গো-রক্ষকদের তাণ্ডব থেকে ফ্যাসিবাদের জয়গান, ভারত হওয়া সত্যিই সহজ নয়!
violence of Cow Vigilantes in India: আমাদের স্মৃতিতে এখনো দগদগে মহম্মদ আখলাখের কথা। ২০১৫ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের বিসরাহা গ্রামে ঘটে যাওয়া নৃশংসতা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ক্ষত।
সাবির মল্লিক ছিলেন আমাদের সহ-নাগরিক, এ রাজ্যের বাসিন্দা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার বাসন্তী থানার বাসিন্দা এই তরুণ হরিয়ানা গিয়েছিলেন জীবিকার সন্ধানে। লোকের বাড়ি থেকে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়ামের নানান বাতিল মালপত্র সংগ্রহ করাই ছিল এই পরিযায়ী শ্রমিকটির পেশা। মানুষটির উপার্জনের উপর নির্ভর করে বসে থাকত সাবিরের স্ত্রী, দেড় বছরের শিশু সন্তান, বাবা-মা। অবশেষে সাবির বাড়ি ফিরছেন, তবে কফিন বন্দী হয়ে। কয়েকদিন আগে হরিয়ানার কিছু গোভক্ত যুবক সাবিরকে পিটিয়ে মারে কারণ তাদের সন্দেহ হয়েছিল যে সাবির বোধহয় গো-মাংস ভক্ষণ করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান থেকে জানা যায় যে প্রথম দফার মারের পর হরিয়ানার সেই গ্রামের কিছু মানুষ সাবিরকে ছেড়ে দিতে বলে। তবে সেই অনুরোধে এই স্বনিযুক্ত গো-রক্ষকরা কান দেননি, স্থান পরিবর্তন করে মারধর চলতেই থাকে, যতক্ষণ না সাবিরের মৃত্যু নিশ্চিত হয়। ঘটনার পর সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নায়েব সিং সাইনির প্রতিক্রিয়াও বাঁধিয়ে রাখার মত। তিনি বলেছেন গ্রামের হিন্দু মানুষেরা গো-মাতাকে এতই ভক্তি শ্রদ্ধা করে যে তাদের রোখার সাধ্য কারওর নেই। সংবিধানে মানুষ তার নিজের পছন্দ মত খাবার খেতে পারবে, ধর্মাচরণ ও সংস্কৃতি চর্চা করতে পারবে, আইনের শাসনকে নিশ্চিত করতে হবে— এসব রত্ন খচিত কথাবার্তা লেখা আছে বটে তবে আজ আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারছি যে 'দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক' বলে দেগে দেওয়া সংখ্যালঘু মুসলমানদের এ ভাবে মেরে ফেলা যেতেই পারে কারণ এই সব নিয়মকানুন ঠিক তাদের জন্য নয়।
বাহাত্তর বর্ষীয় আসরাফ আলি সাবিরের তুলনায় ভাগ্যবান। ঐ দিনই মহারাষ্ট্রের লোকাল ট্রেনে জলগাঁও থেকে কল্যাণ যাওয়ার পথে আসনে বসা সংক্রান্ত একটা সাধারণ বিবাদকে কেন্দ্র করে কয়েকজন যুবক আসরফকে গো-মাংস নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে ব্যাপক মারে। বীর পুঙ্গবেরা এখানেই ক্ষান্ত হয়নি, একের পর এক ঘুষিতে রক্তাক্ত ঐ বৃদ্ধের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। গোটা দেশ দেখতে পায় গো-ভক্তদের এই অসীম বীরত্বের কাহিনী। এক্ষেত্রেও আইন রক্ষকদের ভূমিকা আলাদা কিছু নয়। নতুন চালু হওয়া ন্যায় সংহিতা থেকে হালকা কিছু ধারা লাগু করা হয়, যাতে একই দিনে অভিযুক্তদের জামিন পেতে অসুবিধা না হয়।
আরও পড়ুন: ভারতের সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কায়েমে আরএসএস-এর ভূমিকা
বলে রাখা ভালো যে বর্তমান সময়ে গো-মাংস বহনের অভিযোগ তুলে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা বা শারীরিক নিগ্রহের খতিয়ান তৈরি করা, এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয় কারণ এটাই নতুন ভারতের বাস্তবতা। আমাদের স্মৃতিতে এখনো দগদগে ক্ষতের মত জেগে আছে মহম্মদ আখলাখের কথা। ২০১৫ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের বিসরাহা গ্রামে ঘটে যাওয়া নৃশংসতা অবশ্যই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক দাগ হিসাবে থেকে যাবে। প্রথমে মোবাইল ফোনে মেসেজ এবং পরে গ্রামের বাবা মন্দির থেকে লাউডস্পিকার-বাহিত