২০১৪-র সেই বিষবৃক্ষই আজ স্বৈরাচারের মহীরুহ
Modi, PM Of India: মোদি দেশের অর্থনীতিকে আজ যে জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, সেখানে ১ শতাংশ অতি-ধনীর হাতে দেশের ৪৫ শতাংশ সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। দেশের ২২ কোটি মানুষ এখনও চরম দারিদ্রসীমার নীচে।
বিগত এক দশকের বিজেপি সরকার দেশের মানুষের দৈনন্দিন রুটি-রোজগার, বাক্স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, নাগরিক সুযোগসুবিধা, বিশেষত বেছে নেওয়ার অধিকার— সবকিছুকেই এক চরম ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গিয়েছে। বিজেপি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নির্বাচনী মুখ, এই প্রথম সঙ্ঘের প্রস্তাবিত ও পরিকল্পিত ভারত-রাষ্ট্র গঠনের দিকে এত দ্রুত এগিয়ে চলেছে তারা। আর এই কাজকে ত্বরান্বিত করার দায়িত্ব যিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছেন, তিনি বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। বিভিন্ন মহলে যতই এই কথা চারিয়ে দেবার চেষ্টা হোক, যে মোদির নিজেকে ঘিরে ব্যক্তি-কাল্ট তৈরির সার্বিক উদ্যোগ এবং স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে দানবিক স্বৈরাচারী সরকার গড়ে তোলার কাজে আরএসএস সন্তুষ্ট নয়, আসল সত্য হল এরা সকলেই সঙ্ঘ পরিবারের সামগ্রিক ইকোসিস্টেমের অংশ। ১৯৯৬ সালে সমাজ-মনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দী মোদির একটি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে শিউরে উঠেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল এই ব্যক্তি একজন পুরোদস্তুর ডিক্টেটর এবং ফ্যাসিস্ত পার্সোনালিটির অধিকারী। এই লোকসভা নির্বাচনের প্রচারকালেই মোদির অন্যতম সহচর বিজেপি নেতা জগৎ প্রকাশ নাড্ডা সিকিমে একটি নির্বাচনী জনসভায় বলেছেন— “এক দেশ এক পার্টি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবার সময় এসে গিয়েছে। আসুন আঞ্চলিক দলগুলিকে বিদায় জানিয়ে সকলেই বিজেপিকে সর্বত্র নিয়ে আসি”। অর্থাৎ, খোলাখুলি টোটালিট্যারিয়ান, ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলার ডাক। আরএসএস-এর দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক সদাশিব মাধব গোলওয়ালকর তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’-এ ঠিক এইধরনের চূড়ান্ত কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র-নির্মাণের আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ করেছিলেন। ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ আদতে একটি চূড়ান্ত অথরিটারিয়ান, ফ্যাসিস্ত, মেজরিটারিয়ান রাষ্ট্র, যেখানে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কিছুই থাকবে না।
তাই বলে সেই রাষ্ট্রে কারও কি কোনও অধিকারই থাকবে না? ২০২৪-এর নির্বাচনে মোদি যদি প্রয়োজনীয় সংখ্যা নিয়ে আরও এক বার ফেরেন, তাহলে যে ‘নতুন ভারতে’ আমরা প্রবেশ করব সেটা হয়ে দাঁড়াবে চরম ক্ষমতাশালী কিছু রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত-বিগ কর্পোরেট-মিলিটারি জেনারেলদের নিয়ে সংগঠিত এক যুদ্ধবাজ সার্ভিলেন্স একনায়কতন্ত্র, যেখানে সমস্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষীগত হবে এক মুষ্টিমেয় অংশের হাতে। এমনিতেই মোদি দেশের অর্থনীতিকে আজ যে জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, সেখানে ১ শতাংশ অতি-ধনীর হাতে দেশের ৪৫ শতাংশ সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। দেশের ২২ কোটি মানুষ এখনও চরম দারিদ্রসীমার নীচে। বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব আজ ভারতবর্ষে। অর্থনীতিবিদ পরাকলা প্রভাকর তাঁর ‘দ্য ক্রুকেড টিম্বার অফ নিউ ইন্ডিয়া’ বইতে স্পষ্ট দেখিয়েছেন, ১৯৯০-এর দশকের পর, এই প্রথম ভারতে দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এত দ্রুত গতিতে বাড়ছে। এই মুহূর্তে ইউএনডিপি গ্লোবাল হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স-এ ১৯১টি দেশের মধ্যে ভারতের দারিদ্রসূচক ১৩২। ইংরেজি ‘এ’ থেকে ‘জেড’ অবধি একটিও অক্ষর পাওয়া যাবে না, যা দিয়ে দু-দশকের বিজেপি জমানার দুর্নীতিগুলোকে চিহ্নিত করা যাবে না। সে ‘রাফাল’ বিমান দুর্নীতিই হোক বা বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংগঠিত রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’-ই হোক। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ভারত কি আরও একটা ‘হিন্দু পাকিস্তান’-এ পরিণত হবে? যেখানে সাধারণ মানুষের রুটি জোটে না, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র প্রায় উধাও, দেশের যাবতীয় ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ধর্মগুরু-সন্ত্রাসবাদী আর মিলিটারি জেনারেলদের অনৈতিক জোট?
আরও পড়ুন: দেশেবিদেশে কতটা রয়েছেন গান্ধি? ভোটের বাজারে আদৌ কতটা সত্যি বলেন মোদি?
