'উজবুক' এসেছে উজবেকিস্তান থেকে? যে ধাঁধা লুকিয়ে এই শব্দে

Bengali Vocabulary: কোথা থেকে এল 'উজবুক' শব্দটি?

এবারের শব্দ উজবুক। শব্দটি শুনলে অনেকেই পূর্বের তাতার দেশ বা ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি দেশ উজবেকিস্তানের (বর্তমানে স্বাধীন রাষ্ট্র) কথা ভেবে নেবেন। সেটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের প্রণম্য অভিধানপ্রণেতাগণ তো সকলেই একবাক্যে উজবেকিস্তান থেকে আসা আকাট মূর্খ সৈন্যদের থেকেই এই 'উজবুক' কথাটির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন। আভিধানিক মত হলো, ইসলামি শাসনের সময় বঙ্গে নাকি উজবেকিস্তান থেকে ভাড়াটে সৈন্য আমদানি করা হতো। দৈহিক মাপকাটিতে বেশ বড়সড় হলে কী হয়, বুদ্ধিতে তারা ছিল খাটো। তাই বোকা, আহাম্মক বলে তাদের দেগে দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকেই উজবুক মানে মাথামোটা, আহাম্মক, বোকা বোঝায়।

অথচ ২০২০-র অলিম্পিকে আমরা উজবেকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতেই ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারতে দেখলাম কুস্তিতে। দাবা অলিম্পিয়াডেও ওদের কাছে হারতে হয়। ফুটবলে তাদের কাছে পাঁচ গোল খাওয়ার নজিরও আছে। তাদের মগজ যে নেহাত ফেলনা নয়, তা বেশ বোঝা যায় বিভিন্ন মুহূর্তে মস্তিষ্কের প্রয়োগ দেখে। গড় আই কিউ বা বুদ্ধ্যঙ্কের খতিয়ান দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ! উজবেকরা এগিয়ে আছে ভারতীয়দের থেকে। অ্যাভারেজ ভারতীয়র আইকিউ যখন ৮১, তখন উজবেকদের ৮৬! তাহলে বোকা কারা? বাঙালি তো নিজেই উজবুক বনে গেল।

ব্যুৎপত্তি ও অর্থের ব্যাপারে আসা এবার। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান'-এ উজবুক, উজবক এন্ট্রিতে লেখা হয়েছে, [তুর্কী°=উজবক্=তাতারদিগের একজাতি। উচ্চারণবিকারে উজবেগ্। বি, তাতারীয় জাতিবিশেষ। ২. উজবকজাতীয় সৈন্য। উদ্ধৃতি দিয়েছেন, 'যবন কিরাত শক আগুদলে উজবক, খোরাসানি মোগল পাঠান(কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী)। ৩. বিশেষণ, তাদের মত অশিক্ষিত এবং আড়বুজো; নির্বোধ; আহাম্মক। সুভাষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত সংসদ বাংলা অভিধানে পাচ্ছি, উজবুক,(অপ্র) উজবক বিণ. মূর্খ; আহাম্মক; [উজবুকের মত আবরণ(মুদ্রণপ্রমাদ, আচরণ হবে)]। তুর. উজবেগ। সংসদ অভিধানে কীভাবে যে সংস্করণের পর সংস্করণে আবরণ থেকে যাচ্ছে আচরণের জায়গায়, তা প্রকাশক বলতে পারবেন।

আরও পড়ুন: চেনা বামুনের লাগে না, কোথা থেকে এসেছে ‘পৈতে’ শব্দটি?

