মুখে দিলেই স্বর্গীয় স্বাদ! পুজোয় গন্তব্য হোক কলকাতার সেরা সন্দেশের ঠিকানাগুলি
Kolkata Sweets: দেখা যাক, কলকাতায় কোথায় কোথায় গিয়ে সন্দেশ দিয়ে পেটপুজো করা যেতে পারে।
বাঙালি জাতি মানেই ভোজনরসিক। খাওয়াদাওয়া করা আর লোক খাওয়ানো আমাদের শিরায় শিরায় বইছে। এমন কোনও বাঙালি নেই, যার মিষ্টির কথা শুনলে মুখে হাসি ফোটে না। বাঙালির সঙ্গে মিষ্টির এক আবেগপূর্ণ সম্পর্ক। এতটাই সেই আবেগ যে, মিষ্টির কৃতিত্ব নিয়ে পড়শি রাজ্যের সঙ্গে আদালতে যেতেও তার অসুবিধে নেই। আর অতিথি অ্যাপায়নে বাঙালি মিষ্টি না দিয়ে থাকতে পারে না। সকল বাঙালি বাড়ি গেলেই শোনা যায়, "একটু বসুন, একটু মিষ্টিমুখ করে যান।" বাঙালির অভ্যেসে মিষ্টি খাওয়া কবে থেকে ঢুকেছে, তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল, কিন্তু ডিনারের শেষে মিষ্টিমুখ না হলে তার আবার চলে না। খাইয়ে বাঙালির তাই খালি পেটেও মিষ্টি আবার ভরা পেটেও মিষ্টি।
সন্দেশ নিয়ে বাঙালির এক অদ্ভুত আদিখ্যেতা আছে। থাকবে না-ই বা কেন, এমন একটা নরম জিনিস যা মুখে দিতে না দিতেই শেষ। তবে সন্দেশ কিন্তু আজকের নয়- বহু প্রাচীন গল্পগাথায় সন্দেশের উল্লেখ আছে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে কয়েকহাজার বছর আগে গোয়ালারা গরুর দুধ দুইয়ে সংরক্ষণ করার পর তা খার হয়ে গেলে তা দিয়ে খারখন্দ বানাত। সেই খারখন্দই শক্ত মিষ্টি হয়ে সন্দেশের রূপ নেয়। তবে ষোলো শতকে যখন পর্তুগিজরা ভারতে আসে, তখন থেকেই ছানার ব্যবহারের উল্লেখ আছে। পর্তুগিজদের পর বাঙালিরাই ছানা থেকে একের পর এক মিষ্টি বানাতে শুরু করে। প্রথমে এদের বলা হতো হালুইকর। পরে নাম হলো ময়রা। বলা হয়, ছানা আবিষ্কারের আগেই সন্দেশ তৈরি হয়েছিল। প্রাচীন আমলে বেসন, নারকেল, মুগডালের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে সন্দেশ বানানো হতো। কালের চক্রে দুধ ফেটিয়ে ছানা দিয়ে বা ক্ষীর দিয়েই সন্দেশ তৈরি হয়।
এ তো গেল সন্দেশ তৈরির কথা, এবার আসা যাক সন্দেশ তৈরি করতে গিয়ে যাঁরা বিখ্যাত হয়েছিলেন তাদের কথায়। সন্দেশের কথা বলতে গেলে তিনজন মহান কারিগরের নাম করতেই হয়। তারা হলেন- ভোলা ময়রা, ভীমচন্দ্র নাগ আর গিরিশচন্দ্র দে। বলতে গেলে, এঁদের তিনজনের হাতেই সন্দেশ অমরত্ব পেয়েছিল।
আরও পড়ুন: বাঙালির প্রিয় এই সন্দেশের সৃষ্টি জামাই ঠকাতে! বাড়িতেও বানাতে পারেন এই মিষ্টি
সন্দেশ নিয়ে আছে কিছু মজার গল্প। কিছু কিছু সন্দেশ তৈরিই হয়েছিল নিছক অবহেলায় বা কৌতুকের বশে কিন্তু আজ সেইসব সন্দেশ জগৎজোড়া খ্যাতির চুড়োয় বসে আছে। প্রথমে শুরু করা যাক, শ্রীরামপুরের গুটকে সন্দেশ দিয়ে। কলকাতার রসগোল্লা বা বর্ধমানের সীতাভোগ-মিহিদানার মতো জনপ্রিয় না হলেও প্রাচীনত্ব বেশ অনেকখানি। গুটকে কচুরির সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হলেও দু'জনের মধ্যে কিন্তু কোনও মিল নেই। অনেকে আবার মনে করেন, এই সন্দেশের ধারণা এসেছে গুপ্তিপাড়ার গুপে সন্দেশ থেকে। ছোট ছোট দুটো কড়া পাকের সন্দেশ, দেখতে অনেকটা লুচির লেচির মতো। একসঙ্গে জুড়ে দিলেই তৈরি গুটকে সন্দেশ। স্বাদ অসাধারণ, ছানার তৈরি এই সন্দেশ মুখে দিলেই গলে যাবে। তবে, শ্রীরামপুরের সব জায়গায় এই মিষ্টি পাবেন না। মহেশচন্দ্র দত্ত-র মিষ্টির দোকান এই সন্দেশের জন্য প্রসিদ্ধ। শোনা যায়, স্বয়ং রাধাবল্লভ নাকি এই দোকান থেকে গুটকে সন্দেশ খেয়ে গিয়েছেন, তবে সত্যি না মিথ্যে- তা বলতে পারি না।
