একটানা দু’মিনিট ধরে কাঁপল রাজধানী, কেন আফগানিস্তানের ভূমিকম্পের জের বইছে ভারতও?

Strong earth quake : দিল্লি-সহ গোটা উত্তর ভারত জুড়ে ছড়িয়েছে আতঙ্ক, আফগানিস্তানে উৎস হয়েও কেন এতক্ষণ ধরে চলল কম্পন চলল ভারতে? কী বলছেন বিজ্ঞানীরা?

একের পর এক কম্পনের সাক্ষী থাকছে গোটা বিশ্ব, ভারতও পিছিয়ে নেই। শেষ কয়েক মাসে একাধিক ভূমিকম্পের খবর উঠে এসেছে শিরোনামে। বহু ক্ষেত্রে আফটার শক হয়ে উঠেছে আরও জোরালো। গতকালই ফের শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে আফগানিস্তান। কম্পনের জের পিছু ছাড়েনি ভারতেরও। এক টানা দু মিনিটে আকস্মিক কম্পনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, কাশ্মীর, পঞ্জাব, রাজস্থান, হরিয়ানা সহ গোটা উত্তর ভারতে। জোরাল এই ভূমিকম্পের জেরে আতঙ্কে ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন মানুষজন। সেই ভিডিও ভাইরালও হয়েছে নিমেষের মধ্যে। কিন্তু ভূমিকম্পের অনুষ্ঠান তো ছিল আফগানিস্তানে, তাহলে কেন তার জের এসে পড়ল ভারতেও? আসল কারণ কী? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

প্রসঙ্গত, ২০ মার্চ মঙ্গলবার রাত ১০টা নাগাদ আফগানিস্তানের হিন্দু কুশে জোরাল কম্পন অনুভূত হয়। ভূপৃষ্ঠের ১৫৬ কিলোমিটার গভীরে ছিল  ভূমিকম্পে উৎসস্থল। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের কম্পনের মাত্রা ছিল ৬.৫। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে কম্পনের মাত্রা ৬.৮ বা তার বেশিও হতে পারে। উৎসস্থল ভূপৃষ্ঠের ১৮৪ কিলোমিটার গভীরে ছিল বলেই দাবি করা হয়েছে। জানা গিয়েছে, ভূমিকম্পের এই উৎসস্থলটি আফগানিস্তানের কালাফগান অঞ্চলের ৯০ কিলোমিটার দূরে। ভূমিকম্পের জের যে যথেষ্ট জোরালো তা ইতিমধ্যে জানা গেলেও ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ এখনও পর্যন্ত সঠিক করে জানা যায়নি। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির, এমনকী মৃত্যুর সম্ভাবনাও রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন - স্মরণকালের ভয়ালতম বন্যার কবলে বাংলাদেশের কয়েক লক্ষ মানুষ, দায় কার

শুধু আফগানিস্তান নয়, পাশাপাশি পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, পেশোয়ার, চরসাদ্দা, লাহোর এবং রাওয়ালপিন্ডি-সহ বিভিন্ন শহরে, তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তান এবং চিনের শিনজিয়াংয়েও জোরালো ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে গতকাল রাতেই। উত্তর ভারতেও ছড়িয়েছে সেই রেশই। উত্তর ভারতের বহু রাজ্যে রাতে প্রায় ৪৫ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট পর্যন্ত কম্পন অনুভূত হয়।

