ব্রিটিশদের ভারতছাড়া করতে বাধ্য করেছিল সেই বিদ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতার বিষ পালটে দিল ইতিহাস
১৭৫৭ সালে পলাশির আমবাগানে বাংলার স্বাধীনতা হরণের পর ভারতে ব্রিটিশরাজ মূলত দু'টি সশস্ত্র বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়। প্রথমটি ঠিক ১০০ বছর পর ১৮৫৭ সালের সেনা বিদ্রোহ এবং দ্বিতীয়টি তার ঠিক ৮৯ বছর পর নৌ বিদ্রোহ।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অথচ প্রায় বিস্মৃত একটি ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৬-এর নৌ বিদ্রোহ। ওই বছরের ১৮ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২২টি যুদ্ধজাহাজ ও ২০,০০০-এর বেশি সাধারণ মানুষ, নাবিক ও নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা ধর্মঘটে অংশ নেন, যা মিউটিনি বা বিদ্রোহ হিসেবে পরিচিতি পায়। ঐতিহাসিকদের অনেকেরই মতে, এই বিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতার জন্য যতটা ভূমিকা রেখেছে, ততটা স্বীকৃতি পায়নি। ১৭৫৭ সালে পলাশির আমবাগানে বাংলার স্বাধীনতা হরণের পর ভারতে ব্রিটিশরাজ মূলত দু'টি সশস্ত্র বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়। প্রথমটি ঠিক ১০০ বছর পর ১৮৫৭ সালের সেনা বিদ্রোহ এবং দ্বিতীয়টি তার ঠিক ৮৯ বছর পর নৌ বিদ্রোহ। আগে ব্রিটিশদের অস্ত্র ও কৌশলের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা পরাস্ত হলেও নৌ বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় রাজনীতিকদের ধূর্ততার কারণে।
ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে যেরকম উন্মাদনা চারিদিকে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার ছিটেফোঁটাও ছিল না ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ বিদ্রোহ অর্থাৎ নৌ বিদ্রোহের ৭৫তম বার্ষিকীতে। তবে ইতিবাচক বিষয় হলো, এটি নিয়ে বর্তমানে নতুন করে গবেষণা হচ্ছে, বই বেরোচ্ছে এবং মানুষ পড়ছেও কম-বেশি। নৌ বিদ্রোহীদের আত্মজীবনী এবং গবেষণাপত্র থেকে সংগৃহীত তথ্য চমকে দেয় আজও। জানা যায়, বিদ্রোহে অংশ নেওয়া নৌ জাহাজগুলোর বিদ্রোহীরা ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ছ'টায় একে একে সবাই আত্মসমর্পণ করলেও এইচএমআইএস আকবরে যে সাড়ে তিন হাজার নাবিক ও তিনশো সেপাই ছিল, তারা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে। এইচএমআইএস আকবরের বিদ্রোহীরা সবাই অবশ্য কয়েক ঘণ্টার অচলাবস্থার পর শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হন। আত্মসমর্পণের পর তাঁদের আটক রাখা হয় এবং ওই বছরের অগাস্ট মাসে তাঁরা মুক্তি পান।
নৌ বিদ্রোহীদের মতে তৎকালীন রাজনীতিকরা তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, যা এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ। ভারতের সাধারণ মানুষ ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে নৌ বিদ্রোহের সমর্থনে ২২ ফেব্রুয়ারি ভারতের বিভিন্ন শহরে বন্ধ পালন করে। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ নানা জায়গায় গুলি ছোড়ে। বম্বেতে ২২৮ জন বেসামরিক ব্যক্তি ও তিনজন পুলিশ নিহত হন, আহত হন হাজারখানেকের বেশি। কিন্তু এত কিছুর পরেও কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ বিদ্রোহে সমর্থন দেয়নি। কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের নেতারা বিপ্লব চাননি, চেয়েছেন শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে অরুণা আসফ আলি দলের শীর্ষ নেতাদের মত বদলানোর চেষ্টা করেও বল্লভভাই প্যাটেলের বিরোধিতার কারণে ব্যর্থ হন। ২২ ফেব্রুয়ারিতেই বল্লভভাই প্যাটেল বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের জন্য বার্তা পাঠান। একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি বিদ্রোহের সমর্থনে এগিয়ে আসে ও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। নৌ-বিদ্রোহীদের আত্মজীবনী এবং তৎকালীন গবেষণাপত্র পড়লে জানা যায়, বর্তমানে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান রাষ্ট্র ও সমাজে বিভাজন ও অস্থিরতা ছড়াচ্ছে, তা হয়তো দেখতে হতো না যদি এই বিদ্রোহ সাফল্যমণ্ডিত করা যেত।
আরও পড়ুন: মাতঙ্গিনী হাজরার আন্দোলনের পিছনে ছিল বড় পরিকল্পনা, পাল্টে যেতে পারত ভারতের ইতিহাস
এই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল এইচএমআইএস তলওয়ার নামের জাহাজে। ওই জাহাজের একজন সিগন্যালম্যান বলাইচন্দ্র দত্ত ছিলেন বিদ্রোহী নেতাদের একজন। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ শুরুর সপ্তাহ তিনেক আগেই ১ ফেব্রুয়ারি নৌপ্রধানের সফরের দিন জাহাজে ব্রিটিশ বিরোধী স্লোগান লেখার দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর লেখা বই ‘দ্য মিউটিনি অব দ্য ইনোসেন্টস’ এবং বিশ্বনাথ বোসের ‘আরআইএন মিউটিনি ১৯৪৬’–এ ওই বিদ্রোহের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। সাধারণভাবে অনেকে বলে থাকেন যে ওই বিদ্রোহ ছিল বেতন, খাবার ও আবাসনের মান শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কম ও নিম্নমানের হওয়ায় এবং বর্ণবাদী বৈষম্যের কারণে ভারতীয়দের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়, তা থেকেই বিদ্রোহের সূচনা। তবে বি. সি. দত্তর মতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলছিল, সেই রাজনৈতিক ঢেউ ভারতীয় নৌ-সেনাদের ওপর আছড়ে পড়েছিল।