এরপর আসা যাক আরেক সন্দেশের কথায়, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় তৈরি ‘জয় হিন্দ’ সন্দেশ। সময়টা ১৯৪২ সাল। সারা ভারত তখন ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মুখরিত। কেউ গান, কেউ কবিতা পাঠ করে গর্জে উঠছেন। আর সবকিছুর মধ্যে নিজেদের মতো করে লড়াইয়ে নামলেন মন্মথ দাস নামে এক মিষ্টি বিক্রেতা। তিনি বানালেন ‘জয় হিন্দ’ সন্দেশ। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল তার গল্প। তেরঙা এই সন্দেশ জায়গা করে নিল দেশবাসীর মনে। তখনকার দিনে জমিদারবাড়িতে হলুইকর বসত। আর এই সন্দেশের লক্ষ্য ছিল এই ‘জয় হিন্দ’ শব্দ, যাতে মানুষের মুখে মুখে প্রচার পায়। জমিদারবাড়ির খাবারের পাতে পড়তে শুরু করল মিষ্টি। এর জনপ্রিয়তা যতই বাড়তে থাকল, ততই ভীত হলো ব্রিটিশ সরকার। তারা ঠিক করল, এই মিষ্টি তৈরি বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন জমিদারবাড়িতে হানা দিতে শুরু করল ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু যেখানে স্বাধীনতার স্বপ্ন মানুষের রক্তে সেখানে আর কোনওকিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। মন্মথ দাসের দেখাদেখি নলিন দাস থেকে শুরু করে নকুড়চন্দ্র- সকলেই এই মিষ্টি বানাতে শুরু করেন। এই সন্দেশ আস্তে আস্তে কীভাবে যেন জড়িয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে। তারপর দেশ স্বাধীন হলো, আর কালের নিয়মে হারিয়ে গেল এক তেরঙা সন্দেশ। এখন কোনও দোকানে বানানো না হলেও মাখনলাল দাসের দোকানে আজও এই জয় হিন্দ সন্দেশ ১০টা করে হলেও বানানো হয়। ২০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই সন্দেশ।
এরপর নাম করতেই হয় বেলিয়াতোড়ার ‘মেচা’ সন্দেশের। দেখতে অন্যরকম বা স্বাদে অতুলনীয় হলেও রাঢ়বাংলার বিখ্যাত এই সন্দেশ পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতায় তেমন পরিচিতি পায়নি। অনেকেই জানেন না যে, কলকাতার রসগোল্লার মতো এই মেচা সন্দেশ অতি প্রাচীন। প্রথম আবিষ্কার কবে হয়েছিল, তা নিয়ে কেউ কিছু বলতে না পারলেও মেচা-প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্ণধার বললেন, তিনিও সঠিক তথ্য জানেন না। তিনি তাঁর বাবা এবং দাদুকে এই সন্দেশ বানাতে দেখেছেন এবং সেখান থেকে তিনিও শিখেছেন। এইভাবেই বংশপরম্পরায় চলে আসছে এই সন্দেশ বানানোর কাজ। এই মেচা সন্দেশ বানানোর পদ্ধতি অদ্ভুত। ছাতুর আটা বানিয়ে তা দিয়ে গাঠিয়া বানানো হয় এবং সেই গাঠিয়া গুঁড়ো করে তাতে চিনি, ঘি, ক্ষীর, এলাচ মিশিয়ে লাড্ডুর মতো পাকানো হয়। তারপর তাকে চিনির রসে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সেই রস শুকিয়ে গেলে পুরো মনে হয় যেন ছোট একটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি।