ভূকম্প বিশেষজ্ঞের মতে, সিসমোলজির নিরিখে হিন্দুকুশ পার্বত্য এলাকা এমনিতেই ভূমিকম্প প্রবণ। গতকালের ভূমিকম্প নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে National Center for Seismology-র বিজ্ঞানী জেএল গৌতম জানিয়েছেন, ভূগর্ভে ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের সঙ্গে ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষেই এই ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। এই রেষারেষির সময়ে ইন্ডিয়ান প্লেটটি যখনই ইউরেশীয় প্লেটের নীচে ঢুকে যাচ্ছে, তখন মাটির নীচে বিশাল পরিমাণ শক্তি মুক্ত হয়, আর সেই নির্গত শক্তির পরিমাপ কতটা, তার উপরেই নির্ভর করে ভূমিকম্পের মাত্রা। এই যে দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকম্প তার কারণও প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে ওই নির্গত শক্তির পরিমাপকেই। যেহেতু প্রবল সংঘর্ষ ঘটেছে এবং হিন্দুকুশ পার্বত্য অঞ্চল একই ভূকম্প প্রবণ ফলে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়েছে এই কম্পনের মাত্রা। যার ফলে আফগানিস্তানে কম্পনের উৎসস্থল হলেও এর জের টানতে হচ্ছে পাকিস্তান তাজিকিস্তান, চিন সহ গোটা উত্তর ভারতকে। বেশিক্ষণ ধরে কম্পন চলার আরও একটি বড় কারণ হল গভীরতা। ‘ফল্ট’-এর গভীরতা এখানে ১৫০ কিলোমিটারেরও বেশি। সেই কারণেই এত লম্বা সময় ধরে ভূমিকম্প চলেছে বলেই জানিয়েছেন ভূকম্প বিজ্ঞানী জেএল গৌতম।

আরও পড়ুন - ১ মিনিটের ভূমিকম্পেই তছনছ হতে পারে কলকাতা, কতটা বিপদ ঘনিয়ে রয়েছে শহরে?

প্রসঙ্গত, বিগত কয়েক দশক ধরে এই ম্যান্টলের গতিবিধি, টেকটনিক প্লেটগুলোর অবস্থান এবং তাদের সংঘর্ষের ফলে তৈরি শক্তিপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা করছেন ভূবিজ্ঞানীরা। কম্পন মাপক যন্ত্র বা সিসমোগ্রামের সাহায্যে পাওয়া তথ্য থেকে যে গাণিতিক মডেল তৈরি কর, তা থেকে তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে অনেক নিখুঁত বর্ণনা দিতেও সক্ষম বর্তমানে। এমনকী ভূমিকম্পের কারণ সঠিক ভাবে জানতে নতুন বৈজ্ঞানিক মডেল তৈরি করা হয়েছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, হিমালয় অঞ্চলে ভূগর্ভে যে প্লেট বিন্যাস লক্ষ্য করা যায় তা হল ত্রিস্তরীয় বিন্যাস। এই প্লেট গুলির মধ্যে সংঘর্ষের কারণে মূলত তিন ধরনের কম্পনের জের অনুভূত হতে পারে। যথা - প্রধান কেন্দ্রীয় (মেইন সেন্ট্রাল), প্রধান প্রান্তীয় (মেইন বাউন্ডারি) ও পৃষ্ঠদেশীয় (ফ্রন্টাল)। হিন্দুকুশ পার্বত্য এলাকার সংলগ্ন অঞ্চল যেহেতু এমনিতেই ভূকম্প প্রবণ, ফলে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে হিমালয়ের ভূস্তরে তুমুল অস্থিরতা, তখন তার মাত্রা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। ফলে তাদের যে কোনও একটি বিন্দু থেকে অতিরিক্ত শক্তি বিচ্ছুরণ হতে পারে। এবং সেই শক্তির মাত্রা বেশি হলে সহজেই তা ছড়িয়ে পড়তে পারে একাধিক এলাকায়। ঠিক যেন সংক্রামক রোগের মতো। এর একটা বড় কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে বনভূমি ধ্বংসকে। ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বিধি ভেঙে যত্রতত্র বাড়ি-সেতু-হোটেল ইত্যাদি গজিয়ে ওঠায় ঝুঁকি আরও বাড়ছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য ব্যাহত হলে যে এর ফল আরও সুদূর প্রসারী হতে পারে সে কথাও বলাই বাহুল্য।

More Articles