১৮৫৭ সেপাই বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরাজ সব বাহিনীতে রাজনৈতিক প্রচারপত্রের প্রবেশ ও আলোচনা বন্ধ করলেও বি. সি. দত্ত নৌজাহাজ তলওয়ারে গোপনে রাজনৈতিক কাগজপত্র পাচার ও আলোচনা উভয়ই করতেন। বিদ্রোহের দুই মাস আগে ১ ডিসেম্বর নৌবাহিনী দিবসে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শনীর দিনে নৌজাহাজ তলওয়ারের গায়ে ও ডেকে তাঁরা ‘ভারত ছাড়ো’, ‘জয় হিন্দ’-সহ নানা ধরনের স্লোগান লিখে রাখেন তিনি। দত্ত স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন যখন তলওয়ারে ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে ভারতের পতাকা ওড়ানো হলো তখন ওখানে উপস্থিত ব্রিটিশদের মুখের অবস্থা ছিল দেখার মতো। বিদ্রোহের বিষয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ক্লিমন্ট অ্যাটলি বলেন, কংগ্রেস বিদ্রোহের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা সহানুভূতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারে বলেও তিনি এমপিদের জানান। বিদ্রোহীদের দাবিগুলোও তিনি উল্লেখ করেন। ব্রিটিশ গবেষক উইলিয়াম রিচার্ডসন দ্য সোসাইটি ফর নটিক্যাল রিসার্চের প্রকাশনায় লিখেছেন, ‘ভারতের স্বাধীনতার রাজনৈতিক আন্দোলনই ছিল এই বিদ্রোহের মূল।’ (দ্য মিউটিনি অব দ্য রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি অ্যাট বম্বে ইন ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬, মে ১৯৯৩)।
রক্তপাত এড়িয়ে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণে রাজি করাতে রাজনীতিকদের তরফ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল কাউকে সাজা দেওয়া হবে না, কোনও খেসারত দিতে হবে না এবং দাবিগুলো পূরণে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাস্তবে উল্টোটাই ঘটেছে। বিদ্রোহী নেতাদের আটক করা হয়েছে, বিচার ও সাজা হয়েছে। সাধারণ বিদ্রোহীদের বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে আর কখনও বোম্বাইমুখী হবে না। নানা অজুহাত, এমনকী, ইউনিফর্মে সামান্য ক্ষতির জন্যও বকেয়া বেতন থেকে টাকা কেটে রাখা হয়েছে। সরকারের এই আচরণ এবং রাজনীতিকদের প্রতিশ্রুতিভঙ্গে এসব বিদ্রোহী কতটা আশাহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তা কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় বিশ্বনাথ বোসের বইয়ে। তিনি লিখেছেন,
দেশপ্রেম যদি অপরাধ হয়, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই অপরাধী। তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন নেতা হিসেবে আমার নাম রয়েছে এবং আমার বিচার ও সাজা হয়েছে। আমাকে মুক্তি দেওয়ার পর নৌবাহিনীতে পুনর্নিয়োগর জন্য আপনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য কোনো বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুতির কারণে সেই বাহিনীতে আর ফেরত না নেওয়ার কোনও আইন যদি থেকে থাকে, তাহলে আপনার কাছে আমি জানতে চাই কংগ্রেসের একজন নেতা হিসেবে আপনি কীভাবে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।
নৌ ধর্মঘটের শুরুতে বম্বেতে অবস্থানরত জাহাজগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় একটি কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি (নেভাল সেন্ট্রাল স্ট্রাইক কমিটি) বা এনসিএসসি। এই কমিটি ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি’-র নাম বদলে ‘দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল নেভি’ করে। কমিটির প্রেসিডেন্ট হন সিগন্যালম্যান এম এস খান ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মদন সিং। সেইসময় নাবিকেরা বম্বের রাস্তায় ‘হিন্দু-মুসলিম এক হও’ এবং ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেয়। বি. সি. দত্তর বইয়েও এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলা আছে। তিনি লিখেছেন,
আমরা নানা অঞ্চল থেকে এসেছি। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সব পরিবার থেকে। নৌবাহিনীতে বছরের পর বছর কাটিয়ে আমরা নাবিকেরা ভারতীয় হয়েছি।
নৌ বিদ্রোহের তাৎক্ষণিক সাফল্য না থাকলেও তা যে ভারতের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে, সেকথার স্বীকারোক্তি মেলে ক্লেমন্ট অ্যাটলির কথায়। ১৯৫৬ সালে তাঁর ভারত সফরের সময় কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি পি. ভি. চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচয় হয়। বিচারপতি চক্রবর্তী অ্যাটলির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ১৯৪৭-এর অনেক আগেই মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলন যখন প্রায় থেমে গেছে, তখন ব্রিটিশ সরকার তাড়াহুড়ো করে ভারত ছাড়ল কেন ? মি. অ্যাটলি মূলত দু'টি কারণ বলেন; একটি হচ্ছে নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ভারতীয় ন্যাশনাল আর্মি গঠন, যা ভারতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করেছে এবং অন্যটি হচ্ছে রাজকীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, যে রাজনীতির কারণে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সেই নৌবিদ্রোহ সফল হয়নি, উপমহাদেশজুড়ে সেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন-বিদ্বেষের রাজনীতিই এখন আবার জোরদার হচ্ছে।