ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে সাধারণ জনগণের কিছুই এসে যায় না
Electoral Bond : আমরা কি জানি লোকসভা নির্বাচনে লড়তে গেলে একজন প্রার্থীকে সর্বোচ্চ ৯৫ লাখ টাকা খরচ করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে নির্বাচন কমিশন?
হ্যাঁ, বেশ শিহরণ জাগানো ব্রেকিং নিউজ হাতে এসে পৌঁছল ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে! অনেক দিন পরে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় সাংবাদিক মনকে চনমনে করে দিল। আরে গুরু করেছে কী! ইলেক্টোরাল বা নির্বাচনী বন্ডকে অবৈধ, অসাংবিধানিক ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এমন খবরে গায়ে কাঁটা তো দেবেই।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে (পড়ুন শাসক দলের স্বার্থ) একটি সরকার এমন অস্বচ্ছ ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলবে কে জানত! প্রয়াত অর্থমন্ত্রী বিজেপির অরুণ জেটলি চমৎকার একটি ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। যাদের ইচ্ছে মোটা টাকার অনুদান দেবে রাজনৈতিক দলগুলিকে তারা স্টেট ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট ব্রাঞ্চে যাবে। চেকে বা ডিজিটাল লেনদেনে নির্দিষ্ট টাকার পরিমাণ জমা দিয়ে বন্ড কিনে নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দলকে দিয়ে দেবে। ১৫ দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলটি ব্যাঙ্কে সেই বন্ড ভাঙিয়ে নিজের তহবিলে টাকা নিয়ে নিতে পারবে। ব্যাস। অত্যন্ত সহজ উপায়।
এই ব্য়বস্থার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হল এই বন্ড কে কিনল ও সে কোন রাজনৈতিক দলগুলিকে দিল তা কেউ জানতে পারবে না। সব হবে গোপনে। এটা নাকি কালো টাকা আটকানোর উপায়! কারণ সবটাই হচ্ছে ডিজিটাল লেনদেন।
আগে কোনও কর্পোরেট সংস্থা কত টাকা রাজনৈতিক অনুদান হিসেবে দিতে পারবে তার একটি ঊর্ধ্বসীমা বাঁধা ছিল। জেটলিরা সেই সব আইনও ধুয়ে মুছে সাফ করে দিলেন। আগে কোনও কোম্পানি তাদের তিন বছরের গড় লাভের সাড়ে সাত শতাংশ পর্যন্ত টাকা রাজনৈতিক দলগুলিকে অনুদান হিসেবে দিতে পারত। ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে আইন করার সময় সেই সব শর্ত আইন সংশোধন করে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু এ তো সব জটিল ব্যাপার। এই আইন পাশ করে তার ব্যবহার করে দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেছে এবং অনেকগুলি বিধানসভার নির্বাচন। কেউ কি নির্বাচনী প্রচারে বন্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জোর গলায়? কেউ কিছু বলেনি।
আরও পড়ুন- বিজেপি জমানার ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ দুর্নীতিকে ভোটের ‘হাতিয়ার’ করতে পারবে বিরোধীরা?
আসলে এত সব কূট কাচালিতে দেশের সাধারণ জনগণের কিছু এসে যায় কি? যদি এসে যেত তাহলে অনেক দিন আগেই এই নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হত। রাজনৈতিক দলগুলি এবং রাজনৈতিক নেতারা যে বিশাল পরিমাণে টাকা খরচ করে থাকে তা কি আর কারও অজানা? খালি চোখেই তো দেখা যায় তাদের বৈভব।
এই যে নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী সহ তাদের দলের নেতারা দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বিশেষ বিমানে উড়ে বেড়ান তার কোনও খরচ নেই? বড় বড় পোস্টার, হোর্ডিং, কাটআউটে শহর ছেয়ে দেওয়া হয়, তার খরচও তো আছে। খবরের কাগজে দিনের পর দিন পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন, টিভি ও অনলাইন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন, কর্পোরেট সংস্থাকে দিয়ে দলের কাজ করানো, মিছিলে লোকজন নিয়ে যাওয়া, গাড়ির তেল — এই সবকিছুর জন্য তো টাকা লাগে। সবটাই তো হয় সাধারণ মানুষের চোখের সামনে।
কিন্তু আমরা তো কখনও প্রশ্নই করিনি — টাকা আসছে কোথা থেকে? এটি শুধু বিজেপির ব্যাপার তো নয়। এ রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস তো এই ইলেক্টোরাল বন্ডের থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা পাওয়ার তালিকায় তিন নম্বরে রয়েছে। প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাকের যে বিশাল বাহিনী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের সাহায্য করে গেল এবং এখনও করছে, সেই সব ছেলেমেয়েদের বেতন কাদের টাকায় হয়? শুধুই কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি বলে খরচের ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলে চলবে!
ইতিউতি প্রশ্ন উঠেছে। খানিক গুলতানিও হয়তো হয়েছে। কিন্তু কে আর মাথা ঘামিয়েছে এই সব টাকার উৎস বা জোগান নিয়ে?