রণ হুঙ্কার শুনে এক হাজারের বেশি মানুষ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জমা হয়েছিল ঐ গ্রামের এক ছোট্ট মুসলিম মহল্লার সামনে। আখলাখের বাড়ির ফ্রিজে গোমাংস রাখা আছে, এই অভিযোগ তুলে আখলাখকে পিটিয়ে মারে গ্রামবাসী। আখলাখের পুত্র আনিশ জীবন্মৃত অবস্থায় আজও বেঁচে আছে। সেই মাংসের জাত বিচার নিয়ে কম নাটক হয়নি। ফরেন্সিকের প্রাথমিক রিপোর্ট বলা হয়, সেটা ছিল খাঁসির মাংস, পরবর্তীতে সেই রিপোর্ট তুলে নেওয়া হয়। আখলাখ কাণ্ডের পৈশাচিকতা আমাদের কিছুটা চমকে দিলেও পরবর্তীতে তা আর আমাদের বিবেককে আর স্পর্শ করেনি। আমরা সবাই এটাকেই অমৃত কালের ভারতের যোগ্য অভিজ্ঞান বলে মেনে নিয়েছি।
আমরা যদি শুধুমাত্র জুন মাসের (২০২৪) ঘটনাবলীর দিকে চোখ ফেরাই তবেই আজকের ভারতে সংখ্যালঘু মানুষের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে: ৫ জুন— কাশ্মীরে পুলিশ হেফাজতে যুবকের মৃত্যু। পরিবারের পক্ষ থেকে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি। ২ জুন— ট্রাকে করে গরু নিয়ে যাওয়ার অপরাধে ছত্তিসগঢ়ের রায়পুরে সাদ্দাম কুরেশি, চাঁদ মিঞা ও গুড্ডু খান নামে তিন যুবককে পিটিয়ে মারা হয়। ১১ জুন— লখনউয়ের আকবর নগরে মুসলিম মহল্লাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু। ১২ জুন— হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা খ্রিস্টান পরিবার আক্রান্ত। দশ দিনের মধ্যে ধর্মান্তরিত করার হুমকি। ১৪ জুন— মুখ্যমন্ত্রী আবাস যোজনায় ঘর পাওয়া এক মুসলিম মহিলাকে ঘিরে বাকি হিন্দু পরিবারের মহিলাদের বিক্ষোভ। তাদের দাবি 'সম্ভাব্য সন্ত্রাসীদের' কোনও আবাসন দেওয়া যাবে না। ঘটনাস্থল গুজরাট। ১৫ জুন— ইদের প্রস্তুতি চলার সময় তেলেঙ্গানায় হিন্দুত্ববাদী একটি গোষ্ঠীর হিংসা। ১৫ জুন— উত্তরপ্রদেশের একটি কাফেটারিয়ায় 'বিফ বার্গার' রাখার দায়ে মালিকের গ্রেফতারি ও দোকানে তালা। ১৭ জুন— ইদের পশুবলি নিয়ে ওড়িশার বালাসোর ও খোরদাতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। কার্ফু লাগু। ১৮ জুন— হিমাচলের নাহানে ইদের কোরবানির দৃশ্য হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়ার কারণে মুসলিমদের দোকান ভাঙচুর ও লুঠতরাজ। ১৯ জুন— উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে মহম্মদ ফরিদ নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা। উন্মত্ত ভিড় ফরিদের মুসলিম পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার প্যান্ট খুলে দেয়। ২২ জুন— অসমে বনরক্ষীদের গুলিচালনায় দুই মুসলিম যুবকের মৃত্যু। পরিবার ও অধিকার কর্মীদের পক্ষ থেকে ভুয়ো সংঘর্ষের অভিযোগ। ২২ জুন— গুজরাটে ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন সলমন ভোরা নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা। ২৫ জুন— সরকারি জমিতে নমাজ পড়ার অভিযোগে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের নজন মুসলিম যুবককে গ্রেফতার। ২৭ জুন— মধ্যপ্রদেশে 'গোমাংস বিরোধী' অভিযান চলাকালীন একাধিক মুসলিম দোকান ভেঙে দিল পুলিশ। ২৯ জুন— জম্মু কাশ্মীরের কাটুয়াতে মসজিদ ভাঙার চেষ্টা। (তথ্যসূত্র: মক্তব নিউজ ডটকম)
