শূন্য শুধু শূন্য নয়, পরমতসহিষ্ণু হতে চাইছে সিপিআইএম

CPM: বামপন্থীদের কাছে লোকসভা- বিধানসভার আসনটাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। তাঁদের বিবেচ্য বিষয় হলো, মানুষের রুটিরুজির সংগ্রামকে আইনসভার ভেতরে যেমন, ঠিক তেমনিই, আইনসভার বাইরে রাজপথে প্রসারিত করা।

অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএম আসন সংখ্যা নিরিখে কোনো সাফল্য পায়নি। এই বাস্তবকে সামনে রেখে সম্প্রতি, সিপিআইএম-এর রাজ্য কমিটির দুদিন ব্যাপী অধিবেশন হয়ে গেল। অধিবেশন শেষে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম যৌথভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। কী উঠে এল পর্যালোচনায়? সেলিম বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে বাম- কংগ্রেসের নির্বাচনী যে সমঝোতা হয়েছিল তাকে কেবলমাত্র বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে হয়নি। তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়তে হয়নি। তাকে লড়তে হয়েছে সার্বিকভাবে। দুর্নীতির টাকার বিরুদ্ধে।কর্পোরেটের টাকার বিরুদ্ধে। লড়তে হয়েছে পেশিশক্তির বিরুদ্ধে। লড়তে হয়েছে গোদি মিডিয়ার প্রচারের বিরুদ্ধে।
এই অসম লড়াই যে লড়তে হবে, সে ভাবনা মাথায় রেখেই সিপিআইএম নির্বাচনী সংগ্রামে নেমেছিল, স্বীকার করতে সেলিম কোনো দ্বিধা করেননি। আবার সংবাদ মাধ্যমের কাছে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি স্পষ্ট বলেছেন, বাংলায় একটা নতুন পার্টি তিনি পেয়েছেন। পর্যালোচনা থেকে আগামীর সঙ্কেত পেতে চাইছেন সিপিআইএম রাজ্য নেতৃত্ব। তবে ইয়েচুরি-সেলিমের যৌথ সাংবাদিক বৈঠকের বক্তব্য থেকে অনুমান করতে পারা যায়, দলীয় সদস্য নন, কিন্তু দলের প্রতি বিশেষ রকমের আত্মনিবেদিত অংশ কে যথোচিত মর্যাদা দিয়ে কাজে লাগাবার ভাবনা তাঁদের আছে। পরমতসহিষ্ণু হতে চাইছে সিপিআইএম। সেইসঙ্গে সেলিম বলেছেন, গণসংযোগের নিবিড়তার কথা। ভোটের প্রচারে প্রার্থী বা কর্মীরা জনসংযোগে বেরিয়ে দু'চারজন মানুষ হাত নাড়লেন, বুকে জড়িয়ে ধরলন- এটা অনেকটা। তবে এটাই শেষ নয়। সারা বছর ধরে, ভোটের ফল যাই হোক, মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখতে হবে। তাঁদের দুঃখে- সুখে পাশে থাকতে হবে। সঙ্কীর্ণতা ভুলে পাশে থাকাই মৃতসঞ্জীবনী সুধা, মনে করছে সিপিআইএম।

২০১১ সালে বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মাঠে ময়দানের লড়াই এবং ভোটের লড়াই— দুটো ক্ষেত্রেই সাফল্য বাম গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে আসেনি। ২০২৪ সালে ভোটে বামেরা কোনো আসন জিততে না পারলেও, সাংগঠনিক শক্তির যে পরিচয় বামপন্থীরা রাখতে পেরেছেন, তা রাজনীতির ময়দানে একটা নতুন বার্তা দিচ্ছে।
সীতারামের বক্তব্যে পরিষ্কার, পশ্চিমবঙ্গে সেলিম হাল ধরবার পর বিগত আড়াই বছরে প্রাণসঞ্চার হয়েছে। দলের নেতৃত্বভার নিয়ে সেলিম প্রথমে যেটি চেষ্টা করেছিলেন, নতুন প্রজন্মের ছাত্রযুবদের সামনে সারিতে নিয়ে আসতে। সেই কাজে তিনি অনেকটাই সফল হয়েছেন।

আরও পড়ুন: শূন্য থেকে সংখ্যায় ফিরতে বড় সিদ্ধান্ত বামেদের! কী হতে চলেছে নয়া স্ট্র্যাটেজি?

যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ,গণতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাস করেন, তাঁদের মধ্যে সেলিম সম্পর্কে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। শ্রমিক আন্দোলন এবং কৃষক আন্দোলন, এই দুটি ক্ষেত্রেও আগামী দিনে সেলিম নতুন প্রজন্মের মানুষদেরই নেতৃত্বে নিয়ে আসবেন, এমনটা মনে করছেন ঘরেবাইরে অনেকে।

একটা সময় ছিল যখন কৃষক আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করা মানুষদের মধ্যে থেকে সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব উঠে আসত। সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ থেকে শুরু করে আবদুল্লা রাসুল—এই যে ধারাবাহিকতা, সেটা আগামী দিনে সেলিম আবার ফিরিয়ে আনবেন, ভাবছেন অনেকেই। কারণ তারুণ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এই প্রবণতা বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পনেরো বছরেও দেখতে পাওয়া যায়নি। আবার বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও এই কৌশল অধরা ছিল।

সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতেও এটা একটা নতুন বার্তা দিতে চলেছে— সীতারামের এই কথা তার ইঙ্গিত।

