পৃথিবীর শেষ কোথায়? পাহাড় ঘেরা ছোট্ট শহর উশুইয়াই আজও বিস্ময়ে ভরা

Ushuaia End of The World: শহরের চারদিক ঘেরা দুর্গম পাহাড় ও উত্তাল সমুদ্রের জন্য আর্জেন্টিনার সরকার ১৮৭৩ সাল থেকেই এখানে দেশের রাজনৈতিক বন্দিদের নির্বাসন দিতে শুরু করে।

পৃথিবীরও নাকি শেষ আছে! ভাবা যায়? ছোট থেকেই জেনে আসছি পৃথিবী গোলাকার, আর এই গোলাকার পৃথিবী নিয়ে আমাদের কৌতূহলেরও শেষ নেই। মাথা গ্লোবের মতনই ঘুরতে থাকে একটাই প্রশ্নে, এই পৃথিবীর কি সত্যিই কোনও শেষ নেই? যেমন সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে মনে হয় এর শেষ কোথায়? যদি অঙ্কের নিয়ম ধরি তাহলে দেখা যাবে, হিসেব অনুযায়ী একটি গোলাকার বৃত্তের কোনও প্রান্ত থাকে না। যেখান থেকে শুরু হচ্ছে সেখানে এসেই শেষ হচ্ছে। কিন্তু ভূ-বিজ্ঞানীরা নাকি খুঁজে পেয়েছেন পৃথিবীর শেষ অংশ। বিশ্ব জুড়ে খোঁজ চালিয়ে অবশেষে শনাক্ত করেছেন পৃথিবীর শেষ সীমা। কী আছে সেই শেষ প্রান্তে? একজন মানুষের পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে সেই অপর প্রান্তে যেতে সময়ই বা কত লাগবে? হয়তো আজীবন বা হয়তো অনেক কম সময়!

যেহেতু পৃথিবী প্রায় গোল তাই প্রকৃত অর্থে হয়তো এর শেষ বলে কিছু নেই। কিন্তু যখন পৃথিবীর শেষ সীমা শনাক্ত হয়েছে তাই সেই জটিল বিষয় নিয়ে অবশ্যই নানা মুনির নানা মতেরও শেষ নেই। বিজ্ঞানীরা ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট সাসেক্স বা রাশিয়ার সাইবেরীয় অঞ্চলের ইয়ামান পেনিনসুলা বা চিলির কেপহর্নকে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত বলে দাবি করেছেন। কিন্তু এগুলিকে অনেকে সীমানা মনে করলেও সবথেকে গ্রহণযোগ্য হল আর্জেন্টিনার উশুইয়াই। দক্ষিণ আমেরিকার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এই শহরকে পৃথিবীর শেষ শহর বলা হয়। ও দেশের ভাষায় ‘পৃথিবীর শেষ প্রান্ত’– Fin del mundo।

উশুইয়াই

আন্দিজ পাহাড়ের লেজের ফাঁকে গোঁজা এই অঞ্চলটির নাম ‘টিয়েরা দেল ফুয়েগো’ (Tierra del fuego) বা আগুনের দেশ। উত্তরে ম্যাজেলান প্রণালী ও দক্ষিণে বীগল চ্যানেল দুই মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। বিখ্যাত পর্তুগিজ আবিষ্কারক ম্যাজেলানই ‘টিয়েরা দেল ফুয়েগো’ নাম দেন। ১৫২০ সালে তাঁর নাবিকেরা স্থানীয় ইয়ামান আদিবাসীদের গ্রাম থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখে প্রথমে নাম দিয়েছিলেন ‘ধোঁয়ার দেশ’, তারপরে সেটা বদলে ‘আগুনের দেশ’ করা হল। কারণ ধোঁয়া থাকলে আগুন তো থাকবেই! এই আদিবাসীরা কিন্তু বেশিদিন বাঁচেননি। বন্দুক ও রোগের তাড়নায় কয়েক দশকের মধ্যেই সবাই নির্বংশ হয়। এখন এদেশে শুধু ইউরোপীয়দেরই বসতি।

দক্ষিণে ঠিক উশুইয়াইয়ের পায়ের তলায় আরেকটি সরু প্রণালী আছে যেখান দিয়ে ১৮৩৩ সালের ২৯ জানুয়ারি একটি বিখ্যাত জাহাজ এইচ.এম.এস. বীগল ও তার বিখ্যাত যাত্রী চার্লস ডারউইন প্রথম আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে পা দেন। তাঁরই জাহাজের নামে এটি ‘বীগল চ্যানেল’ নামে খ্যাত।

