ডিসেম্বর: আলো-অন্ধকারের ভিতর ঝলসে ওঠা কাহিনিগুচ্ছ
December, The Story of War-torn Children: রেফাত যাওয়ার আগে বলে যায়, "আমাকে যদি মরতে হয়, তোমাকে বাঁচতেই হবে, আমার গল্প বলার জন্য।" ডিসেম্বর গল্প বলার মাস।
ডিসেম্বরে আলোর দেশের রাস্তাদের যেন আলাদাই দেমাক। মোড়ে মোড়ে টাঙানো আলোর চাঁদোয়া। ছোটো-বড়ো না-পাওয়াগুলোর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে শেখায় সেই আলোর কারিগরি। এইসব রাস্তাকে মুড়ে রাখে দারুন ঘ্রাণ, আমোদ-আহ্লাদের উষ্ণতা। সেই গন্ধ খিদে বাড়ায়। সেইসব রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখের পড়ে যায় যেসব মুখ, তারা সবাই খুশির ব্যস্ততার হাত ধরে ছুটছে। বিস্তর আয়োজন। সেই আয়োজনের উত্তেজনায় কেমন ঘোর লাগে। এই উদযাপনের শেষ নেই।
আর অন্ধকারের দেশে এই ডিসেম্বরে মাথার উপর চক্কর কাটে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। আকাশ বাতাস মুখর করে রাখে সেই শব্দ। এই মৃত্যু-মহোৎসবের শেষ নেই কোনও। মাঝে মাঝে শুধু ছোট বিরতি, একটু দম নেওয়া! তারপর ফের ছিলায় টান দিয়ে জেগে থাকা। সত্তর বছর ধরে এই চলছে। যুদ্ধের বাজারে সাজানো সারি সারি মৃতদেহের পসরা। সদ্য স্বামীহারা রৌজাম বসে আছেন ডিসেম্বরের রাস্তার ধারে, মৃতশরীর আগলে। তাঁর সংসারের মেয়াদ মাত্র ছ'মাস। মানুষটা চলে গেছে, পড়ে আছে তাঁর জুতোজোড়া। রৌজাম বুকে জড়িয়ে ধরে আছে সেই জুতো। ওগুলোই তাঁর ভালোবাসার স্মারক।
ডিসেম্বরের আলো শিশুকে আগলে রাখে। আলোর চাঁদোয়ার নিচে যে মা-ঠাকুমা-দিদিমারা হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁদের হাতে উপহার, খেলনার বাক্স। সেসব মোড়া হবে রংচঙে কাগজে। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে ছোটো ছোটো হাত সেই খেলনার রঙিন মোড়ক খুলবে। শিশুমন জানেনা ওই সব রাংতায় মোড়া বাক্সের ভিতরে কী আছে! সে এক দারুণ খেলা। হাসি-আনন্দস্বরে খিলখিলিয়ে ওঠে ডিসেম্বরের রাস্তা, আকাশ-বাতাস।
আরও পড়ুন: প্রতি ১০ মিনিটে ১টি শিশুর মৃত্যু! ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু গাজায়! আর কত?
এই ডিসেম্বরে অনাথ হলো রাজান। সে এখনও জানেই না যে ডিসেম্বরের মোড়ক খুললেই তার জন্য বেরিয়ে আসবে নিদারুণ সব উপহার। বাবা, মা, দুই বোন, পরিবারের প্রায় অধিকাংশ মানুষই হাপিস হয়ে গিয়েছে বিমান হামলায়। আকাশে সে এক তীব্র আলো। সেই প্রাণকাড়া আলো তাকেও তো কম জখম করেনি! এই দশ বছরের জীবনে ডিসেম্বর তার গায়ে লাগিয়ে গিয়েছে অজ্ঞাত এতিমের (পিতাকে হারিয়েছে যে শিশু) তকমা। যতক্ষণ না দূরের কোনও আত্মীয়, কোনও স্বজন রাজানদের খুঁজে বের করে, ততক্ষণ তারা অজ্ঞাতপরিচয়। এ এক অদ্ভুত আলো-অন্ধকার, জানা-না জানার সীমান্তে কাটানো ছোটবেলা। রাজান শুধু চায়, যুদ্ধ শেষ হোক এই ডিসেম্বরেই।