এরপর আসি আরেকটি মজাদার সন্দেশের গল্পে। জনাইয়ের মনোহরা। এই মনোহরা এক অপূর্ব সৃষ্টি। ভেতরে সন্দেশ, বাইরে গুড় বা চিনির খোলস। তো গল্পটা হলো, জনাইয়ের জমিদার একবার তার অঞ্চলের বিখ্যাত ময়রাকে তলব করে বললেন যে, তিনি শিকারে যাচ্ছেন, শিকার থেকে ফিরে এসে তিনি নতুন মিষ্টি চান। এবার মুশকিল হলো, মিষ্টি তো তৈরি, কিন্তু জমিদারের দেখা নেই! এদিকে মিষ্টি নষ্ট হতে শুরু করেছে। ময়রা করল কী, সে মিষ্টিটা চিনির রসে অনেকক্ষণ ডুবিয়ে রাখল, যাতে মিষ্টি নষ্ট না হয়ে যায় আর জমিদার আসার পর সেই সন্দেশ খেয়ে তিনি যে কী পরিমাণ মুগ্ধ হয়েছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি ওই সন্দেশের নাম দিলেন মনোহরা অর্থাৎ যিনি মনকে হরণ করেছেন। কেউ জনাইতে গেলে কমল ময়রার দোকানের এলাচ দেওয়া এই সন্দেশ খেয়ে দেখবেন।
যাই হোক, সন্দেশ নিয়ে অনেক গালগল্প হলো, এবার দেখা যাক, কলকাতায় কোথায় কোথায় গিয়ে সন্দেশ দিয়ে পেটপুজো করা যেতে পারে। প্রথমে চলে আসুন নতুন বাজারে মাখনবাবুর দোকানে। বিডন স্ট্রিটে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই এই দোকান দেখিয়ে দেবে। এখানে বারকেসের ওপর মিষ্টি সাজানো আছে। আপনি যে মিষ্টি খাবেন, আর কত পিস খাবেন- তা জানিয়ে দিলে মাখনের দোকানের ময়রা আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আপনাকে মিষ্টি বানিয়ে দেবে। অবাক লাগলেও এটাই সত্যি।
এরপর চলে আসুন হেদুয়া পার্কের পাশে গিরিশচন্দ্র দে আর নকুড়চন্দ্র নন্দী-তে। এখানে গেলে কিন্তু শুধু সন্দেশ পাবেন, আর অন্য কোনও রসালো মিষ্টি কিন্তু পাবেন না। কলকাতায় এমন একটাই দোকান, যেখানে শুধু সন্দেশ ছাড়া আর কিছু বানানো হয় না। আর তাদের মাখা সন্দেশ যেন অমৃত! বলতে গেলে ওদের সিগনেচার ডিশ।
তারপর চলে যান ভীমচন্দ্র নাগের দোকানে। অবশ্যই খেয়ে দেখবেন গোলাপ সন্দেশ বা প্যারাডাইস সন্দেশ। শোনা যায়, এই ভীমচন্দ্র নাগের দোকানকে ঘিরে রয়েছে নানা গল্প-কথা। বলা হয়, মা শীতলা নাকি ভীমচন্দ্রকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন যে, টাকা-পয়সার অভাবের জন্য অনেক লোক মায়ের পুজোয় সন্দেশ ভোগ দিতে পারছে না। সেই শুরু, তারপর থেকে আজ অবধি শীতলাপুজোর দিন এই দোকানের একটি স্পেশাল সন্দেশ দেড় টাকা দামে বিক্রি হয়।
উত্তর কলকাতার তাবড় ময়রাদের দোকান ঘোরার পর এবার চলে আসতে হবে দক্ষিণ কলকাতায়। রাধারমণ মল্লিক আর বলরাম মল্লিকের দোকানে। সন্দেশের পেটে নানারকম জিনিস ঢুকিয়ে তাদের এক নতুন চেহারা দিতে করেন এই মল্লিক-যুগল। এদের ডাব সন্দেশ কিন্তু অসাধারণ। তারপর চলে যান কামধেনু সুইটস-এ। এদের নরম পাকের সন্দেশ যেন মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়।
এরপর বলতে হবে কলকাতায় পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে এই দোকান ওই দোকান করে সন্দেশ খেতে না গিয়ে সোজা চলে যেতে পারেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মিষ্টি হাব-এ। একই ছাদের তলায় যেন চাঁদের হাট। কে সি দাশ-এর অমৃতকুম্ভ, মিষ্টি কথা-র ফিউশন সন্দেশ- সব পাবেন একসঙ্গে। সময়ও বাঁচবে, আর অনেক অপশনও পাবেন।
এই গেল সন্দেশের ইতিহাস। আর শুধু যে নামজাদা মিষ্টির দোকানের মিষ্টি ভালো, আপনার পাড়ার দোকানের মিষ্টি ভালো না- একথা বলা যাবে না। এই সন্দেশ আপনার পাড়ার ময়রাও বানাচ্ছেন আর কলকাতার বিভিন্ন দিকে সেই সন্দেশ বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন নামে। কলকাতায় অনেক মিষ্টির দোকান আছে, যা অতি প্রাচীন, কিন্তু মিষ্টির কী বাহার! তবে ইতিহাস যা-ই হোক, স্বাদে, অভিনবত্বে, বাঙালির মিষ্টির জুড়ি মেলা ভার।