সম্পত্তির মালিক, নিজের মালিক গাছ নিজেই! মন ভালো করা যে কাহিনি লুকিয়ে আড়ালে

Legal ownership of Oak Tree: গাছটির মালিকানাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রতিবছর অ্যাথেন্স শহরে উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবে ওই শহরের শেরিফ, মেয়র থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকে একটি করে গাছের বীজ পোঁতেন।

আমেরিকার জর্জিয়ার অ্যাথেন্স শহরের সাউথ ফিনলে স্ট্রিটে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটি ওক গাছ। মার্কিন মুলুকে অ্যাথেন্সের ওই রাস্তার এই গাছটির মধ্যে কী এমন বিশেষত্ব আছে যে এই গল্পটি পাঠক পড়বেন। আছে, বিশেষত্ব আছে। সকলেই জানি যে বাগানের মালিক হয়, বাড়ির ভেতরে গাছ হলে সেই গাছের মালিক হয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন একটি গাছও আছে যার মালিক আর কেউ নয় গাছটি নিজেই। জানলে অবাক হবেন, অ্যাথেন্স শহরের সাউথ ফিনলে স্ট্রিটের এই ওক গাছের মালিক আসলে এই গাছটি নিজেই। আজ্ঞে হ্যাঁ! সরকারিভাবে গাছটির মালিক গাছটি নিজেই। শুধু তাই নয়, ফিনলে স্ট্রিটের ওই জায়গায় প্রায় ২০০ স্কোয়ার ফিট জমির মালিকও ওই গাছটি। অবশ্য এই মালিকানাপ্রাপ্তির একটা ইতিহাসও আছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর একদম শেষ ভাগের কথা। এক প্রকৃতিপ্রেমী কিশোর নিজের পরিবারের সঙ্গে বাস করতো সাউথ ফিনলে স্ট্রিটের ওই এলাকায়। গ্রীষ্মের ছুটিতে খেলার ছলেই সেই কিশোর আপন মনে পোঁতে ওক গাছটি। শুধু পোঁতেই না, সেটিকে খুব পরিচর্যা করে বড়ও করে তোলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাছটির প্রতি এক অমোঘ মায়া জন্মে যায় সেই কিশোরের। সে পণ করে আমৃত্যু গাছটিকে রক্ষা করবে। কিশোরটি নিজের কথা রেখেছিল। ইতিহাসের দস্তাবেজ ঘাঁটলে জানা যায় কিশোরটির নাম ছিল উইলিয়াম এইচ জ্যাকসন। নিজের প্রতিশ্রুতি মতো আমৃত্যু গাছের পরিচর্যা করে ১৮১২ সালে মারা যান কর্নেল উয়িলিয়াম এইচ জ্যাকসন। মৃত্যুর আগে গাছটির জন্য তিনি একটি ‘ডিড’ করে যান। সেই ডিড অনুযায়ী, চারিদিকের ৮ ফিট পর্যন্ত জমি গাছটির মালিকানাধীন। উইলিয়াম মারা গেলেও গাছ কিন্তু একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল। উইলিয়াম চোখ বুঁজলে আশেপাশের প্রতিবেশীরা নিত্য পর্যবেক্ষণে রাখতেন গাছটিকে। সুন্দর পরিচর্যার কারণে বেশ বড় হয়ে ওঠে গাছটি। ১৮৩২ সালে গাছটির সামনে কর্নেল উইলিয়াম এইচ জ্যাকসনের স্মৃতিতে একটি ফলক লাগানো হয়। তাতে লেখা ছিল -

“For and in consideration of the great love I bear this tree and the great desire I have for its protection for all time, I convey entire possession of itself and all land within eight feet of the tree on all sides.”

- Col. William H. Jackson

বর্তমানে ফলকটি না থাকলেও তার একটি পুরনো ছবি নিচে দেওয়া হল।

আরও পড়ুন- সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক-কমেন্ট না পেলেই বিষণ্ণ! চরম আসক্তির দায় আসলে কার?