আজকাল নির্বাচনের সময় অনেক প্রার্থীকেই টাকা দিতে হয় না দলের পক্ষ থেকে। তাঁরা নিজেদের টাকাতেই নির্বাচনে লড়েন। বাংলাতেও বৈভব রয়েছে ঠিকই কিন্তু দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে রাজনৈতিক নেতারা যে হারে টাকা খরচ করেন, তা দেখলে তো অবাক চোখে তাকিয়েই থাকতে হবে। বেশিরভাগ জায়গার ভোটাররা আসলে একটু টাকা, একটু মদ, একটু খাওয়া দাওয়া পেলেই তুষ্ট।
২০১৯-এর নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, তারা সেই বছর লোকসভা নির্বাচনের সময় ১৩০০ কোটি টাকার মাদক দ্রব্য, ৮৩৯ কোটি টাকার নগদ, ২৯৪ কোটি টাকার মদ, ৯৮৬ কোটি টাকার সোনা-রূপো এবং আরও ৫৮ কোটি টাকার জিনিস বাজেয়াপ্ত করেছিল। মোট বাজেয়াপ্ত হয়েছিল ৩৫০০ কোটি টাকার বেশি জিনিস।
২০১৬ সালে তামিলনাড়ুর দু'টি বিধানসভা কেন্দ্রে এত বেশি টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল যে নির্বাচন বাতিল করতে হয় সেখানে। কিন্তু তাতে কার কী এসে গেছে!
আমরা কি জানি লোকসভা নির্বাচনে লড়তে গেলে একজন প্রার্থীকে সর্বোচ্চ ৯৫ লাখ টাকা খরচ করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে নির্বাচন কমিশন? সে টাকার হিসেব নির্বাচন মেটার পরেই নির্বাচন কমিশনকে দিতে হয়। কিন্তু কেউ কি মাত্র ৯৫ লাখ টাকা দিয়ে এত বড় লোকসভার প্রচার সারতে পারে! খরচ হয় অনেক বেশি। ২০১৯ সালের নির্বাচনী খরচ নিয়ে সিএমএস সংস্থার তৈরি করা একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এক এক জন প্রার্থী প্রায় ১০০ কোটি টাকা করে খরচ করেছেন লোকসভা নির্বাচনে লড়তে। দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ আইনপ্রণেতারাই হচ্ছেন কোটিপতি!
আমাদের সব চোখ সওয়া। আমরা ফিরেও তাকাই না, জানার চেষ্টাও করি না কে কত টাকা খরচ করল। প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল কত টাকা খরচ করল তার হিসেব নিয়ে তো আমাদের কোনও মাথা ঘামোনোর প্রয়োজনই নেই। "এমনটা তো হয়েই থাকে!"
কোনও কোনও জায়গায় এক বোতল মদ ও শ'খানেক টাকা দিয়েই ভোট কেনা যায়। সেই সব জনগণের বয়েই গেছে এই সব ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে মাথা ঘামাতে। মিডিয়াও এই নিয়ে কোনও সমালোচনামূলক খবর বিশেষ করেনি। সাধারণ মানুষও পাত্তা দেয়নি। বাম দলগুলি ছাড়া সব দলগুলিই কম বেশি ইলেক্টোরাল বন্ডের সুবিধা তুলেছে। কাজেই 'চোরে চোরে মাসতুতো ভাই', কারও মুখে কোনও কথা নাই।
আরও পড়ুন-ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক তহবিলে কোটি কোটি টাকা! কত পেল বিজেপি?
সিএমএস-এর সমীক্ষা বলছে শুধু ২০১৯ সালের নির্বাচনেই রাজনৈতিক দলগুলি খরচ করেছে আনুমানিক ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা। যার ৪৫-৫৫ শতাংশ খরচ করেছে শুধু বিজেপি। কংগ্রেস খরচ করেছে ১৫-২০ শতাংশ। আর গত ছয় বছরে ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে উঠেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। কাজেই নির্বাচনে যা খরচ হয়, তার খুব সামান্য অংশই বন্ড থেকে আসে।
আসলে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বিপদে পড়লে পড়তে পারে কর্পোরেট সংস্থাগুলো। যারা গোপনে এই পার্টি-ওই পার্টিকে বন্ডের মাধ্যমে টাকার জোগান দিয়েছে। কোনও শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী তো আর দান-ধ্যান করতে সেই টাকা দেয়নি। তারা নিশ্চয়ই কোনও না কোনও সুযোগ সুবিধা নিয়েছে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলির থেকে। সুপ্রিম কোর্টও সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে রাজনৈতিক দল হোক বা নেতা, তাদের বৈভব, যশ, প্রতিপত্তি এতটাই গা সওয়া যে এই সব রায়ে তাদের কিছু যায় আসে না। তাই সরকার পক্ষের উকিল ভরা আদালতে জোর গলায় বলতে পারেন, ভোটারদের জানার অধিকার নেই কোন রাজনৈতিক দল কোথা থেকে টাকা পাচ্ছে।
তিনি ঠিকই বলেছিলেন। এদেশের মূর্খ ভোটারদের ভরসাতেই তো রাজনৈতিক দলগুলি সরকার চালায়। দেওয়ালে পিঠ না ঠেকে যাওয়া অবধি সব 'পাগলু ড্য়ান্স'। নির্বাচনী খরচ ও অনুদান সংগ্রহের স্বচ্ছতা দাবি করতে গিয়ে আর এক দল মূর্খ মরে মরুক।