অন্য সৌরজগতে প্রাণের হদিশ দেবে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ?
জেমস ওয়েব হয়তো আমাদের সেই উত্তরটা দিতে পারবে, যে উত্তর আমরা এতদিন ধরে খুঁজে চলেছি। অন্য কোথাও প্রাণের সন্ধান পাওয়ার জন্য এই প্রথম মানবজাতির কাছে এত শক্তিশালী এক যন্ত্র এসেছে।
১৮৯৫ সালে এইচ জি ওয়েলসের একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। কল্পবিজ্ঞানের আখ্যান, নাম ছিল 'The Time Machine'। সেই মেশিনে চেপে মানুষ অতীতে বা ভবিষ্যতে যাত্রা করতে পারত। ওয়েলসের উপন্যাসের নায়ক যাত্রা করেছিল ভবিষ্যতে। আজ এমন একটা যুগ এসেছে, যখন একের পর এক কল্পবিজ্ঞানের ভাবনা বাস্তবে রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি দেখে লেখকরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, কল্পবিজ্ঞান লেখার দিন হয়তো ফুরিয়ে এলো।
কিন্তু এখনও মানবসভ্যতা তা সম্ভব করে উঠতে পারেনি, ওয়েলসের ভাবনা হুবহু বাস্তবে রূপান্তরিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু মানুষ এমন এক যন্ত্র বানিয়ে ফেলেছে, যা তাকে চাক্ষুষ করাচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রায় সৃষ্টি হওয়ার মুহূর্তের কাছাকাছি সময়কে। সেই মুহূর্তের, বা বিগ ব্যাং-এর কয়েক লক্ষ বছর পরের মুহূর্ত, যা আজ থেকে ১৩০০ কোটি বছর আগের কথা, সেই ছবিও আজ স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে মানুষ। যন্ত্রের নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। আজ থেকে ছ'মাস আগে পৃথিবী থেকে পনেরো লক্ষ কিলোমিটার দূরে গিয়ে নিজের ডানা মেলে ধরেছে আস্তে আস্তে, নিজেকে প্রস্তুত করেছে। একটা ছোট্ট দুর্ঘটনার শিকারও হয়েছে, কিন্তু সামলে নিয়েছে। তারপর উপহার দিয়েছে এমন সব ছবি, যা দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না মানবজাতির। একটু পিছনের দিকে তাকানো যাক। জেমস ওয়েব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অতীতের ছবি দেখাবে। আমরা একটু জেমস ওয়েবের ইতিহাস দেখে নিই।
সময়টা নয়ের দশক। ওয়েবের পূর্বসূরি হাবল টেলিস্কোপ কিছু মাস হলো সবে পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে ছবি তোলা শুরু করেছে। হাবলের প্রথম ছবিগুলি মোটেই সাড়াজাগানো ছিল না, বেশ হতাশাজনক ছিল। কিন্তু খুব শীঘ্রই সে নিজের আসল কেরামতি দেখাতে শুরু করে। আসতে থাকে অবিশ্বাস্য সব ছবি। তা দেখে চরম উৎসাহী হয়ে পড়েন নাসার বিজ্ঞানীরা। সেই সময় থেকেই ভাবনাচিন্তা শুরু হয়, পরিকল্পনা শুরু হয় এমন একটি টেলিস্কোপ বানানোর, যা একটি আয়না নয়, বরং একাধিক আয়নার মাধ্যমে ছবি তুলবে এবং ভেদ করবে সেইসব রহস্য, যা হাবলের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: কয়েকশো কোটি বছর পুরনো মহাবিশ্বের ছবি কীভাবে উঠে এল টেলিস্কোপে? বিস্ময় পৃথিবীজুড়ে
শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ২০০৭ সালে ওয়েবকে মহাকাশে পাঠানোর। খরচ ভাবা হয়েছিল ৫০০ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন ডলার। কিন্তু কাজ শুরু করতেই বোঝা গেল যে, এই যন্ত্র পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম জটিল এক যন্ত্র হতে চলেছে, এত কম খরচে একই নির্মাণ করা অসম্ভব, সময়সীমাও একেবারেই যথেষ্ট নয়। অবশেষে এর নির্মাণ-খরচ এসে দাঁড়াল দশ বিলিয়ন ডলারে।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, এত পরিমাণ অর্থ এবং পরিশ্রম বৃথা যাবে না। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে, খরচ বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছয়, যেখানে নাসা-র একার পক্ষে এই প্রকল্প আর টানা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় ইউরোপিয়ান এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি। আর খরচ এত বাড়বে নাই-ই বা কেন? হাবলের ব্যাসের আড়াই গুণ, এবং একশো গুণ বেশি সংবেদনশীল এই টেলিস্কোপ। এই টেলিস্কোপ আলোর সেই তরঙ্গকে ধরবে, যা মানুষের চোখে ধরা পড়বে না। শুধু কি তাই? বৈশিষ্ট্যে ঢোকার আগে আরও একটি অধ্যায় ছুঁয়ে যাওয়া প্রয়োজন, যা যথেষ্ট বিড়ম্বনার সম্মুখীন করেছিল নাসা-কে।
যে মানুষটিকে স্মরণ করতে এই নামকরণ, তিনি হলেন জেমস ই ওয়েব। নাসার একদম শুরুর দিকে তিনিই ছিলেন প্রধান অধিকর্তা। বিখ্যাত অ্যাপোলো প্রোগ্রাম তাঁর নেতৃত্বেই সফল হয়। ২০০২ সালে এই নামকরণ হয়। কিন্তু বিতর্ক দানা বাঁধে, যখন সামনে আসে তার অন্ধকার অতীতের কথা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাসা-র সমকামী কর্মীদের চূড়ান্ত বৈষম্য করেছেন। সেই বিষয়টা জানাজানি হতেই অনেকে দাবি করেন এই টেলিস্কোপের নাম পাল্টে ফেলার। কিন্তু নাসা জানায় তা আর সম্ভব নয়।
এবার আসা যাক এর বৈশিষ্ট্যে। সাধারণ টেলিস্কোপ মূলত ৩৮০ থেকে ৭৪০ ন্যানোমিটারের আলোকতরঙ্গ দেখতে পায়। ঠিক মানুষের চোখের মতো। হাবলের ক্ষমতা এর চেয়ে বেশি। হাবল অতিবেগুনি রশ্মি দেখতে পায়, সেই সঙ্গে Infrared বা অবলোহিত রশ্মিও দেখতে পায়।
কিন্তু জেমস ওয়েবের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্য মাত্রায় চলে গেছে। জেমস ওয়েব মানুষের বানানো সব থেকে শক্তিশালী টেলিস্কোপ। ৬০০ থেকে ২৮,০০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত আলোকতরঙ্গ দেখতে পাবে এই যন্ত্র। সবুজ এবং নীল নয়, শুধু কমলা এবং লাল। অনেক কিছু মহাজাগতিক বস্তু বা ঘটনাই এই Infrared-এই শুধু দেখা যায়, কারণ তার আলোকতরঙ্গ খুব লম্বা হয়। সেগুলি দেখার জন্য জেমস ওয়েব আদর্শ।
কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কারণে পৃথিবী থেকে এমন কোনও যন্ত্র কাজ করবে না। এমনকী, পৃথিবীর কক্ষপথে থাকলেও তা সম্ভব নয় কারণ পৃথিবীর তাপ বিকিরণের কারণে নিজস্ব ইনফ্রারেড রশ্মি তৈরি হয়। তাই এমন কোনও জায়গায় জেমস ওয়েবকে কাজ করতে হতো, যা যে কোনও প্রকার তাপের উৎস থেকে দূরে।
