জ্বলল শেখ শাহজাহানের ভাইয়ের ভেড়ি, সন্দেশখালিতে যেভাবে ছড়াচ্ছে অশান্তির আগুন

Sandeshkhali Row: শাহজাহানে ভাই সিরাজুদ্দিনও এলাকার বাসিন্দাদের জমি কেড়ে নিতে সিদ্ধহস্ত। জমি দখল করে মাছের ভেড়ি তৈরি করা সিরাজুদ্দিনের ‘বাঁ হাতের খেল’ বলেও দাবি করেছেন গ্রামবাসীদের একটি অংশ।

সন্দেশখালিতে শান্তি ফেরার চিহ্নমাত্র নেই। বরং প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সন্দেশখালি। বৃহস্পতিবার ফের গ্রামবাসীদের ক্ষোভের আগুন জ্বলল এলাকায়। স্থানীয় তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে সন্দেশখালির মানুষ। শাহজাহানের প্রধান দুই সঙ্গী উত্তম ও শিবু। তবে শাহজাহানের এখনও খোঁজ নেই তল্লাটে।

গত কয়েকদিনে রাজ্যের এসসি কমিশন, জাতীয় মহিলা কমিশন, বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী থেকে অনেকেই ঘুরে গিয়েছেন সন্দেশখালি থেকে। বুধবার সন্দেশখালি ফেরেন রাজ্যপুলিশের ডিজি রাজীব কুমার। আর তার পরেই বৃহস্পতিবার সকালে শাহজাহান বাহিনীর দখল করা মাঠ ফের নিজেদের দখলে নেন স্থানীয়রা। বেলা গড়াতেই শাহজাহানের ভাইয়ের মাছের ভেড়ির আলাঘরে হঠাৎই আগুন লেগে যায়। স্থানীয়দের একাংশের অবশ্য দাবি, আগুন দিয়েছে শাহজাহান-ঘনিষ্ঠরা। আবার অন্য একটি অংশের দাবি, ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীই আগুন ধরিয়ে দেয় শেখ সিরাজের মাছের ভেড়ির আলাঘরে। পুলিশের সামনে গ্রামবাসীদের একটি অংশ বিক্ষোভ দেখায় বলেও অভিযোগ।

সকালে শাহজাহান অনুগামীদের ‘দখল’ করে রাখা ঋষি অরবিন্দ মিশন ময়দানে ঢুকে পড়ে গ্রামবাসী। সীমানা প্রাচীরে শাহজাহানের নাম লেখা ছিল। তাতে চুনকাম করে দেওয়া হয়। পুলিশপ্রশাসন গ্রামের ছোটোদের মধ্যে ফুটবল, জার্সি বিলি করে। মাঠেই শুরু হয়ে যায় খেলাধুলো। তার পরেই খবর পাওয়া যায়, সন্দেশখালির ঝুপখালিতে শাহজাহানের ভাই শেখ সিরাজুদ্দিনের মাছের ভেড়ির দিকে গ্রামবাসীরা যাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সিরাজুদ্দিনের ভেড়ির আলাঘর থেকে পুড়ে খাক। ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

আরও পড়ুন: বহিরাগত দেখলে শাঁখ বাজানোর নির্দেশ! সন্দেশখালি থেকে যে বার্তা দিলেন বিরোধীনেতা শুভেন্দু

দীর্ঘদিন ধরেই সন্দেশখালিতে 'গুন্ডারাজ' চালিয়ে এসেছে শেখ শাহজাহান ও তার দলবল। গ্রামবাসীদের জমিদখল থেকে শুরু করে বাড়ির মেয়ে-বউদের অত্যাচার, শারীরিক নিগ্রহ— বাদ ছিল না কিছুই। বিনা পারিশ্রমিকে গ্রামের মেয়েদের দিয়ে বিভিন্ন প্রকার কাজ পর্যন্ত করানো হত। কথা না শুনলেই মারধর, বাড়ির পুরুষদের অত্যাচার, কটূ কথা, বাদ ছিল না কিছুই। এই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধেই একদিন পথে নামেন কোণঠাসা গ্রামবাসীরা। বিক্ষোভ ক্রমে বড় আকার নেয়। অনেকেই সন্দেশখালির এই বিক্ষোভকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সন্দেশখালি ঘুরে দেখে এসসি কমিশন ও জাতীয় মহিলা কমিশন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার দাবি জানিয়েছেন। যদি বামনেত্রী বৃন্দা কারাট তার প্রতিবাদ করে জানান, রাষ্ট্রপতি শাসন মানে আদতে বিজেপি শাসন। আর সেটা কোনও কাজের কথা নয়।

