পগেয়া শব্দটি আসলে গালাগালি না প্রশংসা? বাংলা ভাষার আজব কেরামতি

পগেয়াপাজি, পগেয়া বদমায়েস, পগেয়া শয়তানের কী মানে দাঁড়াবে? দরকারে কাকুতমিনতি করে, এমন বদমাশ? অসৎ ব্যক্তির মিথ্যা প্রশংসাসূচক কথা বলে, টুপি মেরে টুপাইস কামিয়ে নেওয়া?

আজকের শব্দ 'পগেয়া'। একসময় রীতিমতো চালু শব্দ ছিল এটি। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও কথায় লোককে বলতে শুনতাম, পগেয়া বেগুন, পগেয়া কাতলা, পগেয়া কুমড়ো, পগেয়া হাঁড়ি, পগেয়া বদমাশ, পগেয়াপাজি ইত্যাদি। এখনও মাঝেমধ্যে শুনি বইকি। আকারপ্রকারে বড়, একনম্বর জিনিসই হল পগেয়া। আর এই একনম্বরি ব্যাপারটা যেমন ভালোর দিকে, তেমনই খারাপের দিকেও। নাহলে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখক তাঁর 'রক্তের দাগ' গল্পে কেন লিখতে যাবেন, "ছোঁড়া পগেয়া পাজি!"

অথচ কী আশ্চর্য, বাংলা ভাষার কোনও অভিধানে 'পগেয়া' শব্দটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ', জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান', সংসদ বাংলা অভিধান, রাজশেখর বসুর 'চলন্তিকা', সুবলচন্দ্র মিত্রর 'সরল বাঙ্গালা অভিধান'- কোথাও নেই পগেয়া শব্দটি। এমনকী, বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির 'আধুনিক বাংলা অভিধান'-এও নেই। নেই ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ সংকলিত 'বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান'-এও।

শুধু গোলা লোকে নয়, পগেয়া শব্দটি ব্যবহার করে গিয়েছেন বিখ্যাত সাহিত্যিকরা। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধসংগ্রহে এক জায়গায় লিখেছেন, "ঘোড়া যে বিদেশ থেকে এসেছে, তার প্রমাণ ঘোড়ার নামেই পাওয়া যায়, যথা, পগেয়া, ভুটিয়া, তাজি, আরবি ইত্যাদি।" আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রকৃত অর্থেই 'পগেয়া' লেখক। 'রক্তের দাগ'-এ যেমন 'ছোঁড়া পগেয়া পাজি' লিখেছেন, 'আদিম রিপু'-তে একজায়গায় লিখেছেন, 'অনাদিটা ছিল পগেয়া শয়তান' আর 'আংটি'-তে লিখেছেন, "দেখলুম, ও শালা পগেয়া বদমায়েসকে সহজে ঘায়েল করা যাবে না।" বোঝাই যাচ্ছে, 'পগেয়া' শব্দটির ওপর তাঁর বিশেষ রকমের পক্ষপাতিত্ব ছিল। তাই কথায় কথায় চরিত্রের মুখে 'পগেয়া' বসিয়েছেন। তাঁর লেখার পগেয়া পাঠকরাও তারিয়ে তারিয়ে সেসব উপভোগ করেছেন।

আরও পড়ুন: অশ্লীল বলে অভিধানে নেই, কোথা থেকে এল ‘গ্রামভারি’ শব্দটি?

'পগেয়া' শব্দটিকে কেন অভিধানভুক্ত করা হয়নি, তা ভাবতে ভাবতে মনে হলো, শব্দটি নিয়ে অভিধানকারদের ছুঁৎমার্গ ছিল না তো? অকুলীন বা অশ্লীল ভেবে তাঁরা পগেয়া শব্দটিকে দূরে সরিয়ে রাখেননি তো?

খুলতেই হলো, অভ্র বসুর লেখা 'বাংলা স্ল্যাং, সমীক্ষা ও অভিধান' বইটি। দেখা গেল, অনুমান সত্যি। এই বইটিতে আছে 'পগেয়া' শব্দটি। তবে বিশেষণ না বলে বিশেষ্য বলা হয়েছে। অথচ অর্থ দেওয়া হয়েছে, 'অত্যন্ত, প্রচণ্ড'। ব্যুৎপত্তি দেওয়া নেই, বলাই বাহুল্য। পগেয়ার মধ্যে কী এমন অশ্লীলতা আছে যে, শব্দটিকে মান্য অভিধানগুলিতে রাখা হলো না, রাখা হলো স্ল্যাং-কোষ-এ?

তা না হয় হলো, পগেয়া-র ব্যুৎপত্তি কোথায় পাওয়া যাবে? এটি যে তৎসম শব্দ নয়, তা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয় না, তদ্ভব না দেশি, তা জানতেই খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। ড. সত্যনারায়ণ দাশের 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ' বইটিতে পগেয়া নেই। তার মানে দ্রাবিড় ভাষাগুলি থেকে শব্দটি আসেনি। আবার অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাসের লেখা 'সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান'-এও নেই শব্দটি। তাই অস্ট্রিক, মুন্ডারি, এসব ভাষা থেকেও পগেয়ার আগমন ঘটেনি।

অতএব, তদ্ভব ধরেই এগোতে হল। ধ্বনিসামঞ্জস্য ও অর্থসামঞ্জস্য দেখে যে-দু'টি শব্দকে চিহ্নিত করলাম, সে-দু'টি হল, প্রাগ্র্য ও প্রাগ্রহর। দু'টি শব্দের মানেই শ্রেষ্ঠ বা প্রধান।

