স্বাধীন দেশের প্রথম শেয়ার কেলেঙ্কারি

সাক্ষর সেনগুপ্ত: ১৯৫৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। সংসদের বাদল অধিবেশন চলছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন জওহরলাল নেহরু। কংগ্রেসেরই সাংসদ রাম সুভাষ সিং প্রশ্নোত্তর পর্বে জানতে চাইলেন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারি কি মাননীয় সাংসদদের জানাতে পারেন যে গত ৩ আগস্ট ইংরাজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যানে যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে তা সঠিক কি না। কী জানানো হয়েছিল স্টেটসম্যানের ওই রিপোর্টে? কানপুরের একটি সংস্থার কিছু ইউনিটকে ভারতীয় জীবনবিমা নিগম নাকি কয়েক কোটি টাকা দিয়েছে। কী সেই সংস্থা যাকে তখনকার অঙ্কে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়েছিল লাইফ ইনসিওরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়া ? কেন জনগনের টাকা এভাবে একটি বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে, সংসদে এই লিখিত প্রশ্নের জবাবে উত্তরও এল নিয়মমাফিক। কিন্তু, গুঞ্জনটা মোটেই থামল না।

আর, ধামাচাপাও পড়ল না। কারণ, ওই প্রশ্নোত্তর পর্বের মাস দুয়েক পরেই পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশনকে উত্তপ্ত করে তুললেন কংগ্রেসের এক তরুণ সাংসদ। নাম ফিরোজ গান্ধী, সম্পর্কে দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জামাই। তিনি একইভাবে রাম সুভাষ সিংয়ের মতই জীবন বীমা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সংসদে জানতে চাইলেন, কেন্দ্রের সরকার কী করছে, কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন? নির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে হতচকিত ও বাকরুদ্ধ সরকার পক্ষের মন্ত্রী-সাংসদদের সামনে ঝাঁঝালো আক্রমণে ফিরোজ জানান, সরকারি সংস্থা জীবনবিমা নিগম নিয়মের বাইরে গিয়ে একের পর এক ছয়টি অজানা-অচেনা সংস্থার শেয়ার কিনেছে। যেগুলিরল মধ্যে দুই-তিনটি সংস্থা সম্পূর্ণ রুগ্ন অথবা প্রায় বন্ধই বলা যেতে পারে। জীবনবিমা যদি কোনও সংস্থার শেয়ার কিনতে চায় অথবা কোনও বাণিজ্যিক লগ্নি করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সেটি নিয়ম অনুযায়ী করতে হবে এলআইসি-র ইনভেস্টমেন্ট কমিটির অনুমোদনের ভিত্তিতে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্ট কমিটিকে কোনও কিছু না জানিয়ে ওই ছয়টি সংস্থায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারকে অবিলম্বে তদন্তের নির্দেশ দিতে হবে। কারণ এই ধরণের সন্দেহজনক লেনদেন প্রশাসনের উপর মহলের সবুজ সঙ্কেত ছাড়া এগোতেই পারে না।

স্বাধীন দেশের প্রথম শেয়ার কেলেঙ্কারি, নেহরু-ফিরোজ দ্বন্দ্ব ও হরিদাস মুন্দ্রা

 হরিদাস মুন্ধ্রা | চিত্রঋণ : Google

শাসক পক্ষের বেঞ্চ তখন স্তব্ধ। দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। আর তারই সরকারের বিরুদ্ধে সংসদের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলছেন নেহরুর জামাই। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত সেটিই প্রথম এত বড় দুর্নীতির অভিযোগ। ইতিমধ্যে লুটিয়েনস দিল্লির আনাচে-কানাচে তখন কান পাতলেই পাওয়া যাচ্ছে ফিরোজ আর তাঁর স্ত্রী ও নেহরু-কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্কের তিক্ততার খবর। তাহলে কি পারিবারিক বিবাদের পরিণতি এই ভাবে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করল? পারিবারিক সমস্যা হতেই পারে, কিন্ত সে কারণে এভাবে প্রকাশ্যে সরাসরি নেহরুর বিরুদ্ধাচারণ, ভাবছেন দলের অন্যান্য সাংসদরা। আর প্রধানমন্ত্রী নিজে এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণে দৃশ্যত অপমানিত। ফিরোজ অবশ্য এখানেই থামেননি। আরও শানিত আক্রমণে তিনি বলেন, " অবিলম্বে সংসদের উচিত আরও বেশি নজরদারির জন্য উদ্যোগী হওয়া। সংসদ জানতে চায় এভাবে দেশের অন্যতম শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা কারা নয়ছয় করেছে এবং কাদের সাহায্যে।

