক্রেনীয়। ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুসারে, যু্দ্ধের ফলে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত শিশুরাও। ৪০ লক্ষেরও বেশি নিষ্পাপ ইউক্রেনীয় শিশু বেমালুম উদ্বাস্তু বনে গিয়েছে। এই সংখ্যা ইউক্রেনের বাসিন্দা মোট শিশুর সংখ্যার অর্ধেক।

ইউক্রেন সরকারের অভিযোগ, এক লক্ষরও বেশি শিশুকে রাশিয়া জোর করে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ায় স্থানান্তরিত করেছে। ঘোরতর যু্দ্ধ চলার ফলে ইউক্রেনের শিশুরা শৈশবের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে অস্বাভাবিক জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। এককথায় যা সৃষ্টি করেছে 'মানবিক সংকট'।

আরও পড়ুন: শয়ে শয়ে পাখি, হাজার হাজার ডলফিনের মৃত্যু! যুদ্ধের মাশুল যেভাবে গুনতে হচ্ছে ইউক্রেনের প্রাণীদের

দুর্বিষহ এই পরিস্থিতিতে হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে অভিনব এক পদক্ষেপ নিয়েছেন রাশিয়ার নাগরিক নোবেলজয়ী সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ। মুরাতভ নিজের নোবেল পুরস্কারটি নিলামে চড়ালেন ইউক্রেনের যুদ্ধদুর্গত শিশুদের সহায়তা করতে। নিউ ইয়র্কের অকশন সেন্টারে নিলামে তোলা প্রখ্যাত সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভের নোবেল পদক এক ব্যক্তি কিনে নিয়েছেন ১০৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারে। তবে যে ব্যক্তি নোবেল পদকটি কিনেছেন, তাঁর নাম-পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

২০২১ সালের অক্টোবরে নোবেল পুরস্কার পান মুরাতভ। সাংবাদিক হিসেবে মুরাতভকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার অবদান হিসেবে। ২০২১ সালে মুরাতভের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পদক পেয়েছিলেন ফিলিপিন্সের সাংবাদিক মারিয়া রেসা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে নেমে সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ এবং সাংবাদিক মারিয়া রেসাকে বহু কাঠখড় পোড়াতে রয়েছে। সরকারি হেনস্থার শিকার হওয়া থেকে শুরু করে প্রাণনাশের হুমকির মুখেও পড়তে হয় ওঁদের। পুতিন-বিরোধী খবরাখবর প্রকাশের জন্য গত এপ্রিলেও রাশিয়ায় হামলার মুখে পড়েন দিমিত্রি মুরাতভ।

রাশিয়া থেকে প্রকাশিত নোভায়া গেজেতা নামে একটি প্রখ্যাত সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক দিমিত্রি মুরাতভ। রাশিয়ার প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলির মধ্যে কেবলমাত্র নোভায়া গেজেতাই প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে খবরাখবর ছাপে। ইতিমধ্যেই ক্রেমলিন হুঁশিয়ারি দিয়েছে, রাশিয়ার কোনও সংবাদপত্র পুতিন-বিরোধী খবরাখবর ছাপলে শাস্তিমূলক কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ক্রেমলিনের এই হুঁশিয়ারির পর তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য বিখ্যাত সংবাদপত্র নোভায়া গেজেতার প্রকাশ গত দেড় মাস ধরে বন্ধ।

নিলামে নোবেল পদকটির দাম ১০৩.৫ মিলিয়ন ডলারে উঠতে পারে, এতটা আশা করেননি দিমিত্রি মুরাতভ। বিপুল অঙ্কের টাকায় নোবেল পদক বিক্রি হওয়ার পরে মুরাতভ বলেছেন, শুভবু্দ্ধিসম্পন্ন বহু মানুষ ইউক্রেনের পাশে আছেন। তবে নোবেল পদকটা এত বেশি দাম দিয়ে কেউ কিনবেন, এটা ধারণা করতে পারিনি। ব্যাপারটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।