সাবির ও আসরাফের পরিণতি দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল কয়েকদিন আগে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের উথালপাথাল ঘটনা চলাকালীন সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের গর্বিত সুবচনী যার শিরোনাম ছিল 'ভারত হওয়া সহজ নয়'। সেই সব সুদৃশ্য পোস্ট আমাদের জানান দিচ্ছিল শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, লিঙ্গ সাম্যের নিরিখে আমরা এক আদর্শ দেশ। আমাদের আচরণ ও ব্যবহার, নৈতিক মূল্যবোধের মাপকাঠিতে এতটাই উঁচুতে যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার বর্বর, হীন মানুষজন আমাদের হিংসে করতে পারে কিন্তু সমকক্ষ হওয়া নেহাৎই অসম্ভব। একটু নজর করলে দেখা যাবে এই সমস্ত সুপরিকল্পিত পোস্টগুলো একটা বৃহত্তর মতাদর্শ হাজির করে। এই মতাদর্শ আমাদের শেখায় 'হিন্দি - হিন্দু - হিন্দুস্তান' স্লোগানের অনিবার্যতা, বোঝায় কেন ভারতের হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে ওঠা আশু প্রয়োজন।
এই শূন্য গর্ভ আস্ফালনের স্বরূপ উন্মোচিত হতে সময় লাগে না। আমাদের এই পারস্পরিক পিঠ চাপড়ানির মধ্যেই ঘটে যায় হাড় হিম করা পৈশাচিকতার আরেক উদাহরণ অভয়ার ধর্ষণ ও হত্যা। রাজ্যের এক প্রথম সারির মেডিকেল কলেজে কর্মরতা অবস্থায় খুন হলেন এক তরুণী চিকিৎসক। অন্তত অভয়ার ক্ষেত্রে সদর্থক বিষয়টা হল শাসক দলের যাবতীয় চোখ রাঙানিকে অগ্রাহ্য করে প্রতিবাদের নতুন উদাহরণ স্থাপন করে চলেছেন নাগরিক সমাজ। সংসদীয় দলগুলো এই আন্দোলনকে ক্ষমতা দখলের ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করার হাজারো চেষ্টা এখনো পর্যন্ত ব্যর্থ। কিন্তু মহারাষ্ট্রের বদলাপুর বা যোগীরাজ্যে সেই প্রতিবাদটুকুরও দেখা মেলে না।
মহারাষ্ট্রে স্কুলের মধ্যে দুই শিশুকে যৌন নির্যাতন করল স্কুলের এক কর্মী। যোগীরাজ্যে দু'জন দলিত কন্যাকে ধর্ষণ ও খুন করে গাছে লটকে দিল উচ্চ বর্ণের মানুষ। একটা সমাজ কতটা উন্নত, কতটা সংবেদনশীল তা বোঝা যায় সেই সমাজে মেয়েদের অবস্থার মানদণ্ডে। ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩১,০০০ ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়। এই পরিসংখ্যান হিমশৈলের চূড়ামাত্র— সামাজিক গ্লানি, পারিবারিক বাধ্যতা, সমাজপতিদের নিদানের কারণে দেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের একটা বড় অংশের খবর থানা অবধি পৌঁছায় না। সোশ্যাল মিডিয়ার সুবচনীর বিপরীতে ভারত আজ ধর্ষণের প্রজাতন্ত্র। ধর্ষণের চেয়ে কম পৈশাচিক নয় এই ঘটনা, যখন আমরা দেখি খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী ক্ষেত্র বারানসীর আইআইটি-বিএইচইউ এর ছাত্রীদের গণধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত আইটিসেলের সদস্যরা গ্রেফতারির সাত মাসের মধ্যে যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায় আর জেলের বাইরে সেই ঘৃণ্য মানুষগুলোকে ফুল ও বাজনা সহযোগে সংবর্ধনা দেবার জন্য অপেক্ষা করে থাকে কয়েক'শ মানুষ। গত সপ্তাহে নিজের ধর্ষণের ঘটনা থানায় নথিভুক্ত করতে না পারার হতাশায় উলঙ্গ হয়ে দৌঁড়াতে থাকে নির্যাতিতা তরুণী। গুজরাট সরকারের মদতে বিলকিস বানো গনধর্ষণের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা মেয়াদ শেষ হবার আগেই মুক্তি পেয়ে যায়।
আরও পড়ুন:নরম হিন্দুত্ব দিয়ে বিজেপিকে রোখা যাবে না : পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা
এই ভারত দীর্ঘদিনের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফসল। এই আপাদমস্তক পিতৃতান্ত্রিক, ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থা সহজে তৈরি হয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে গণতান্ত্রিক, সমতাবাদী, মুক্তমনা সমাজের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তা আজ অতীত। এই হিন্দুত্ববাদী ভারত এক শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে চায় যা চরিত্রগত ভাবে ফ্যাসিবাদী। সাম্য, জাতপাতের অভিশাপমুক্ত ভারতের জন্য যে সংবিধান রচিত হয়েছিল, তা গুঁড়িয়ে দিতে তৈরি নতুন ভারতের নায়কেরা। সত্যি, এই ভারত হওয়া সহজ নয়!