শেষ হোক বললেই কি শেষ হয় আর! ডিসেম্বর যেন খিদের মতোই তীব্র, অবিরাম। আলোর দেশে ডিসেম্বর মানে ক্যারামেলে আবৃত কাঠবাদাম। উষ্ণ মুল্ড ওয়াইন। ভাজা মাংসের গন্ধ। কাঠের আগুনে সেঁকা আস্ত মাছ , মিন্স পাই, পুডিং- আরও কত কি। আরেক প্রান্তের রাস্তায় এক টুকরো রুটি আর জলের একটা বোতলের জন্য হাতাহাতি করায় ডিসেম্বরের খিদে। ত্রাণের গাড়ি দেখলেই দৌড় লাগায় মানুষ। তারেকের দশজনের পরিবার অনাহারে। ঘরে রুটি বানানোর মতো আটাটুকু নেই। অন্ধকারের দেশের ডিসেম্বরের রাস্তায় পঞ্চাশ ভাগ মানুষই ভরপেট খাননি অনেকদিন। যা পরিস্থিতি, মহামারী লেগে গেল বলে। ডিসেম্বরের আলিঙ্গন কঠিন। প্রাণ ধরে রাখা দায়।
ডিসেম্বর স্বপ্নের মাস। নতুন বছর শুরুর স্বপ্ন, নতুন করে ভাবার-বাঁচার স্বপ্ন। বছরের শেষের দিনগুলোয় সব আনন্দ জমাট বেঁধে থাকে। ঘুম থেকে উঠলে আদর, আত্মীয়দের হাসি-যত্ন, উপহার, স্কুল-কলেজের ছুটি। বছর শেষের কটা দিন সবাই ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে বলে, বলে পুরনো মান-অভিমান, অপরাধ ক্ষমা করে দিতে। ক্ষমায় অনাবিল প্রশান্তি, আনন্দ। আনন্দ করে যুদ্ধবাজ দেশের সৈন্যসামন্তরাও, বিকট আনন্দ, উল্লাস। উড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে স্কুলবাড়ি। খেলনার দোকান ভাঙচুর, শিশুর বই ছিন্নভিন্ন। মায়ের আদরে আলোর দেশে শিশুদের ঘুম ভাঙে! অন্ধকারের দেশে ভয়ঙ্কর বোমার শব্দ ঘুম ভাঙায় আলুথালু শিশুটির, তীব্র আর্তনাদে কানে তালা ধরে যায়! ভয়ে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে বাইরে। যে স্কুল বাড়িটা উড়ে গেল বিকট শব্দে, সেটাই ছিল ওর পরিবারের শেষ আশ্রয়। খুদে ছেলেটি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে চেনা মানুষগুলোর লাশের খোঁজে। বাবা-মা বা ছোট্টো বোনটাকে খুঁজে পেলে বর্তে যায় এ জীবন। অন্তত লাশটুকুও যদি পাওয়া যেত! উরসুলা কে. লে গুইনেএর ‘The Ones Who Walk Away from Omelas’-এর কথা মনে পড়ে যায়। এক যে ছিল দেশ। যে দেশের শান্তি, আনন্দ, সমৃদ্ধি নির্ভর করবে সে দেশের এক শিশুর উপরে। সেই দেশের মানুষ তাকে ঠিক কতটা অত্যাচার করতে পারবে তার উপরে। অথচ শিশুটিকে ন্যূনতম খাবার-পানীয় দিয়ে জিইয়ে রাখতে হবে। সে গোঙাবে, কাঁদবে, নিজের বর্জ্য নিজের গায়ে মেখে বসে থাকবে বন্দিশালায়। যতদিন এভাবে চলবে ততদিন দেশের বাকি মানুষের দিন কাটবে অফুরন্ত অনাবিল আনন্দে। তাই দেশবাসী শিশুটিকে দেখতে যায় নিয়ম করে। দেখে কষ্ট পায়, নানা কুযুক্তি তৈরি করে অত্যাচারের স্বপক্ষে। তবু তাকে মুক্তি দেয় না। অন্ধকারের দেশ যেমন হাজার হাজার শিশুর হত্যাভূমি রচনা করে। তাদের এতিম বানিয়ে সৈন্যরা চিৎকার করে গান গায়। একে অপরকে অভিনন্দন জানায়। বলপূর্বক অধিকৃত ভূমি এভাবেই একদিন পাল্টে যাবে ইউটোপিয়ায়। আজ সত্যিই আনন্দের দিন। নিজের প্রতিশ্রুতি রেখেছে ডিসেম্বর।
