ওষুধ হিসেবে যাত্রা শুরু, যেভাবে বাড়ল টমেটো সসের রমরমা..
History of Tomato Ketchup: ১৮৩০ নাগাদ টমেটো কেচাপের ব্যবহার শুরু হয় ওষুধ হিসেবে। ডায়রিয়া, বদহজম এমনকী জন্ডিস সারাতেও নাকি অব্যর্থ ছিল ওই সস।
রোল হোক বা চাউমিন, সিঙাড়া হোক বা পকোরা, সঙ্গে একটু সস না-হলে চলে নাকি! খাবারে আরও একটু স্বাদ যোগ করতে এই সস বস্তুটির জুড়ি মেলা ভার। শুধু এখানে নয়, গোটা বিশ্ব জুড়েই সসের খদ্দের কিছু কম নেই। সসের প্রকারভেদেরও শেষ নেই। কোথাও সোয়া তো কোথাও চিলি। তবে সস বললেই আমাদের মাথায় যে ছবিটা সবার আগে ভেসে ওঠে, তা বোধহয় কাঁচের লম্বা বোতল ভর্তি টমেটো কেটাপ। যে কোনও সাদামাটা খাবারকে সুস্বাদু 'ইয়াম্মি' করে তুলতে অদ্বিতীয় এই ম্যাজিক উপকরণটি। রেস্তোরাঁ হোক গেরস্থবাড়ি, রান্নাঘরের ব়্যাক আলো করে এই একটি জিনিস থাকবেই। তবে এই টমেটো সস বা কেচাপের শুরুর গল্পটা জানেন কি? আদৌ কি খাবারকে সুস্বাদু করে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল খাবারটি? শোনা যায় যে টোমাটো কেচাপ খাবারে আলাদা মাত্রা এনে দেয়, তা একদিন তৈরি হয়েছিল শরীরের প্রয়োজনে। ঠিকই পড়ছেন, টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদের এই দুর্দান্ত জিনিসটির আবিষ্কার ওষুধ হিসেবেই।
আরও পড়ুন: মুড়ি অথবা চা, চানাচুর ছাড়া জমে না সন্ধার জলখাবার, জানেন একে ইংরেজিতে কী বলে?
খুঁজতে বেরিয়ে সুদূর চিনে টমেটো কেচাপের উৎস খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা। সেখানে নাকি Ge-thcup বা Koe-cheup নামে ডাকা হত সসকে। সেগুলি অবশ্য ছিল মাছ থেকে প্রস্তুত সস। এখনও ভারতের উত্তরপূর্বের এলাকাগুলিতে মাছের সস বেশ জনপ্রিয়। সোয়াবিন ও মাছ থেকে তৈরি হত এই ধরনের সসগুলি। স্বাদ ছিস অনেক বেশি নোনতা ধরনের। ১৭৩৬ সালে সসের ইতিহাসে আসল প্রথম মোড়। ছোট মাছ ও বাসি মদ ফুটিয়ে এক ধরনের তরল তৈরি করা হত। এরপর সেটাকে পচিয়ে তৈরি হত এক ধরনের সস। খাবারের সঙ্গে খেতে দিব্য লাগত ব্যপারটি। ক্রমে সেই রেসিপি পৌঁছে গেল চিন থেকে ইংল্যান্ডে। কিন্তু প্রথম বার টমেটো কেচাপ তৈরি হল ১৮১২ সালে। নেপথ্যে ছিলেন জেমস মিয়াজে নামে এক বিজ্ঞানী ও হর্টিকালচারিস্ট। তাঁর হাতেই তৈরি হয়েছিল টমেটো কেচাপের রেসিপি। তবে তার ব্যবহার মোটেও শুরু হয়নি তখনও।
জানা গিয়েছে, ১৮৩০ নাগাদ টমেটো কেচাপের ব্যবহার শুরু হয় ওষুধ হিসেবে। ডায়রিয়া, বদহজম এমনকী জন্ডিস সারাতেও নাকি অব্যর্থ ছিল ওই সস। ড. জন কুক বেনেট নামে এক মার্কিন চিকিৎসকের মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল ব্যপারটি। শুধু কি সস, পিল বা ট্যাবলেটের আকারেও মিলত ওই মহৌষধী।