L2 পয়েন্ট বা ল্যাগারেজ পয়েন্ট বলে একটি জায়গা আছে, যা পৃথিবী থেকে পনেরো লক্ষ কিলোমিটার দূরে। জায়গাটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সেখানে সূর্য এবং পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল সমানভাবে কাজ করে। সেই সঙ্গে সূর্য এবং পৃথিবীর অভিমুখ সব সময় ওয়েবের একদিকে থাকবে। এইভাবে রাখার আরও একটি কারণ হলো, ওয়েবের একটি শীতল দিক থাকবে, এবং একটি উষ্ণ। শীতল দিকটি পর্যবেক্ষণের কাজ করবে এবং উষ্ণ দিকটিতে থাকবে সোলার প্যানেল, যা পৃথিবীর সঙ্গে ওয়েবের যোগাযোগ বজায় রাখবে।
কিন্তু বিপদ একটাই। হাবল পৃথিবী থেকে মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার দূরে কাজ করেছে, তাকে গিয়ে মেরামত করা সম্ভব। কিন্তু জেমস ওয়েব পৃথিবী এবং চাঁদের তিন গুণ বেশি দূরে আছে। কোনও যন্ত্রাংশ বিগড়ে গেলে তাকে আর সারানো সম্ভব নয়। যে কারণে নাসার এই কাজে দু'দশকেরও বেশি সময় লেগেছে।
জেমস ওয়েবের ছবি তোলার জন্য প্রয়োজন হিমশীতল অবস্থা। পনেরো লক্ষ কিলোমিটার দূরেও তাকে সূর্য এবং পৃথিবীর তাপ থেকে বাঁচাতে প্রয়োজন পড়ছে পাঁচটি পর্দা, যার এক একটির মাপ একটি টেনিস কোর্টের সমান। তা ছাড়া এতে রয়েছে ১৮টি ষড়ভূজ আয়না, যার সম্মিলিত ব্যাস ৬.৫ মিটার, এবং এই আয়নাগুলি সোনায় বাঁধানো।
এবার আসা যাক ওয়েবের মিশনে। আগামী কুড়ি বছর ধরে কাজ করবে ওয়েব। এর মিশন বা উদ্দেশ্য যদি ছোট করে বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে, জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার দিশা সম্পূর্ণ ভাবে বদলে দেওয়াই হল এর কাজ। এমনি এমনি টাইম মেশিন বলা হচ্ছে না ওয়েবকে। ১৩.৬ বিলিয়ন বছর আগে, যখন প্রথম গ্যালাক্সির জন্ম হয়েছিল, তখনকার ছবি তুলে আনবে এই যন্ত্র। ওয়েবের সব থেকে বড় সুবিধা হলো, এটি লম্বা আলোকতরঙ্গের ছবি তুলতে পারে। যেহেতু আমাদের ব্রহ্মাণ্ড ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে, সেই কারণে দূর থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বেশি। এইভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একদম শুরুর দিনগুলি কীরকম ছিল, তা জানাতে পারবে ওয়েব। সেই সঙ্গে জানাতে পারবে ঠিক কীভাবে গ্যালাক্সিগুলি গঠন হয়েছিল। আমরা আরও বিশদে জানতে পারব কিভাবে উষ্ণ গ্যাসের মেঘ থেকে একটি তারা জন্ম নেয় এবং তার চারপাশের গ্রহ উপগ্রহের একটি সিস্টেম তৈরি হয়।
সবথেকে বড় উৎসাহ যে বিষয়টা নিয়ে তা হলো, জেমস ওয়েব হয়তো আমাদের সেই উত্তরটা দিতে পারবে, যে উত্তর আমরা এতদিন ধরে খুঁজে চলেছি। অন্য কোথাও প্রাণের সন্ধান পাওয়ার জন্য এই প্রথম মানবজাতির কাছে এত শক্তিশালী এক যন্ত্র এসেছে। অন্য কোন কোন সৌরজগতে প্রাণের যোগ্য পরিবেশ রয়েছে, বা Habitable Planet রয়েছে, তা খোঁজার দৌড়ে এখন অনেকটাই এগিয়ে গেলাম আমরা।
পৃথিবীতে মানুষ এসেছে দু'লক্ষ বছর হলো। তার মধ্যে আধুনিক মানুষের নথিবদ্ধ ইতিহাস মাত্র পাঁচ হাজার বছরের। প্রথম টেলিস্কোপ আবিষ্কার হয় ১৬০৫ সালে। মাত্র ৪০০ বছর পরে আমরা ব্রহ্মাণ্ড শুরুর পরের আলো দেখতে পাচ্ছি। আগামী দিনে মানুষ প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে কত দ্রুত এবং কত অভাবনীয় উন্নতি করবে সেটা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। আশ্চর্য হতে হয় এটা ভাবলেও, যে আজও আমরা ধর্ম, জাতপাত নিয়ে লড়াই করি।