১৯৭৭ আর ২০২৪: ইন্দিরা আর মোদির দুই নির্বাচনে কী কী আশ্চর্য মিল?
Indira Vs Modi: ১৯৭৭ সালে বিরোধী নেতাদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে গ্রেফতার করা হয়। বিরোধিতা করার অপরাধে ১ লক্ষেরও বেশি মানুষকে জেলবন্দি করা হয়েছিল।
সংসদীয় রাজনীতিতে নির্বাচনই সর্ববৃহৎ কর্মকাণ্ড। স্বচ্ছ, শক্তিশালী, জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থ এটাই। শুধু দেশের উচ্চ ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় অংশের সমর্থন পেলেই যে ভারতের মতো দেশে সরকার গড়া সম্ভব নয় তা ২০২৪-এর নির্বাচনে জনগণ বুঝিয়ে দিয়েছে। এর আগে ১৯৭৭ সালে দেশবাসী ইন্দিরা গান্ধিকেও একই কথা বুঝিয়ে দেয় হাড়ে হাড়ে, নির্বাচনী ফলাফলে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন ৪৭ বছর আগের স্মৃতিই যেন ফিরিয়ে আনল। এই দু'টি নির্বাচনের অনেকক্ষেত্রেই মিল রয়েছে।
১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরার পরাজিত হওয়া এবং ২০২৪ সালে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়াকে অনেকক্ষেত্রেই এক সুতোয় গাঁথা যায়। দু'টি নির্বাচনই পদ্ধতিগতভাবে বহুক্ষেত্রে মিলে গিয়েছে। সে বারেও গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করা মূল ইস্যু ছিল। বিরোধীরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক বিচার-বিপ্লবের ডাক দিয়েছিল। বিরোধীরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির শাসনের বিরোধিতা করতে একজোট হয়েছিল। তখনও ইন্দিরার অনাচারের কথাই প্রচার করে বিরোধীরা। ২০২৪-এও বিরোধী জোটের মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই। এবার নির্বাচনী প্রচারে মোদির মূল বক্তব্য ছিল, সংবিধান পরিবর্তন, হিন্দুরাষ্ট্র, এক দেশ-এক নির্বাচনের বাস্তবায়ন। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের বিলোপ, তিন তালাক নিষিদ্ধ করে পদ্মশিবির তিনটি মৌলিক ক্ষেত্র কার্যকর করে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক সূচনা করে ফেলেছিল। তাই 'গণতন্ত্র রক্ষা' মূল ইস্যু হওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না।
আরও পড়ুন- মোদি জমানায় বিনা বিচারে বছরের পর বছর জেল বন্দি! দেশের ১০ রাজনৈতিক বন্দি কারা?
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নির্দেশে দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থার ঘোষণা করা হয়। সংবিধানের ৩৫২ ধারা প্রয়োগ করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ জরুরি অবস্থার ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত জারি ছিল ইমারজেন্সি। ভারতীয় ইতিহাসে এই ২১ মাস এক 'অন্ধকারময় অধ্যায়'। ১৯৭৭ সালের আগে ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধেও ভারতে জরুরি অবস্থা জারি ছিল কিন্তু সেই সময় ১৯৭৭-এর মতো চূড়ান্ত সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট লক্ষ্য করা যায়নি।
১৯৭১-এর নির্বাচনী ফলাফলের জালিয়াতির নিয়ে ইন্দিরার বিরুদ্ধে মামলা করেন নারায়ণ। ১৯৭৫ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে দোষী সাব্যস্ত করে। আদালত রায় দিয়েছিল, ইন্দিরা ৬ বছর নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন না। পরে হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গেলেও সুরাহা মেলেনি। ফলত, স্বাভাবিকভাবেই হাতছাড়া হয় রায়বরেলির লোকসভা আসন এবং প্রধানমন্ত্রী পদ। সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায়কেই বহাল রাখে। এরপর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের পরামর্শ মতো দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণায় সায় দেন ইন্দিরা।