নোবেল পদক বিক্রির পর ইউক্রেনের বাস্তুচ্যুত শিশুদের সহায়তায় প্রথম ধাপে মুরাতভ ৫ লক্ষ ডলার দান করেছেন। ইউনিসেফের মাধ্যমে এই টাকাটা খরচ করা হবে যুদ্ধদুর্গত শিশুদের জন্যে।

১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া চালু হয়। সেই সময় থেকে এ-পর্যন্ত বিজ্ঞানের নানা শাখা, সাহিত্য, বিশ্বশান্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য অন্তত ১,০০০ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তবে নোবেল পুরস্কার পেয়ে তা বিক্রি করে দিয়েছেন, এমন নজির হাতে গোনা কয়েকটি ক্ষেত্রেই।

মুরাতভের পাওয়া যে নোবেল পদকটি নিউ ইয়র্কে নিলামে বিক্রি হল সেটির ওজন ১৭৫ গ্রাম। পদকটিতে ২৩ ক্যারেট সোনা রয়েছে।

ইউক্রেনে শুধু শিশুরাই নয়, রাশিয়া হামলা চালানোর পর থেকে সেদেশের প্রাপ্তবয়স্ক লক্ষ লক্ষ নাগরিক উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্ৰণা সহ্য করছেন। রাষ্ট্রসংঘর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশনের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চল থেকে সবচেয়ে বেশি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ইউক্রেনীয় নাগরিক ভিটে ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এরপরই স্থান পূর্ব ইউক্রেনের কিয়েভ এবং ডোনেক্সের। পলাতক মহিলাদের মধ্যে একাংশ আবার অন্তঃসত্ত্বা।

ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেলের অফিস সূত্রে সম্প্রতি পরিসংখ্যান পেশ করে জানানো হয়েছে, রাশিয়ার সেনা ইউক্রেনে বিধ্বংসী হামলা চালানোর পরে অন্ততপক্ষে এক হাজারের আশেপাশে শিশু গুরুতর জখম। আর গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে তিন শতাধিক শিশুর। এমনকী, কিশোরীদের মধ্যে একাংশকে রাশিয়ার সেনা যৌন হেনস্থা করেছে বলেও অভিযোগ।

সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ নিজের নোবেল পদক বিক্রি করে যে দৃষ্টান্ত গড়েছেন, ইউক্রেনের বর্তমান দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে তা যে অতি মানবিক পদক্ষেপ একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

নোবেল পদক নিলামে চড়িয়ে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা অবশ্য এটিই সর্বপ্রথম নয়। এর আগেও দুই নোবেলজয়ী তাঁদের পদক বিক্রি করে দিয়েছেন। ১৯৬২ সালে ডিএমএ-র গঠন আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পদক পেয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন। ২০১৪ সালে ওই নোবেল পদকটি বিক্রি হয়েছে ৪.৭৬ মিলিয়ন ডলারে। একই অবদানের জন্য ওয়াটসনের সঙ্গে নোবেল পদক পান বিশিষ্ট ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক। ওয়াটসন নোবেল পদক নিলামে চড়িয়ে সেটা বিক্রি করে দেওয়ার পরে একই পথের পথিক হয়েছে বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিকের পরিবার। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিকের পরিবার ২০১৭ সালে নোবেল পদকটি নিলামে চড়িয়ে সেটা ২.২৭ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেছেন। সেই তালিকায় এবার নাম লেখালেন প্রখ্যাত এবং প্রতিবাদী রাশিয়ান সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ।

নিউ ইয়র্কের অকশন সেন্টারে দিমিত্রি মুরাতভের নোবেল পদকের দাম বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ক্রমশ দাম চড়তে থাকে। দিমিত্রি মুরাতভের কথায়, বিষয়টা তাঁর কাছে এখনও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।

যে উদ্দেশ্যে নিজের পাওয়া নোবেল পদকটি নিলামে চড়িয়ে বিক্রি করে দিলেন মুরাতভ, তা কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা 'ছাড়পত্র' কবিতার একটি লাইনকে মনে করিয়ে দেবে। কিশোর কবি সুকান্ত লিখেছিলেন, 'এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার'।

More Articles