অশোক মুখোপাধ্যায় প্রণীত 'সমার্থশব্দকোষ'-এ উজবুক এর প্রতিশব্দগুলি হলো, 'অজবুক, বোকা, নির্বোধ, অবুদ্ধি, অবুদ্ধিমান, অবিচক্ষণ, নির্বুদ্ধি, বুদ্ধিহীন, মতিহীন, আহাম্মক, অচতুর, অকাট, আকাট, অগা, গবেট, নিরেট, বোকারাম, বোকাকান্ত, অগারাম, অগাচণ্ডী, অগামারা, হাঁদারাম, হাঁদাগঙ্গারাম, মাথামোটা, মোটামাথা, স্থূলবুদ্ধি, ভোঁতাবুদ্ধি, ডাব, ভেড়ুয়া, ভোঁদা, ভোম, ভোমা, ভেকুয়া, গাবর, গালোড়িত, নাবড়, নাদান, ল্যালা; অলবড্ডে।'

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কারও বুদ্ধিহীনতা মানুষকে কতখানি বিরক্ত করে, গাদা গাদা চোখা চোখা শব্দ সেই হাঁদামক্কাল তথা বোকার দিকে ধাবিত হয়!

সুশীলকুমার দের 'বাংলা প্রবাদ' বইয়ে উজবুক দিয়ে কোনও প্রবাদ নেই। শব্দটি যে বাংলা বাগধারায় ধর্তব্যের মধ্যেই আসেনি, এটা ভেবেই অবাক হতে হয়। তাহলে কি 'উজবুক'-এর শিকড় প্রবাদের ততটা গভীরে বিস্তৃত নয়?

রাজশেখর বসুর চলন্তিকা-য় পাচ্ছি উজবুক। যথারীতি বলা হয়েছে তুর্কী উজবেক থেকে আসছে, উজবেক বোঝাতে তাতারজাতির উল্লেখ করা হয়েছে। জামিল চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান জানাচ্ছে, শব্দটির ব্যুৎপত্তি তুর্কী 'উজবেক' থেকে।

বস্তুত কোনও প্রামাণ্য অভিধানেই উজবুক শব্দটি তুর্কি 'উজবেক' থেকে আগত বলা ছাড়া আর কোনও ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়নি।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ পাই উজবুক এবং অজবুক, এই দুটি এন্ট্রি। উজবুক বিষয়ে লেখা হয়েছে, [তুর্কী উজবক্; English uzbeg, usbeg (Century Dictionary) ; uzbeg – a member of the Turkish family of Tartars in Turkistan &–Davidson] ১ তাতারের জাতিবিশেষ, তজ্জাতীয় সৈন্য, 'যবন কিরাত শক, আগুদলে উজবক' (কবিকঙ্কণ) ২ (সাদৃশ্যে) অসভ্য, মূর্খ, আনাড়ি, উজবুক।

'অজবুক' বিষয়ে লেখা হয়েছে, বিং [তুর্কী উজবক্] মূর্খ, আনাড়ী, বেকুফ। "ওরা যে আমাদের অসভ্য অজবুক মনে করে যাবে"(ঘরে বাইরে-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। "তোর সোয়ামী নাকি অজবুক হয়েছেন, তাই এমন কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন"(সাবাস আটাশ- অমৃতগ্রন্থাবলী)।

সুবলচন্দ্র মিত্র তাঁর 'সরল বাঙ্গালা অভিধান'-এ কিন্তু গতানুগতিক রাস্তায় হাঁটেননি। 'উজবুক' শব্দটির ব্যুৎপত্তিতে তিনি উজবেকিস্তানের তত্ত্ব দেননি। শব্দটিকে 'বাংলা প্রচলিত' বলে উল্লেখ করেছেন।

অজবুক শব্দটি অশোক মুখোপাধ্যায়ের 'সমার্থশব্দকোষ' ও হরিচরণ মুখোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ উল্লিখিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ঘরেবাইরে' উপন্যাসে অজবুক শব্দটিই ব্যবহার করেছেন, উজবুক নয়। উজবুক শব্দটি কি আদতে ছিল অজবুক? এই অজবুক নিয়ে ভাবতে ভাবতে 'অজমূর্খ' শব্দটি মনে স্ট্রাইক করল। তাহলে অজমূর্খ কি কোনও সময় 'অজবোকা' হয়ে গিয়েছিল? মানে নিরেট বোকা, আসল বোকা! অজ শব্দটি তো আদ্য থেকে জাত। বঙ্গীয় শব্দকোষে পাই, সং আদ্য > প্রা. অজ্জ > বা অজ। মানে আদি, আদৎ, খাঁটি, আসল। প্রয়োগ দৃষ্টান্ত,

অজ পাড়া-গাঁ, অজ চাষা, অজ বঞ্জর (পতিত জমি), অজ মূর্খ ইত্যাদি।
অজবোকা > অজবুকা > অজবুক > উজবুক?
এইভাবেই এসেছিল উজবুক?

এবং তাকেই আমরা উচ্চারণ-সাদৃশ্যের জন্য 'উজবেক' থেকে আগত বলে ভেবেছি এতদিন? হতেই পারে। অভিধানকাররা যা-ই বলুন না কেন এতদিন।

অজবোকা শব্দটি অভিধানে পাইনি। কিন্তু সাহিত্যে প্রয়োগ আছে। আমি অন্তত দু'জায়গায় পেয়েছি 'অজবোকা' শব্দটি। ১৩৪৪ সালে প্রবাসী পত্রিকায় বিভূতিভূষণ গুপ্ত রচিত 'অভাবনীয়' নামক ছোটগল্পে 'অজবোকা' শব্দটি পাওয়া গেছে। চলিত ভাষায় লিখিত এই সাবলীল গল্পটি থেকে একটু উদ্ধৃতি দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

লক্ষ্মী একটু উষ্ণ হয়ে উঠল, 'ওকে নিয়ে কোথাও যেতে আমাদের লজ্জা করে। না-আছে কথার ছিরি, না-আছে চলবার ছিরি, একেবারে অজবোকা। মিথ্যে ওকে নিয়ে ঝঞ্ঝাট বাড়াবেন না।'

তাহলে, বাংলাভাষায় 'অজবোকা' শব্দটি একসময় চালু শব্দ ছিল। অজমূর্খ শব্দটি ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন লেখকের লেখায়, 'অজবোকা' কিন্তু আর ব্যবহার হতে দেখি না। সে জায়গাটি দখল করেছে উজবুক শব্দটি।

শুধু বিভূতিভূষণ গুপ্তর ছোটগল্পেই নয়, 'অজবোকা' শব্দটি পাই ১২৮৬ সালে রচিত দুর্গাচরণ রায়ের 'পাশকরা ছেলে' নাটকে। সেখানে দেখি একটি চরিত্রের মুখে সংলাপ, '... দেশের সব লোকগুলাই বোকা, অজবোকা।...'

তাহলে সত্তর-আশি বছর আগেও অজবোকা বাংলায় চালু শব্দ ছিল। তারপর কোনও একসময় অজবোকা অজবুক হয়ে উজবুক-এ পরিণত হল। আমরাও উজবুকের মত শব্দটিকে উজবেকিস্তানের অধিবাসী উজবেক-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেললাম। সুবলচন্দ্র মিত্র ছাড়া কোনও অভিধানপ্রণেতাই অন্য কিছু বলার সাহস পাননি। যদিও তিনিও মিসিং লিঙ্কটা ধরতে পারেননি।

যা হোক, এটাই স্বস্তির কথা যে ভুলটা ধরা পড়ল শেষ পর্যন্ত। বাঙালি অভিধানপ্রণেতাদের নাকানিচোবানি খাইয়ে ছেড়েছে 'উজবুক' শব্দটি। তবে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে 'অজবোকা' শব্দটি ধরতে পারতেন তাঁরা। অজমূর্খ শব্দটি তো হাতের কাছেই ছিল। কিন্তু গালভরা উজবেক-তত্ত্বকে তাঁরা উপেক্ষা করতে পারেননি। আমার কোনওকিছু হারানোর ভয় নেই। তাই সপাটে ব্যাট চালাই। যদি সত্যিটা ধরা যায়। প্রহেলিকার যবনিকাপাত করা যায়! বেটার লেট দ্যান নেভার!

More Articles