জনগণের ভোটে জিতেই প্রতি পদে গণতন্ত্রকে পদদলিত করে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা এবং মোদি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থা ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী পদ রক্ষা। তার জন্য ইমারজেন্সির বিধিনিষেধে দেশবাসীর মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালে বিরোধী নেতাদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে গ্রেফতার করা হয়। বিরোধিতা করার অপরাধে ১ লক্ষেরও বেশি মানুষকে জেলবন্দি করা হয়েছিল। রবিবারের ছুটি, বোনাস, বেতন বৃদ্ধি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুক্ত হস্তে কর্মী ছাঁটাইয়ের অধিকার ঘোষণা করা হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ৮ হাজার টাকা অবধি আয়ের উপরে ছাড় দেওয়া হয়। যেমন, নরেন্দ্র মোদির এইবার নির্বাচনে সংবিধান পরিবর্তন, হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের দাবি, মুসলমান বিদ্বেষী কথাবার্তাকে প্রধান হাতিয়ার করার মূল উদ্দেশ্য ছিল গদি বাঁচানো।
মোদিও নির্বাচনের আগে বিরোধী দলনেতাদের গ্রেফতার করার দমনমূলক রাজনীতি শুরু করেছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলি ভোট মরসুমে হাত-পা গুটিয়ে থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা যথাযথ প্রচার করতে না পারে। সংবাদমাধ্যম, প্রশাসন, বিচার বিভাগ সবক্ষেত্রই সরকারের হাতে চলে গিয়েছিল। যাঁরা প্রশ্ন তুলেছে তাঁদের ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশে ভয়-ভীতির পরিস্থিতি তৈরি করতে সফল হয়েছিলেন দু'জনেই। ২০২৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম ঘৃণা প্রচার করেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে। দুই দফার পর থেকে যখন মোদি দেখলেন একটা চোরাস্রোত তাঁর বিরুদ্ধে কাজ করছে, তাঁর মুসলমান বিদ্বেষী কথাবার্তা আরও বেড়ে গেল। মোদি লাগামছাড়া ভাবে মুসলিমদের আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া কোনও কিছু নিয়েই কুমন্তব্য করতে বাকি রাখেননি।
তবুও ১৯৭৭-এর নির্বাচনের সময় বিরোধীরা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল, সংবাদমাধ্যম তাদের ক্ষমতা ফিরে পেয়েছিল, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করেছিল। কিন্তু ২০২৪-এ নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি ক্ষমতাসীন সরকারের কোনও কিছুতেই বাধা দেয়নি। বিধিনিষেধ ছিল শুধুই বিরোধীদের জন্য। সংবাদমাধ্যমগুলি ক্ষমতাসীন দলকে প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তৈরি প্রশ্নপত্রের ভিত্তিতে মোদির সাক্ষাৎকার প্রচার পেত। কোনও সরকারি বিধি বলবৎ ছাড়াই শাসকেরা সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করছিল। সাংবাদিক, সমাজকর্মীরা বিনা বিচারে এখনও জেলবন্দি। ভোটের আগে বিরোধী শিবিরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা বারবার হানা দিয়েছে। নির্বাচনের আগে ইডি, সিবিআই সরকারের পোষা তোতা হয়ে উঠেছিল। মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নির্বাচন অর্থশক্তির খেলা হয়ে গিয়েছে। মিটিং-মিছিল-পোস্টার-ব্যানার-হোডিং-কাটআউট-প্রচারভ্যান এসবে জলের মতো টাকা ঢালে পদ্মশিবির। পুলওয়ামার মতো বিষয়কে রাজনৈতিক ইস্যু করে তোলা হয়। ১৯৭৭-এর নির্বাচনের সঙ্গে ২০২৪-এর নির্বাচনের এখানেই মূল ফারাক।