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের যে দুই তাত্ত্বিক বিজেপির ‘ইকোনমিক ন্যাশনালিজম’-এর উদ্ভাবক, তাঁরা হলেন দত্তাপত্তি থেঙ্গাডি এবং এম জি বোকরে। প্রথমজনের লেখা বইয়ের নাম ‘থার্ড ওয়ে’, দ্বিতীয়জনের বইটি হল ‘হিন্দু ইকোনমিকস’। বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু এই স্বদেশী অর্থনীতির নিজস্বতাকেও অস্বীকার করে আজকের বিজেপি এগিয়ে চলেছে ‘গুজরাট মডেল’ নামক এক সর্বগ্রাসী ‘ক্রোনি পুঁজি’-নির্ভর অর্থনীতিতে ভর করে, যা জল-জমি-জঙ্গল, প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদের সার্বিক কর্পোরেট লুন্ঠনের নীল নকশার বাস্তবায়ন। এই লুটের অর্থনীতির সঙ্ঘী তাত্ত্বিক হলেন ‘হোয়াই গ্রোথ ম্যাটারস’ গ্রন্থের লেখক জগদীশ ভগবতী। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অতি-দক্ষিণপন্থী অর্থনীতিবিদই প্রথম পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন— অমর্ত্য সেন বা জোসেফ স্টিগলিৎজ-এর ভাবনা বাতিল করে, নেহেরুর অর্থনৈতিক প্যাটার্ন ভেঙে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বাণিজ্য ও শ্রম আইন সংস্কার, বাজারের হাতে অর্থনীতিকে সর্বতোভাবে ছেড়ে দেওয়া এগুলোকে তিনিই দৃঢ়ভাবে সূত্রবদ্ধ করেন। যার সর্বোচ্চ রূপ আজ ভারতের আর্থিক নীতিতে দেখা যাচ্ছে।
এর পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনৈতিক ‘হিন্দুত্বে’র আস্ফালন কেবল সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছেই আতঙ্কের নয়, তা হিন্দু ধর্মের অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা স্তরের লোকজন ও দেশের কুড়ি কোটি আদিবাসীকেও বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে। আরএসএস-এর মতো ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুবাদী, নারীবিদ্বেষী সংগঠন যে ‘হাইড্রা’র মতো অজস্র মুখ দিয়ে গিলে খেতে চাইছে ভারতীয় সমাজকে, তা আজ স্পষ্ট। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত ‘হাউ টু স্পট আ ফ্যাসিস্ত’ বইতে উমবের্তো একো বলেছিলেন, ফ্যাসিস্তরা ‘মডার্ন’ হয়েও ‘ট্র্যাডিশনালিজম’-এর কথা বলে এবং তাদের চোখে ‘ট্র্যাডিশনালিজম’-এর অর্থ হল আধুনিকতা, এনলাইটেনমেন্ট ও এজ অফ রিজন-কে অস্বীকার করা— ‘In this sense, Ur-Fascism can be defined as irrationalism’। ‘আমার বায়োলজিকাল জন্ম নয়, খোদ পরমাত্মা আমার জন্ম দিয়েছেন’— মোদির এই দম্ভোক্তি আসলে কুসংস্কারে আছন্ন এই দেশে সেই ‘অযুক্তি’র মোড়কে স্বৈরাচারকে ডেকে আনা।
আরও পড়ুন: ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইতিহাসে কটূক্তিতে সেরা মোদিই! উত্তরসূরিকে নিয়ে যা বললেন মনমোহন
স্বাধীনতার পর থেকে সাময়িক কালক্রম বাদ দিলে দেশ শাসন করেছে জাতীয় কংগ্রেস। জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধি, রাজীব গান্ধি, নরসিমহা রাও, মনমোহন সিং তাঁদের সময়ের বাস্তবতা অনুযায়ী দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি চালিয়েছেন। স্বাধীনতার সময় যে দেশের গড় আয়ু ছিল ৩০ বছর আর স্বাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, সেই দেশে যে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংসদীয় ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সেক্টর-নির্ভর ‘ওয়েলফেয়ার পলিটিক্স’ টিকে গেল, তার জন্য নেহেরুকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। ‘অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা’র মতো চরম সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধি মোটের উপর ওয়েলফেয়ার রাজনীতিকেই মান্যতা দিয়েছেন, যদিও তাতে দেশের দারিদ্র দ্রুত হারে কমেনি। কিন্তু নেহেরু বা ইন্দিরা ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি বহুল বাধা আসা সত্ত্বেও। সেই আত্মসমর্পণের সূচনা ঘটে রাজীব গান্ধির আমলে, রামমন্দিরের জং-ধরা তালা খোলা ও শাহবানু মামলার মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে। যে হিন্দুত্বের শক্তি ১৯৮০ সালে ‘ভারতীয় জন সঙ্ঘ’ ভেঙে দিয়ে ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ গড়ে তুলল এবং দুর্বল কংগ্রেসি নেতৃত্ব, দুনিয়াজোড়া সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মাত্রই দু-দশকের মধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে পৌঁছে গেল, তাকে আটকানোর মতো পাকা মাথার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এর পরে কংগ্রেসে আর আসেনি। ইউপিএ ওয়ান ও টু সরকারের আমলে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির সপক্ষে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও একের পর এক দুর্নীতি ও ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হয়েছে ভারতবাসীকে। সমাজতত্ত্ববিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় একটি লেখায় বলেছিলেন, ২০১৪ সালে যে ভাবে ভারতের গোটা কর্পোরেট শ্রেণি মোদিকে জেতাতে এগিয়ে এসেছিলেন, তা ভারতের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। সেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিমুখই আজ বিষবৃক্ষের চেহারা নিয়েছে।
ভারতের মাটিতে রাহুল গান্ধির রাজনৈতিক উত্থান কি এক নতুন সূর্যোদয়ের সম্ভাবনা তৈরি করছে? আরও বহু সহ-নাগরিকের মতই আগ্রহে, অপেক্ষায় দিন গুনছি।