বামপন্থীদের কাছে লোকসভা- বিধানসভার আসনটাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। তাঁদের বিবেচ্য বিষয় হলো, মানুষের রুটিরুজির সংগ্রামকে আইনসভার ভেতরে যেমন, ঠিক তেমনিই, আইনসভার বাইরে রাজপথে প্রসারিত করা। সেই কাজটিতে পশ্চিমবঙ্গে বিগত আড়াই বছরে সেলিম এবং টিম সেলিমের যে সাফল্য, তা এক কথায় অনবদ্য। এটা খুব ঠিক কথা, নির্বাচনী সংগ্রামের সাফল্যের জন্য আজকের প্রেক্ষিতে অর্থশক্তি আর পেশিশক্তির দাপটের বিশেষ প্রয়োজন। এই বাস্তবতায় উপনীত হওয়া বুর্জোয়া দলগুলো পক্ষে যেভাবে সম্ভব, তা আদৌ কমিউনিস্টদের পক্ষে সম্ভব নয়। সিপিআইএম যদি ইলেক্টোরাল বন্ধ টাকা নিত, তাহলে নির্বাচনী ফল পশ্চিমবঙ্গে কী হত বা গোটা ভারতে বামেরা আরেকটু সুবিধেজনক অবস্থায় থাকত কিনা—এ বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কথা হচ্ছে। জনতার বিশ্লেষণ—
ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা না নিয়ে, কর্মী -সমর্থক- দরদিদের কাছ থেকে কার্যত 'ভিক্ষে' করে নির্বাচনী সংগ্রাম পরিচালনা করে, সেলিম হয়তো ভোট রাজনীতিতে সাফল্য পাননি, কিন্তু এই সময়ের অস্থির রাজনীতিতে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছেন, তা আগামী দিনে রাজনৈতিক অঙ্গনকে একটা সুনির্দিষ্ট পথ দেখাতে সক্ষম হবে।

অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত লক্ষ্য করা গিয়েছিল। লড়াইটা অসম, বুঝেই নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বামেরা। দলের রাজ্য কমিটির দু'দিনের অধিবেশন শেষে একথা সেলিম খুব পরিষ্কার ভাবে সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেছেন।

সিপিআইএম-এর বক্তব্য, তৃণমূল আর বিজেপি এই দু'টি রাজনৈতিক দল গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক সংস্থার সাহায্য নিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করেছে। নির্বাচনী প্রচার থেকে শুরু করে একেবারে নির্বাচনী বুথ, ভোট গণনা—সবটাই পরিচালিত হয়েছে পেশাদার ম্যানেজমেন্টের কর্মীদের দিয়ে। এই ধরনের পেশাদার সংস্থাকে ব্যবহার করবার ক্ষেত্রে কত টাকা খরচ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয় ।যারা ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা নিয়ে ভোটের আসরে নেমেছিল, তাদের পক্ষে সম্ভব এই ধরনের পেশাদার সংস্থাকে দিয়ে ভোটের গোটা পর্ব পরিচালনা করা। সিপিআইএম মনে করে, রামনবমীকে কেন্দ্র করে যেভাবে মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গাতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই ঘটনাক্রম নির্মাণে দুই শাসকদলেরই একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।
দলের রাজ্যকমিটির বৈঠকের পর সেলিম সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন- এই রামনবমীর ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে যেভাবে একাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সাধু সন্ন্যাসীদের মমতা রাজনীতির আসরে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের উদ্দেশ্যে নামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন, তার জেরে মধ্যবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে ভোটারদের মধ্যে একটা ধর্মের ভিত্তিতে পক্ষ অবলম্বনের প্রবণতা প্রকট হয়েছে। রাজনৈতিক অবস্থান, মতাদর্শ, কর্মসূচি ইত্যাদিকে ঘিরে যেখানে ভোটারদের অবস্থান গ্রহণ করা দরকার, সেখানে ভোটাররা অবস্থান গ্রহণ করেছেন ধর্মের ভিত্তিতে। আর তার ফলটা কালনেমির লঙ্কাভাগের মতো রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, আর কেন্দ্রের শাসক বিজেপি পরস্পর ভাগাভাগি করে নিয়েছে।

আরও পড়ুন: লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সত্যিই মহিলাদের ‘ভিক্ষা’? কী বললেন মহম্মদ সেলিম?

গোটা বিষয়টি আরও ভূমিস্তরে পর্যালোচনা করবার ভাবনা সিপিআই প্রকাশ্যে জানিয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা তাদের দলের রাজ্য কমিটির বর্ধিত অধিবেশন আগস্ট মাসে করবেন। সেই অধিবেশনের আগে, তারা সরাসরি দলীয় বৃত্তের বাইরে অথচ দলের মতাদর্শ, ভাবধারার প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষদের ভাবনাচিন্তাগুলি শুনবেন। পরমতসহিষ্ণুতা দলের বর্তমান নেতৃত্বের এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ, মনে করছেন অনেকেই।

এতদিন দলীয় রেজিমেন্টেশনের দোহাই দিয়ে দলের সদস্য ছাড়া আর কারও মতামত নেওয়ার চল ছিল না। সেলিম তাঁর নেতৃত্বের গুণে একটা জঙ্গমতাকে বাস্তবানুগ পরিস্থিতির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হচ্ছেন। কমিউনিস্ট সংস্কৃতির মধ্যে খোলা হাওয়া সঞ্চার মনে রাখবে আগামী।

সেলিম প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন— কমিউনিস্ট পার্টি মানে একটা প্রবাহমান নদী। এই অঙ্কেই শূন্য থেকে শুরু দেখছে সিপিআইএম

More Articles