মুখে সবজি বললেও আমরা সকলেই হাড়ে হাড়ে জানি আসলে সেটি একধরনের ফল। যুগযুগ ধরে রান্নাবান্নার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে এই টমেটো। এমনকী পৃথিবীর দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম সবজি হিসেবেও নাম রয়েছে টোমাটোর। ভাবছেন প্রথম স্থানে কে? কে আবার? আলু। আর তার পরেই রয়েছে টমেটোর জায়গা। তবে মজার কথা কি জানেন, আজ থেকে দু'শো বছর আগেও নাকি খাবারের প্লেটের থেকে ফুলদানিতেই বেশি শোভা পেত এই ফলটি। শৌখিন বাগানকরিয়েরা মনে করতেন, খাবার সাজানোর চেয়ে ঘর সাজানোর ক্ষেত্রেই টোমাটো অনেক বেশি সুন্দর ও উপকারী। তাই অর্কিড, গোলাপ বা রজনীগন্ধা ফুলের মতোই চাষ করা হত টমেটোও। ওই আকর্ষণীয় রূপ দেখেই বোধহয় দু-একজন দাঁতে কেটে ফেলেছিলেন ফলটিকে। ব্যাস, তাতেই বিপদ বাড়ল টমেটো শ্রেণির। শুরু হল খাবারের পাতে টমেটোর বহুল ব্যবহার।
তবে ফুল, ফলের চেয়েও মেগা হিট হয়েছিল ড. বেনেটের ওই রেসিপি। ক্রমে বার্তা রটে গেল টমেটোর ভেষজ গুণের। তখনও পৃথিবীতে নকলনবিশের অভাব ছিল না কোনও। যে যার মতো টমেটো পিল বানিয়ে বেচতে শুরু করল বাজারে। শুরু হয়ে গেল রীতিমতো টমেটো পিলের লড়াই। বাজার ধরতে অনেকে টমেটো ছাড়াই টমেটো পিল বেচতে শুরু করল। স্কার্ভি থেকে শুরু করে সব রোগ সারাতে পারে সেই ট্যাবলেট, এমন দাবিও করে ফেলল তারা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। অচিরেই ফাঁস হল কুকীর্তি। তারাই দায়িত্ব নিয়ে ধ্বসিয়ে দিল কেচাপ মেডিসিনের সাম্রাজ্য। সেটা ১৮৫০ সালের কথা হবে।
মেডিসিনের সাম্রাজ্য থেকে ক্রমে বিদায় নিল টমেটো। তবে গল্পটা শেষ হল না। প্রায় কয়েক দশক পরে হেনরি হেইনজ নামে এক মার্কিন উদ্যোগপতির হাত ধরে নতুন দুনিয়া দেখল আজকের সস। কাঁচা টমেটো, বিশুদ্ধ ভিনিগার, ব্রাউন সুগার, নুন ও বিভিন্ন রকম মশলা মিশিয়ে বানিয়ে ফেললেন দুর্দান্ত এক রেসিপি। প্রথম থেকেই ভেষজ গুণের অংশটি সসের ভূমিকা থেকে ছেঁটে ফেললেন হেনরি। জানিয়ে দিলেন, এই টমেটো কেচাপ আসলে রান্না বা খাবারের স্বাদবর্ধক ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রথম বার পেনসিলভেনিয়ার পিটসবার্গে বীরদর্পে আত্মপ্রকাশ করল হেনরির তৈরি সস।
আরও পড়ুন: তরকারি থেকে চাটনি, টমেটো ছাড়া ফ্যাকাসে লাগে স্বাদ, জানেন এর বাংলা প্রতিশব্দ?
ব্যাস তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। নানা স্বাদের নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি সস বাজারে এসেছে, গেছে। তবে টমেটো কেচাপের জনপ্রিয়তায় হাত দিতে পারেনি একরত্তি। ক্রমে বিরাট একটি বাজার ধরতে সক্ষম হয়েছে এই টমেটো কেচাপ। এই স্বাদবর্ধকের স্বাদ বর্ধন করতে নিত্য চলছে পরীক্ষানিরিক্ষা। পাড়ার রোলের দোকান থেকে পাঁচ তারা রেস্তোরাঁর নামীদামী পাত, কোথাও একচোখামি নেই এই উপকরণটির। দামী থেকে সস্তা পাত, হেনরির ওই দুর্দান্ত রেসিপি কিন্তু আজও সবেতেই দশে দশ।