প্রধানমন্ত্রীর এই বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে কংগ্রেসেরই জনৈক সাংসদ ফিরোজ গান্ধীকে থামিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, শুধুমাত্র একটি সংবাদপত্রের খবরের উপর ভিত্তি করে আপনি কি করে এত বড় অভিযোগ তুলছেন? আপনার কাছে কোনও যথাযথ প্রমাণযোগ্য নথিপত্র আছে? তা না থাকলে অহেতুক সরকারকে কালিমালিপ্ত করার পথে হাঁটবেন না। তির্যক হেসে পাল্টা জবাবে ফিরোজ জানালেন, অহেতুক আশঙ্কিত হবেন না। মনে রাথবেন আমিও একজন কংগ্রেস সাংসদ। আর সেকারণে অবশ্যই এই সরকারের অংশীদার। ঠিক সেজন্যই চাইছি দুর্নীতির দাগ কোনওভাবেই এই সরকারকে স্পর্শ না করতে পারে। এরপরেই বোমা ফাটালেন নেহরু-জমাতা। অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে নথিবদ্ধ হওয়া বক্তব্যে তিনি জানালেন, আমার কাছে অর্থসচিব এইচ এম প্যাটেল আর অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারির মধ্যে এই বিনিয়োগের বিষয়ে যে সমন্ত গোপন চিঠিপত্র আদানপ্রদান হয়েছে তার প্রতিলিপি আছে। ওই সব নথি থেকে এটা স্পষ্ট এলআইসি একটি বিশেষ সংস্থাকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেন এটা করা হয়েছে?

এই যাবতীয় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু কলকাতা। হরিদাস মুন্দ্রা। কলকাতা শহরের এক ধুরন্ধর মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ী। পেশা শুরু করেছিলেন বাল্বের সেল্সম্যান হিসেবে। পড়াশোনা বড় একটা ছিল না, কিন্তু বুদ্ধি ছিল ক্ষুরধার। আর এই ব্যবসায়ী বুদ্ধিকে বিলক্ষণ কাজে লাগিয়ে নেমে পড়েন ফাটকাবাজির খেলায়। যথারীতি যাবতীয় বাঁকা পথে তৈরি করে ফেলেন অন্তত চার কোটি টাকার কারবার। তখনকার অঙ্কে যা নেহাত কম নয়। তা সেই মুন্দ্রা করলেন কী? নিজের নামে থাকা ছ’টি কোম্পানির জাল শেয়ার বেচলেন এলআইসিকে প্রায় এক কোটি ছাব্বিশ লাখ টাকায়। তার মধ্যে রিচার্ডসন, জেসপশ, স্মিথ স্টেনস্ট্রিট, ওসলার ল্যাম্পস, অ্যাগনেলো ব্রাদার্স এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কর্পোরেশনের একটা বড় অংশই প্রায় রুগ্নপ্রায়। এর মধ্যে শেষ তিনটি সংস্থার কোনও মুনাফাই ছিল না। আয়ও না থাকায় কার্যত বন্ধ হওয়ার পথে। অবশ্য জেসপশ আর রিচার্ডসনের আর্থিক অবস্থা তুলনায় ভাল। তাহলে গোল বাঁধছে কোথায়? কুখ্যাত হরিদাস মুন্দ্রা ওই সব সংস্থার মুনাফার টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছিল। আর নানা কায়দায় ওইসব সংস্থার শেয়ারের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছিল।

স্বাধীন ভারতের সেই প্রথম শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় সংসদে যথাযথ বিবৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ঘোয়ণা করলেন, বিচারবিভাগীয় কমিশন এই দুর্নীতির তদন্ত করবে। মুম্বই হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এম সি চাংলা এই কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেসময় চাংলা কমিশনের শুনানির দিন জড়ো হতেন বহু মানুষ। পরিস্থিতি দেখে মাইক বাজিয়ে শুনানি চালাতে হত। জে আর ডি টাটার মতো ব্যক্তিত্বরাও নাকি মুন্দ্রা-বিতর্কের পরিণতি জানতে বার কয়েক হাজির থেকেছেন শুনানিতে ! তদন্তে একের পর এক প্রশ্ন সামনে আসে। সংশ্লিষ্ট কমিটিকে এড়িয়ে তা হলে কি সরকারি চাপেই এল আই সি-কে শেয়ারগুলি কিনতে হয়েছিল? তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারি সংসদে ফিরোজের অভিযোগ ,মানতে রাজি ছিলেন না কিন্তু চাপের মুখে তাঁকেই শেষে পদত্যাগ করতে হয়। কেন্দ্রের তৎকালীন অর্থসচিব, এল আই সি-র চেয়ারম্যান বা এম ডি-ও ছাড় পাননি। রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর এইচ ভি আর আয়েঙ্গারও ওই সময় প্রবল আক্রমণের মুখে পড়েন। মুন্দ্রা প্রসঙ্গে কমিশন জানায়, ‘তিনি আদৌ ব্যবসায়ীই নন, বরং ফাটকাবাজ।’ শেষে তাকে জেলের ঘানি টানতে হয় বাইশ বছর। দেশের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অনতিবিলম্বে নাম জুড়ে হরিদাস মুন্দ্রার।

তথ্যসূত্র:

  • দুর্নীতির দায়ে ইস্তফা, সে এখন ইতিহাস - জয়ন্ত ঘোষাল, আনন্দবাজার পত্রিকা, 09.05.2013
  • Independent India’s First Big Financial Scam - thelogicalindian.com

More Articles