২০২৪-এর নির্বাচন শেষে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে দাবি করেছিলেন, বিরোধী জোট ইন্ডিয়া কম করে ২৯৫ টি আসন জিতবে। খাড়্গে জোর দিয়ে কোনও গোটাগুটি সংখ্যা না বলে ২৯৫ টি আসনের কথা বললেন কেন? মনে রাখতে হবে, ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনেও বিরোধীরা ২৯৫টি আসনই পেয়েছিল। সেই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলি বিহারের জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন দলে যুক্ত হয়েছিল। জনতা দলের নেতৃত্বে লড়ে ২৯৫ টি আসনে জয় পায় বিরোধী দলগুলি। ১৯৭৭ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ক্ষমতা হারান। ঐতিহাসিক নির্বাচনের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হন প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা মোরারজি দেশাই। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৮৩ বছর, যা এখন খাড়্গের বয়স। দিল্লির এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর তরফে খাড়্গকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করার প্রস্তাবও রাখা হয়েছিল কিন্তু কংগ্রেস তাতে দ্বিমত পোষণ করে। আরও একটি ফ্যাক্টর ছিল। ১৯৭৭ সালের প্রধান বিরোধী মুখ কে আর নারায়ণ ছিলেন একজন দলিত পরিবারের মানুষ। খাড়্গেও দলিত পরিবারের সন্তান। ২০২৪-এর নির্বাচন শেষে এই সকল সমীকরণও টানা হচ্ছিল। ৪৭ বছর আগের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি না হলেও, নির্বাচনী আবহাওয়ায় মিল ছিল।
আরও পড়ুন- কারও পকেটে ৭০০ কোটি তো কারও ৩০ হাজার! মোদি-মন্ত্রিসভার সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্রতম সদস্য কারা জানেন?
ইন্দিরা ও মোদি দু'জনেই জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেমের জিগির তুলে বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন। এ দেশের মানুষের বড় শক্তি এবং অন্যদিকে দুর্বলতা একই কেন্দ্রে মেলে, দেশপ্রেম। এই দুর্বলতাকেই হাতিয়ার করে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন তাঁরা কিন্তু মানুষ ধরে ফেলেছিল অন্নসংস্থানের ব্যর্থতাকে ঢাকতেই এই সকল প্রয়াস। ১৯৭৭ সালে দেশবাসী যেমন ইন্দিরার '২০ দফা কর্মসূচি' মেনে নেননি, ২০২৪ সালেও দেশবাসী 'মোদির গ্যারান্টি' মেনে নেননি। ১৯৭৭সালে যেমন দেশবাসী 'ট্রেন সময়ে পৌঁছনোর' মিথ্যে প্রচার ধরে ফেলেছিল, ঠিক তেমনই ২০২৪ সালের 'বন্দে ভারত' ট্রেনের অত্যধিক ভাড়া, বাকি ট্রেনের তুলনায় স্টপ কমিয়ে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার গোপন কৌশল দেশবাসী ধরে ফেলেছে। ইস্তেহারে আবার 'বুলেট ট্রেন'-এর দাবি যে অলীক স্বপ্ন ছিল, দেশবাসী তা বুঝে গিয়েছে। দু'টি নির্বাচনের ফলাফলই বিরোধীদের প্রশ্ন করার ক্ষমতা দিয়েছে; প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম, বিচার বিভাগকে তাদের নীতি মেনে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে।
দু'জনেই দেশবাসীকে রাজনীতি বিমুখ করার প্রচেষ্টায় নেমেছিলেন কিন্তু মানুষ তাঁদের নীতি-আদর্শহীন রাজনীতি নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আর তার ফলই প্রকাশ পেয়েছে ভোটবাক্সে। মোদির '৩.০' পুরোটাই টিকে রয়েছে জোটে।মোদি ও ইন্দিরা দু'জনেই ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করার নির্লজ্জ প্রয়াস চালিয়েছিলেন। ভারতে নয়া ব্যবস্থার বাস্তবায়ন এত সহজ নয়। দেশবাসী বুঝেছে এই পরিস্থিতিতে বিকল্পের কথা ভাবতেই হয়। জনগণের সবেতেই যে তীক্ষ্ণ নজর রয়েছ এবং তা যে ভোটবাক্সেও ফলানো যায় তা আবার প্রমাণিত হলো ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে।