দিল্লিতে আটক বাস্তবের ‘ব়্যাঞ্চো’ সোনম ওয়াংচুক, কেন লাদাখের দাবি দমনে এত উদগ্রীব কেন্দ্র?
Sonam Wangchuk: লাদাখের পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা-সহ স্থানীয় একগুচ্ছ দাবি নিয়ে লে থেকে পদযাত্রা করে দিল্লি পৌঁছন বাস্তবের 'ব়্যাঞ্চো' সোনম ওয়াংচুক। তাঁর সঙ্গে পা মেলান অসংখ্য মানুষ।
লাদাখের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছেন পরিবেশকর্মী, শিক্ষক সোনম ওয়াংচুক। গত মার্চ মাস নাগাদ সেই সব দাবিদাওয়া নিয়ে লাদাখে প্রবল ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে অনশন পর্যন্ত করেন সোনমরা। সম্প্রতি নিজেদের সেসব দাবিদাওয়া নিয়ে 'দিল্লি চলো' কর্মসূচী নেন তাঁরা। সেই কর্মসূচী মেনেই লেহ থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হন জলবায়ুকর্মী সোনম। গত সোমবার সিঙ্ঘু সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে আটক করা হয় সোনমকে। তিনি একা নন, আটক হয়েছেন দেড়শোর কাছাকাছি লাদাখবাসী।
লাদাখের পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা-সহ স্থানীয় একগুচ্ছ দাবি নিয়ে লে থেকে পদযাত্রা করে দিল্লি পৌঁছন বাস্তবের 'ব়্যাঞ্চো' সোনম ওয়াংচুক। তাঁর সঙ্গে পা মেলান অসংখ্য মানুষ। তার মধ্যে বহু অশীতিপর মানুষও ছিলেন। লাদাখের জন্য ষষ্ঠ তফসিলের মর্যাদা দাবি করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা। সোমবার সন্ধ্যায় তাঁদের দাবিগুলি নিয়ে লাদাখের নেতৃত্বের সঙ্গে যাতে আরও একবার আলোচনায় বসতে রাজি হয় কেন্দ্র, সেই দাবি নিয়েই দিল্লিতে আসেন তাঁরা। তবে জাতীয় রাজধানীতে প্রবেশের মুখেই সিঙ্ঘু সীমান্তে তাঁদের আটক করল দিল্লি পুলিশ। সূত্রের খবর, দিল্লি সীমান্তেই রাত কাটাতে চেয়েছিলেন ওয়াংচুক এবং অন্যান্যরা। কিন্তু, দিল্লিতে জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে তাদের ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করে পুলিশ। তাতে রাজি হননি সোনমরা। এর পরেই দিল্লি পুলিশ আটক করে প্রতিবাদীদের। দিল্লি পুলিশ সূত্রের খবর, ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৬৩ ধারা অনুযায়ী তাঁদের আটক করা হয়। ওয়াংচুক-সহ আটক প্রায় ১২০ জন ব্যক্তিকে আলিপুর থানা এবং দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তের অন্যান্য থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মিছিলে অংশগ্রহণকারী কোনও মহিলাকে আটক করা হয়নি বলেই জানিয়েছে দিল্লি পুলিশ।
আরও পড়ুন: মাইনাস ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে টানা অনশন! যে দাবিতে লাদাখে সরব বাস্তবের ‘ব়্যাঞ্চো’
আটক হওয়ার কিছু আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে করেছিলেন সোনম ওয়াংচুক। দেখা গিয়েছিল তাঁরা দিল্লি সীমান্তে আছেন। সেখানে বিশাল সংখ্যক পুলিশ উপস্থিত। পুলিশ তাদের বাস থামিয়েছিল। ভিডিয়োতে জলবায়ু কর্মী ওয়াংচুককে পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা যায়। ওই পোস্টে ওয়াংচুক বলেছিলেন, দিল্লি পুলিশ এবং হরিয়ানা পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়ি তাঁদের বাসের সঙ্গে চলা শুরু করে। তাঁরা প্রাথমিকভাবে ভেবেছিলেন, সম্ভবত তাদের বাসটিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু দিল্লির কাছাকাছি আসতেই তাঁরা বুঝতে পারেন, তাঁদের আটক করা হবে। ওয়াংচুক জানান, দিল্লি সীমান্তে প্রায় ১০০০ পুলিশ কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। দিল্লির লাদাখ ভবনে এবং লাদাখের ছাত্রছাত্রীরা যে এলাকাগুসিতে বসবাস করেন, সেই সব এলাকাগুলিতে ভারী সংখ্যায় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে বে তাঁরা খবর পেয়েছেন। ওয়াংচুক বলেন, “মনে হচ্ছে তারা এই পদযাত্রা হোক, সেটা চায় না।”
লেহ অ্যাপেক্স বডি বা এলএবির উদ্যোগে এই ‘দিল্লি চলো পদযাত্রা’-র আয়োজন করা হয়। গত চার বছর ধরে সংগঠনটি দ্বারা লাদাখকে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া, সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের সম্প্রসারণ, লাদাখের জন্য একটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন ও দ্রুত নিয়োগ এবং লেহ ও কার্গিল জেলার জন্য পৃথক পৃথক লোকসভা আসনের মতো বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছে। বর্তমানে, দিল্লিতে এসে তারা তাদের দাবিগুলি তুলে ধরতে চেয়েছিল। তবে সোমবার থেকেই পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির জমায়েতএবং দিল্লি ও দিল্লির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সব রকম বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছে। দিল্লির জায়গায় জায়গায় ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ১৬৩ ধারা জারি করা হয়েছে।