আরও পড়ুন- শিশুদের কলিজা খেয়ে বাঁচতেন বাংলার বেগম! মুর্শিদাবাদে আজও রহস্যে মোড়া এই জ্যান্ত কবর

বীগল চ্যানেল

ম্যাজেলান ও বীগল চ্যানেল দু’টিই বেশ সরু, দ্বীপসংকুল আর শীতকালে জমে বরফ হয়ে যায়। তাই বড়ো জাহাজগুলো কেপহর্ন ঘুরেই এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্রে প্রবেশ করে। কেপহর্ন দুর্দান্ত ঝড় ও স্রোতের জন্য কুখ্যাত। কেপহর্নের সামনে ৫০০ মাইল চওড়া যে প্রণালী আছে তার নাম ড্রেক প্যাসেজ (Drake Passage)। এখানেই দুই মহাসমুদ্রের উত্তাল মিলন। বিখ্যাত ব্রিটিশ নাবিক ফ্রান্সিস ড্রেকের নামে পরিচিত এটি। যদিও ড্রেক নিজেও এই প্যাসেজ দিয়ে যাওয়ার সাহস করেননি। ঝড়ে জাহজডুবির পর একটিমাত্র জাহাজ সম্বল করে ম্যাজেলান প্রণালী দিয়ে পাশ কাটান।

কেপ হর্ন

পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যেতে এইসব আবিষ্কারকদের প্রায় বছর দু’য়েক সময় লাগত। এখন দু’দিনেই আমেরিকা থেকে উশুইয়াই পৌঁছনো যায়। রাজধানী বুয়েনস এয়ার্স থেকে পম্পাস ও পাতাগোনিয়া পেরিয়ে পাঁচ ঘণ্টার উড়ান। প্লেনে কিন্তু মনে করে জানালার পাশের সীট নেবেন। কারণ, উশুইয়াইয়ের এয়ারপোর্টে নামা এক বিশেষ রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আন্দিজের বরফ ঢাকা চূড়াগুলি প্রায় ছুঁয়ে ফেলে প্লেন নিচে নামতে থাকে। নিচে শুধু উজ্জ্বল নীল সমুদ্র ও ঝকঝকে সাদা পাহাড়। পাহাড়গুলি এত কাছে যে মনে হয় জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। নিচে সমুদ্রের জলে ডোবার শেষ মুহূর্তে প্লেনটি মাটি ছোঁয়। পৃথিবীর শেষ প্রান্তে নামবার এমন রোমাঞ্চে যে কারও গায়ে কাঁটা দেবে।

শহরের চারদিক ঘেরা দুর্গম পাহাড় ও উত্তাল সমুদ্রের জন্য আর্জেন্টিনার সরকার ১৮৭৩ সাল থেকেই এখানে দেশের রাজনৈতিক বন্দিদের নির্বাসন দিতে শুরু করে। এদের উপর নানারকম অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারের কথা ইতিহাসে লেখা আছে। বলা হয়, ১৯০২ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত দ্বীপান্তরের বন্দিদের নিয়ে এখানে ‘নেভাল বেস’ বানানো হয়েছিল। সেই সময় জনবসতিহীন উশুইয়াইকে জনবহুল করার জন্য আর্জেন্টিনা সরকার বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকেই বন্দিদের এখানে নির্বাসন দেওয়া শুরু করে এবং পুনর্বাসিত করে। ১৯৪৭ সালে সরকার নিজেই এই ব্যবস্থা বন্ধ করে। পুরনো জেল এখন ঐতিহাসিক মিউজিয়াম।

উশুইয়াই থেকে একটু দূরে ‘টিয়েরা দেল ফুয়েগো ন্যাশনাল পার্ক’, ১৯৬০ সালে এর পত্তন। ঈগল, কারাকারা, কণ্ডোর, রাজহাঁস ইত্যাদি নানা পাখি ছাড়াও দুর্লভ হুয়ানাকো (Guanaco) দেখা যায়। এদের লোম পশমিনা থেকেও কোমল ও দামি। এছাড়া রয়েছে কিছু স্কুয়া, ক্যানকুইন এবং কিছু সমুদ্রচিল বা সিগাল। ক্যানকুইনরা দেখতে অনেকটা পেঙ্গুইনদের মতোই সাদা-কালো। তাদের লম্বাটে গলা এবং বড় বড় ডানা। এরা একটানা হাজার হাজার মাইল উড়তে পারে। ইসলে-ডে-লস লবোসে রয়েছে সিল এবং ভোঁদড়।