ডিসেম্বর উৎসবের মাস। রাষ্ট্রের নেক্রোপলিটিক্যাল উচ্চাকাঙ্ক্ষার আস্ফালনের মাস। বাঁচা-মরা নির্ধারণের মাস। অপ্রতিসম ক্ষমতার অন্য প্রান্তে থাকা সমষ্টিকে দমনের মাস। অন্ধকারের দেশে ডিসেম্বরের এ রাস্তা কোথাও নিয়ে যায় না। সুবিশাল এক খাঁচার ভিতরে ঘুরিয়ে মারে খালি। এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি নেই। রাষ্ট্র প্রতিপক্ষের শরীর চায়, 'অপর' একটি শরীর । এক বিরাট রক্তপিপাসু আদিম দেবতা যেন, বলি না পেলে তার তৃপ্তি নেই। সেই 'অপর' শরীরটিকে হয় হতে হবে অনুগত, সহজবশ্য আর নাহলে মৃত। সেই 'অপর' শরীর অর্ধনগ্ন কিশোর-যুবা, সারি দিয়ে ডিসেম্বরের রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে থাকে বন্দুকের নলের দিকে তাকিয়ে। সেই সমষ্টির শরীর অদরকারি ও ব্যয়যোগ্য। তাই আটকানো যায় ত্রাণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নজরদারি করা যায়। ক্ষমতা প্রয়োগ করে দমন করা যায়। আবার সেই 'অপর' শরীর যদি নারী হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সোজাসুজি বন্দুকের নল তাক করা যায় তাঁর গর্ভে। ভবিষ্যতের বীজকে নির্মূল করতে বলপূর্বক গর্ভনিরোধক দেওয়া যায়। ইতিহাস প্রমাণ, এই পদ্ধতিতে ইথিওপীয়-ইহুদি মহিলাদের জনসংখ্যা অন্তত ৫০ শতাংশ কমিয়ে ফেলা গিয়েছে।
শরীরকে যদিও বা ডিসেম্বরের অন্ধকার কাবু করে, মনকে বশে আনতে পারে কি সে? রেফাত যাওয়ার আগে বলে যায়, "আমাকে যদি মরতে হয়, তোমাকে বাঁচতেই হবে, আমার গল্প বলার জন্য।" ডিসেম্বর গল্প বলার মাস। যে শহরে আলো জ্বলে, সেই শহরে গল্প বলার আমেজ আলাদা। ফায়ারপ্লেস এর সামনে বসে স্মৃতিচারণ, আড্ডা, পানীয়-সহযোগে নস্টালজিয়া। কিন্তু যে শহরে আলোর উৎস মিসাইল, সেখানে এক শিশু স্বর্গের চোখে চোখ রাখে। বিদায় না-জানিয়ে যে জনক চলে গেছে, তার অপেক্ষায় আকাশে স্নেহবাহক ফারিস্তা দেখে। "আমাকে যদি মরতেই হয়, তা যেন আশা যোগায়, তা যেন কাহিনি হয়ে থাকে।" ডিসেম্বরের এই অন্ধকারের দেশে মৃত্যু কাহিনিই বটে। প্রতিপক্ষের জীবিত শরীরের উপর যেমন আদিম রাষ্ট্রের শাসন, তাঁর মৃতদেহের উপরেও রাষ্ট্রের সমান কব্জা। বাসেলের মৃতদেহ ৭৫ দিন ধরে হিমঘরে। মৃতদেহ সামনে রেখে চলে আলোচনা। সেই 'অন্য' দেহের যথাযথ সমাধি এবং শোক পালনে ব্যাঘাত ঘটিয়ে সেই কাহিনিকে বাঁচিয়ে রাখে। জীবিতের যা ক্ষমতা, মৃতের ক্ষমতা তার তুলনায় কিছু কম নয়। প্রতিবাদ ও শাহাদাত- এই দুইয়ের পথ অবরুদ্ধ করতেই এই আয়োজন।
আরও পড়ুন: ৫০ হাজার গর্ভবতী মহিলা যুদ্ধের শিকার! প্রিম্যাচিওর শিশুদের মৃত্যু দেখবে গাজা?
ডিসেম্বর আমাদের সামনে এনে হাজির করে এক ব্যতিক্রমী সময়। ক্ষমতা ও তার প্রয়োগও ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে। সার্বভৌম রাষ্ট্র কয়েক জন নাগরিকের ভালো কথা ভেবে কানুন অতিক্রম করে। 'অপর' সেই শরীর এই অতিক্রম দেখে, সহ্য করে। তাঁদের শরীরে রাষ্ট্রের এই ব্যতিক্রমী কাহিনি খোদাই হয়ে থাকে। ডিসেম্বরের আলো-অন্ধকারের আওয়াজের ভিতরে সে কাহিনি ঝলসে ওঠে বার বার । কাহিনি থাকুক! 'অপর' যেন নির্মূল হয়। তাহলেই তো হাতের মধ্যে স্বপ্নরাজ্য, ইউটোপিয়া।