তবে আটক হয়েও আন্দোলনের মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন সোনম ওয়াংচুক। ইতিমধ্যে থানাতেই আমরণ অনশন শুরু করেছেন সোনম এবং তাঁর সঙ্গীরা ৷ এদিকে সোনম-সহ লাদাখের অন্য বাসিন্দাদের আটক করার ঘটনায় জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে দিল্লি হাইকোর্টে ৷ মামলাটি প্রধান বিচারপতি মনমোহন এবং বিচারপতি তুষার রাও গেডেলার বেঞ্চে তালিকাভুক্ত করা হয় ৷ বেঞ্চ মঙ্গলবার মামলাটি শুনতে অস্বীকার করে ৷ বৃহস্পতিবার দুপুরে মামলাটির শুনানি হতে পারে ৷
সোনম ওয়াংচুক-সহ বাকিদের আটকের ঘটনার খবর পেয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অতিশী তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যান ৷ মঙ্গলবার সকালে তিনি বাওয়ানা থানায় গেলে তাঁকে থানার ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ৷ আপ সূত্রে খবর, দুপুর একটার সময় অতিশী থানায় গিয়েছিলেন ৷ কিন্তু পুলিশ আধিকারিকরা তাঁকে সোনম ওয়াংচুকের সঙ্গে দেখা করতে দেননি ৷ বাওয়ানা থানাটি দিল্লি-হরিয়ানা সীমানায় অবস্থিত ৷
দিল্লিতে সোনমদের আটকের খবর পেয়েই ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধি। এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘মেনে নেওয়া যায় না। বয়স্ক নাগরিকরা লাদাখের ভবিষ্যতের জন্য লড়ছেন, আর শান্তিপূর্ণ মিছিল থেকে তাঁদের আটক করা হচ্ছে?’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কটাক্ষ করে রাহুলের বার্তা, ‘‘কৃষক আন্দোলনের মতোই এই চক্রব্যূহও এক দিন ভাঙা হবে। আপনার দর্পও সে দিন চূর্ণ হবে। লাদাখ কী চায়, আপনাকে এক দিন শুনতেই হবে।’’
আরও পড়ুন:অল ইজ নট ওয়েল ইন লাদাখ! ১৮০০০ ফুট উচ্চতায়, -৪০ ডিগ্রিতে কেন অনশনে বসছেন ওয়াংচুক?
লাদাখকে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরেই লড়ে চলেছেন সোনম। তবে তাতে টনক নড়েনি কেন্দ্রের। এর আগে একাধিক বার প্রতিশ্রুতি মিললেও গত মার্চ মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, লাদাখে ষষ্ঠ তফসিল হচ্ছে না। তার প্রতিবাদে আট ডিগ্রি তাপমাত্রায় খোলা আকাশের নীচে লাগাতার অনশন করেছেন সোনম ও অন্যান্য় আন্দোলনকারীরা। সোনমদের বক্তব্য, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পেলেও লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়েই রয়ে গিয়েছে। লাদাখকে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবি নিয়ে কেন্দ্র আলোচনা করুক। লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতাভুক্ত করে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হোক। লাদাখের জন্য একটি পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হোক। সেই সঙ্গে লেহ এবং কার্গিল জেলার জন্য পৃথক পৃথক লোকসভা আসনের বন্দোবস্ত করা হোক। এমনই নানা দাবি নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন অসংখ্য লাদাখবাসী। তবে তাঁদের সেসব দাবিদাওয়া শুনতেও আগ্রহ দেখায়নি মোদি সরকার। গত মাসেও সোনম কেন্দ্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, দাবি না মানা হলে ২৮ দিনের জন্য অনশনে বসবেন তিনি। এর আগেও চলতি বছরের মার্চ মাসে ২১ দিনের অনশনে বসেছিলেন ওয়াংচুক। শুধু নুন-জল ছাড়া কিছুই মুখে তোলেননি ওই ২১ দিন। দাবি ছিল একটাই, লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দিতে হবে।
এরপর এই 'দিল্লি চলো'-র ডাক। যে মিছিলে সামিল হয়ে কার্যত কারাবন্দি হতে হল সোনম ওয়াংচুককে। এই 'দিল্লি চলো পদযাত্রা'র অনুমতি চেয়ে ওয়াংচুক এবং দলের অন্যরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে মেইল করেছিলেন ৷ সেই মেইলটি কাজে লাগিয়ে সোনম-সহ বাকিদের আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ ৷ পুলিশের দাবি উড়িয়ে লাদাখের সাংসদ মহম্মদ হানিফা সংবাদসংস্থা পিটিআই-কে জানিয়েছেন, আটকদের মধ্যে অন্তত তিরিশ জন মহিলা আছেন ৷ তাঁদের পুরুষদের সঙ্গেই রাখা হয়েছে ৷ এমনকী সোনমকে তাঁর আইনজীবীদের সঙ্গেও দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। কেন সোনমদের সঙ্গে দিল্লির বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অতিশী মারলেনাকেও দেখা করতে দেওয়া হল না, প্রশ্ন উঠেছে সে বিষয়টি নিয়েও। তবে কি এভাবেই লাদাখ থেকে লাগাতার উঠতে চাওয়া দাবিকে দমন করতে চাইছে সরকার, যেভাবে কৃষক বিক্ষোভকে আটকাতে চাওয়া হয়েছিল, সেই পথেই সোনম ওয়াংচুকদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা চলছে, উঠে গিয়েছে একাধিক প্রশ্ন।