জানা গিয়েছে, শাহজাহানে ভাই সিরাজুদ্দিনও এলাকার বাসিন্দাদের জমি কেড়ে নিতে সিদ্ধহস্ত। জমি দখল করে মাছের ভেড়ি তৈরি করা সিরাজুদ্দিনের ‘বাঁ হাতের খেল’ বলেও দাবি করেছেন গ্রামবাসীদের একটি অংশ। বৃহস্পতিবার সেই সিরাজুদ্দিনের মাছের ভেড়িতে কে বা কারা আগুন দিল, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, শাহজাহানের অনুগামীরাই আলাঘরে আগুন দিয়ে পালিয়েছে। শাহজাহান বাহিনী পালানোর আগে গ্রামবাসীদের ‘দেখে নেব’ বলে শাসিয়ে গিয়েছে বলেও অভিযোগ তাঁদের। আবার, অন্য একটি অংশের দাবি, ক্ষুব্ধ হয়ে আগুন দিয়েছেন গ্রামবাসীরাই। হাওয়া বদলের ইঙ্গিত পেয়ে তাই গ্রামবাসীরা নিজের জমি ফেরাতে পথে নেমেছেন বলেও জানিয়েছেন অনেকে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সন্দেশখালিতে যান বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। একদিন আগেই সেখানে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে দেখা করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বেশ কয়েকবার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আদালতের অনুমতি নিয়ে সন্দেশখালিতে ঢোকেন শুভেন্দু। এদিন এলাকায় ঢুকতে বাধা পান সুকান্তও। সন্দেশখালিকাণ্ডে ধৃত বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার বসিরহাট উপসংশোধনাগারে দেখা করতে গিয়েছিলেন সুকান্ত। কিন্তু প্রথমে তাঁকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। সংশোধনাগারের বাইরে বেশ কিছু ক্ষণ বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি। পরে সুকান্ত সংশোধনাগারে ঢোকেন এবং ধৃতদের সঙ্গে দেখা করেন। বিজেপি সভাপতি বেরিয়ে জানান, তিনি সন্দেশখালি যাবেন। এর আগেও একবার সন্দেশখালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে তাকে আটকে দেয় পুলিশ। বৃহস্পতিবার বসিরহাট থেকে সন্দেশখালির উদ্দেশে তিনি রওনা দিলেও ধামাখালিতে আটকে দেওয়া হয় তাঁকে। পুলিশ জানায়, সুকান্ত একা চাইলে সন্দেশখালিতে যেতে পারেন। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া আর কাউকে তাঁর সঙ্গে যেতে দেওয়া হবে না। পুলিশের সঙ্গে এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় বিজেপি নেতাদের। অন্তত দলের এক জনকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন সুকান্ত। কিন্তু পুলিশ তাতে অনুমতি দেয়নি। বাধ্য হয়ে একাই লঞ্চে সন্দেশখালি পৌঁছন বিজেপি সভাপতি। সন্দেশখালিতে গিয়ে ধৃত কর্মী বিকাশ সিংহের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন সুকান্ত। তার পর সন্দেশখালি থানায় আইসির সঙ্গে কথা বলতে যাবেন বলেও জানান তিনি।

বুধবারই সন্দেশখালির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে গিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার এবং বসিরহাটের পুলিশ সুপার হোসেন মেহেদি রহমান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি-সহ একাধিক বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেন তাঁরা। পাশাপাশি সন্দেশখালির পাঁচটি জায়গায় মোট দশটি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়। নতুন করে যাতে কোনও রকম অশান্তি না ছড়ায়, সেই নজরদারির জন্যই এই বন্দোবস্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্দেশখালি থেকে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার আশ্বাস দেন রাজ্যপুলিশের ডিজি রাজীব কুমার। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সন্দেশখালি এলাকায় টহল দিতে দেখা যায় তাঁকে। পূর্ত দফতরের বাংলো থেকে বেরিয়ে ধামাখালির লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। তার পর আবার লঞ্চ নিয়েই যান ছোট শেয়ারা এলাকার দিকে। লঞ্চে উঠে টহল দিতে বেরোনোর আগে ডিজি বলেন, “আমরা এখানে এসেছি সকলের সঙ্গে কথা বলতে। আমাদের দিক থেকে যা যা করণীয়, অবশ্যই আমরা তা করব। যে সমস্যা আছে, আমরা তা শোনার এবং সমাধান করার চেষ্টা করছি।” কাউকে আইন হাতে তুলে না নেওয়ার আর্জি জানিয়ে তাঁর সংযোজন, “কারও যদি কোনও সমস্যা থাকে, অভিযোগ থাকে, তবে আমরা সব সময় রয়েছি সেগুলির সমাধান করার জন্য।’’

আরও পড়ুন: সন্দেশখালি ঘুরে কেন রাষ্ট্রপতি শাসন চাইছেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন?

বেশ কয়েকদিন কেটে গেলেও শেখ শাহজাহানের এখনও কোনও খবর নেই। তাকে শাসক দল আশ্রয় দিচ্ছে বলেই অভিযোগ বিরোধীদের। সরাসরি শাহজাহানের গ্রেফতারি নিয়ে মুখ না খুললেও অভিযুক্তরা সকলেই গ্রেফতার হবেন বলে আশ্বাস দেন ডিজি। রাজীব জানান, 'যাঁরা আইন ভেঙেছেন, তাঁরা সকলেই গ্রেফতার হবেন।' তবে 'অত্যাচারী' শেখ শাহজাহানদের অত্যাচার যে সন্দেশখালির মানুষ আর সহ্য করবেন না কোনও কিছুর বিনিময়েই, তা কার্যত বৃহস্পতিবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন গ্রামবাসী। যেভাবে শাহজাহানের ভাইয়ের মাছের ভেড়ি জ্বালানো হয়েছে, তা থেকে তো সেই বিক্ষোভের আঁচটাই ভালো রকম ভাবে টের পাওয়া যায়। তবে গোটা সন্দেশখালির মানুষের কাছে একটাই প্রশ্ন, কবে গ্রেফতার হবে শেখ শাহজাহান?

 

More Articles