পাহাড় পরিবৃত এই শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ এতটাই মনোরম যে গ্রীষ্মকালেও ঠান্ডা থাকে, সঙ্গে প্রায়ই বৃষ্টিপাত। তাছাড়া সামুদ্রিক সিগাল দেখতে পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। এছাড়া আছে মেরিটাইম জাদুঘর যা ‘এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড মিউজিয়াম’ নামেই পরিচিত। বলা হয়, এখানকার লাইট হাউসটিও বেশ বিখ্যাত কারণ এটাই পৃথিবীর দক্ষিণ প্রান্তের শেষ লাইট হাউস। এরপর আন্টার্কটিকার পথে আর কোনও লাইট হাউসের দেখা পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন- পুজোয় বাড়ে লাশ, মড়া পোড়ানোর গন্ধে যেভাবে কাটে ডোমের দুর্গোৎসব…

শেষ লাইটহাউস

উশুইয়াইয়ের দু’পাশে পাহাড়ের সারি, কোথাও বরফ, কোথাও বরফ ছাড়া। ইয়াগালেস উপজাতিদের স্মৃতিও জড়িয়ে আছে পৃথিবীর শেষ শহরে। ইউরোপীয়রা আসার আগে এখানে বসবাস করত ইয়াগালেস উপজাতিরা। ইউরোপীয়দের বয়ে আনা রোগ এবং ক্রমাগত অত্যাচারে তারা প্রায় নিশ্চিহ্নের পথে। একদিন হয়তো শুধু রয়ে যাবে কিছু স্মৃতিচিহ্ন। উশুইয়াইতে সর্বপ্রথম গড়ে ওঠা বিল্ডিং সেলোসিয়ান চার্চটি এখনও আছে।

উশুইয়াই শহরটি ছোট্ট। বর্তমানে এই শহরের জনসংখ্যা ৫৭ হাজার। আয়তন ২৩ বর্গকিমি। পাশেই রয়েছে উশুইয়াই উপসাগর ও প্যাসো চিকো। এটি গিয়ে পড়েছে বীগল চ্যানেলে। ২৫০ মাইল দীর্ঘ এবং সাড়ে তিন মাইল চওড়া এই চ্যানেল থেকে বেরিয়েছে অনেক নদী-খাল-বিল। একদিকে চিলির পুয়ের্তো অ্যালমানরা, দক্ষিণ মেরু যাবার সব জাহাজগুলি এখান থেকেই ছাড়ে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে শহরটা নানা দেশের ট্যুরিস্টের ভিড়ে জমজমাট। ড্রেক প্যাসেজের এত কাছে বলে সবসময় এখানেও ঝোড়ো হাওয়া বইছে। গ্রীষ্মেও গড় তাপমাত্রা ১২°সেলসিয়াস আর হঠাৎ করে যে কোনও মুহূর্তে তাপমাত্রা একেবারে ২০°সেলসিয়াসও হতে পারে!

এখানকার অধিকাংশ মানুষের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনশিল্প। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম জাহাজ তা সে ব্যবসা-বাণিজ্য বা পর্যটন যাই হোক না কেন। এখানকার ‘ক্রুজ শিপ পিয়ার’টি আন্টার্কটিকার ক্রুজিংয়ের প্রবেশদ্বার। পৃথিবীর শেষ শহরের খোঁজ পাওয়া গেলেও এক চমৎকার সাইনবোর্ড লাগানো এখানে। তাতে লেখা ‘Ushuaia, end of the world , beginning of everything’, অর্থাৎ, ‘যেখানে শেষ, সেই থেকেই শুরু’। আবার একটু ঘুরিয়ে বললে পৃথিবীর শুরুটাও এখান থেকে। এই সমগ্র এলাকাটিকে পৃথিবীর শেষ বলা হলেও সম্পূর্ণটাই কল্পশক্তির বিচারে। সবাই মনে করেন এই স্বর্গীয় স্থানটিই হয়তো অন্তিম সীমানা। কিন্তু যুক্তিনির্ভর তথ্যের বিচারে গোলাকার এই ভূ-পৃষ্ঠে কোনও শেষ সীমা টানা কখনই সম্ভব নয়।
 

More Articles