'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ 'প্রাগ্র্য' শব্দটির ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে, [ প্রাগ + য(যৎ) ] প্রাগ্রহর-এর ব্যুৎপত্তি, [প্রাগ + √হৃ + অ(অচ্)-ক]। 'প্রাগ্র্য' শব্দটিকে প্রাকৃত ও অপভ্রংশ পথ পার হয়ে পগেয়া হতে হয়েছে। এইভাবে সেটা সম্ভব হতে পারে, প্রাগ্র্য > পাগগয়া > পাগগেয়া > পাগেয়া > পগেয়া। 'প্রাগ্রহর' শব্দটিও পগেয়া-য় রূপান্তরিত হতে পারে এইভাবে– প্রাগ্রহর > পাগগহঅ > পাগগয়া > পাগেয়া > পগেয়া।

প্রাগ্র্য বা প্রাগ্রহর, যা থেকেই আসুক না কেন, পগেয়া একটি নির্ভেজাল তদ্ভব শব্দ। অর্থ যে প্রধান, শ্রেষ্ঠ বা সবচেয়ে বড়, তা বোঝাই যাচ্ছে। কলকাতার বড়বাজারে 'পগেয়াপট্টি' বলে একটি জায়গাও আছে। অতীতে এখানে যে সেরা জিনিসের বাজার বসত, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিংবা এই পট্টি বা অঞ্চলটিই হয়তো ছিল বড়বাজারের মধ্যে সবচেয়ে বড় মোকাম। ড. সুকুমার সেন লিখেছেন, এখানে পাগড়ি ও রঙিন বস্ত্রের বিকিকিনি হতো। সেটা হতেও পারে, নাও হতে পারে। আবার সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী একজায়গায় লিখেছেন, পগেয়া জাতের ঘোড়ার বাজার ছিল পগেয়াপট্টি। বিক্রি যা-ই হোক না কেন, পণ্য সেরা মানের হলেই হল!

আরবি-ফারসি থেকে যে 'পগেয়া' শব্দটি আসেনি, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কারণ মোহাম্মদ হারুন রশিদ সংকলিত বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের অভিধানে 'পগেয়া' বা কাছাকাছি ধ্বনির কোনও শব্দ পাইনি। আখতারুজ্জামান বিরচিত আরবি-ফারসি-বাংলা অভিধানটিতেও পগেয়া বা পগেয়া-র কাছাকাছি কোনও শব্দ নেই। পগেয়া নেই ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমানের আরবি-বাংলা অভিধানেও। তাই নিশ্চিতভাবেই পগেয়া আরবি-ফারসি-উর্দু থেকে আসেনি।

বিদেশি ভাষাগুলির মধ্যে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, গ্রিক, স্প্যানিশ, জাপানি, চাইনিজ থেকেও আসেনি। এগুলির খোঁজ নিতেই হয়, নাহলে নিজস্ব সিদ্ধান্তে ফাঁক থেকে যায়। বাংলাদেশে 'পগেয়া' শব্দটির চল নাকি একেবারেই নেই। কেন, তা জানি না। বাংলাদেশি বন্ধুরা কেউ সেভাবে শোনেননি শব্দটি। এই বঙ্গে 'পগেয়া' রীতিমতো প্রচলিত শব্দ। এই ভৌগোলিক ভেদাভেদের কারণ কী, তাও গবেষণাসাপেক্ষ।

'পগেয়া' শব্দটি নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনে হচ্ছে, শব্দের পরিক্রমার যেন শেষ নেই। 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ' বইটিতে ডা. সত্যনারায়ণ দাশ 'পগানো' বলে একটি ক্রিয়াপদের উল্লেখ করেছেন। এটি তামিল, তেলুগু, কন্নড় থেকে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে। অর্থ ছলচাতুরি করে আদায় করা, মিথ্যা প্রশংসাসূচক বাক্য বলে, মন জুগিয়ে কথা বলে কাউকে হাত করা। অভ্র বসুর স্ল্যাং-অভিধানে এই শব্দটিকে 'পকানো' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থ দেওয়া হয়েছে, কাকুতিমিনতি করে কিছু আদায় করা। তাহলে ছেলেবেলায় শোনা 'পগিয়ে' বা 'পগিয়ে-পাগিয়ে'-র মতো ক্রিয়াবাচক পদগুলি থেকে কি আসতে পারে পগেয়া? মানে কাউকে ভজিয়েভাজিয়ে বা জপিয়ে কিছু পাওয়া? তাই বা কী করে হয়! তাহলে পগেয়াপাজি, পগেয়া বদমায়েস, পগেয়া শয়তানের কী মানে দাঁড়াবে? দরকারে কাকুতমিনতি করে, এমন বদমাশ? অসৎ ব্যক্তির মিথ্যা প্রশংসাসূচক কথা বলে, টুপি মেরে টুপাইস কামিয়ে নেওয়া? আমি মোটেই নিশ্চিত নই পগানো-র সঙ্গে পগেয়ার কোনও যোগ আছে কি না, সে বিষয়ে। তবু এটার উল্লেখ করলাম উৎসাহী পাঠকের জন্য‌।

প্রাগ্র্য থেকেই আসুক বা প্রাগ্রহর থেকেই আসুক, পগেয়া শব্দটি আমাদের স্মৃতিতে চিরজাগরূক হয়ে থাক, এটাই প্রার্থনা। সদ্যপ্রকাশিত কোনও লেখা পড়ার জন্যে ওৎ পেতে থাকা পগেয়া পাঠকের কথা না বললে এই লেখা সম্পূর্ণ হবে না। শেষ কথা তো তাঁরাই বলবেন।

More Articles