কর্নেল উইলিয়াম জ্যাকসনের স্মৃতিফলক

এরপর সোজা এগিয়ে চলুন আরও ১৩০ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৪২। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শিয়রে। ৫০ ফিটের ওক গাছটি তখন সুস্থ সতেজ অবস্থায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ততদিনে গাছটি কার্যত সাউথ ফিনলে স্ট্রিটের ল্যান্ডমার্কে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বেশিদিন আর দাঁড়িয়ে থাকা হল না। কোনও এক শীতের বিকেলে তুমুল তুষারঝড় বা ব্লিজার্ডে উপড়ে যায় গাছটি। আপনজন হারানোর দুঃখে ভেঙে পড়ে গোটা এলাকা। তবে এই ঐতিহ্যকে মরতে না দিয়ে, অ্যাথেন্সের জুনিয়র লেডিজ গার্ডেন ক্লাবের সদস্যরা গাছটি প্রতিস্থাপনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। গার্ডেন ক্লাবের সদস্যরা ওই একই জায়গায় ওক গাছের ফল নিয়ে আবার সেখানেই পুঁতে দেন। কর্নেল জ্যাকসনের স্মৃতিবিজরিত এই গাছটির নিয়মিত পরিচর্যা শুরু করেন তাঁরা। কালক্রমে সেখান থেকে গজিয়ে ওঠে নতুন আরেকটি ওক গাছ। নতুন গাছটিকে সরকারিভাবে সেই উপড়ে যাওয়া গাছটির বংশধর বলে ঘোষণা করা হয়।

আরও পড়ুন- একজন খুনি, বারো জন বিচারক! বাংলা নাট‍কের দর্শককে ভাবাবে ‘এক থেকে বারো’

কিন্তু এখানে একটি মজার জিনিসও ঘটে যায়। নতুন ওক গাছটি যেহেতু সরকারিভাবে ওই পুরনো ওক গাছের বংশধর তাই আইনিভাবে সেই গাছটির মালিক ওই গাছটি নিজেই। বর্তমানে সেই গাছটি কিছুটা জমিও অধিগ্রহণ করে আছে এবং সেই জমি প্রতিদিন নিয়মিত পরিষ্কার করে স্থানীয় মিউনসিপ্যালিটি। প্রসঙ্গত, ওই এলাকার দ্বিতীয়-তৃতীয় প্রজন্ম এখন বর্তমানে ওখানকার বাসিন্দা। বর্তমানেও এই ওক গাছটি তাঁদের একান্ত গর্বের জিনিস। ওক গাছটিকে নতুন জীবন দেওয়ার জন্যে অ্যাথেন্সের সকল বাসিন্দা জুনিয়র লেডিজ ক্লাবের কাছে ঋণী। ওই ক্লাবের দীর্ঘদিনের দুই সদস্য লাভাত উইলকিন্স এবং মেরিয়ান হুডসন, ১৯৪০-এর দশকে গাছটিকে পুনরায় দাঁড় করাতে মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

আসলে বাবা-মায়ের সম্পত্তির মালিক যেরকমভাবে সন্তান হয়, সেভাবে পুরনো গাছটির মালিক নতুন গাছটি। শুনতে একটু অদ্ভুত লাগলেও আইনিভাবে এটাই বাস্তব। কয়েক সপ্তাহ আগে এই গাছেরই কেস স্টাডি দিয়ে পিটসবার্গের একটি ব্ল্যাকগাম গাছকে নিজেরই মালিকানা সঁপে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সেখানকার আদালত। অ্যাথেন্স শহর এখনও ওই গাছটিকে নিজেদের গর্ব মনে করে। শুধু তাই নয় গাছটির মালিকানাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রতিবছর অ্যাথেন্স শহরে উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবে ওই শহরের শেরিফ, মেয়র থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকে একটি করে গাছের বীজ পোঁতেন। প্রত্যেক বছর স্থানীয়রা এই গাছের জন্মদিন বড় ধুমধাম করে পালন করেন। এছাড়াও ক্রিসমাসে নানা রকমের লাইট, খেলনা, চকমকে স্টিকার ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয় এই গাছটি। তবে এত উৎসবের মাঝেও বাসিন্দারা দু’টি বিষয় কক্ষনও ভোলেন না, নিয়মিত বৃক্ষরোপণ এবং চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। প্রতি বছর আরবোর দিবসে, স্থানীয় স্কুলগুলি থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসে এখানে বৃক্ষরোপণ করে।

জর্জিয়ার ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের দাবি, আজ পর্যন্ত কেউ কোনওদিনও ওই গাছটির মালিকানা নিয়ে কোথাও কোনও মামলা করেননি। এর থেকেই বোঝা যায় ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে গাছটি কতটা বেশি আবেগের। আজও কেউ অ্যাথেন্স শহরে গেলে সাউথ ফিনলে স্ট্রিটের ওক গাছ দেখে আসতে ভোলেন না। যদি কখনও সুযোগ হয় আমেরিকা ভ্রমণের, একবার পারলে ঢুঁ মেরে আসবেন জর্জিয়ার অ্যাথেন্স শহরের সাউথ ফিনলে স্ট্রিট। গাছটির সঙ্গে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে ভুলবেন না কিন্তু!

More Articles