গণতন্ত্রের জন্য টাকা লুঠ! পিস্তলধারী গান্ধীবাদী প্রধানমন্ত্রী কৈরালা ছিলেন 'বিমান লুঠেরা'
প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ১৯৭৩ সালের ১০ জুন ঠিক সময়েই ভারত সীমান্তবর্তী নেপালের বিরাটনগর বিমানবন্দর থেকে কাঠমাণ্ডু পাড়ি দিল রয়াল নেপাল এয়ারলাইনসের ছোট্ট প্লেন। যাত্রী সবমিলে উনিশ জন। সকাল সাড়ে আটটা বাজে। টেক-অফের কিছু পরেই দুই নিরীহ যাত্রী আচমকা পিস্তল, গ্রেনেড বের করে লাফ দিয়ে পাইলট কেবিনের সামনে চলে এসেই হুঁশিয়ারি দিলেন-সবাই চুপ করে বসুন। এই বিমান এখন কাঠমাণ্ডু যাবে না। ঝামেলা পাকালে বিমান ধংস করা হবে।
পরিষ্কার নেপালি ভাষায় জানানো হলো বিমানটি হাইজ্যাক করা হয়েছে। পিস্তল দেখিয়ে পাইলটকে হুকুম দেওয়া হয় বিমানটি নামাতে হবে। কোথায় নামবে বিমান? এক অপহরণকারী ম্যাপ খুলে দেখিয়ে দিল সেই জায়গা। অনেক নিচে ঘাসজমির মাঝে একফালি সরু সমতল এলাকা দেখতে পেলেন বিমান চালক। ঘাড়ের কাছে পিস্তলের ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের স্রোত নামছিল। কোনওরকমে সেই ঘাস জমির উপরে বিমান নামাতে পারেন পাইলট।
এতক্ষণ পর্যন্ত যে বিমান অপহরণের কথা বললাম, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথে নেপালের মারাত্মক রাজনৈতিক ইতিহাস। নেপাল এখন গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। দশকের পর দশক ধরে নেপাল রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র, গণতান্ত্রিক দুই উপায়ে সংঘর্ষ চলেছিল। রাজতন্ত্র কোথাও চিরস্থায়ী হয়নি। নেপালেও হয়নি। রাজা বনাম প্রজার লড়াইয়ের চালিকাশক্তি হিসেবে মূখ্য ভূমিকা নিয়েছে নেপালি কংগ্রেস, নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি ও পরবর্তীতে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ নেওয়া নেপালি মাওবাদীরা। এই চতুর্মুখী সংঘর্ষের বহু রোমহর্ষক ঘটনার কেন্দ্র হিমালয় কন্যা নেপাল।
গণতন্ত্র রক্ষায় বিমান অপহরণ, এই শিরোপা পেয়েছে সেদিনের রোমহর্ষক ঘটনাটি। অপহরণকারীদের নির্দেশে রয়াল নেপাল এয়ারলাইনসের বিমানটি গোঁ গোঁ করে অবতরণ করল সেই ঘাসজমিতে। এই জায়গাটার নাম ফরবেসগঞ্জ। বিহারের একটি মাঝারি জনপদ। তৎকালীন পূর্ণিয়া জেলার ফরবেসগঞ্জ এখন উত্তর বিহারের আরারিয়া জেলার অন্তর্গত।
বিমানে থাকা যাত্রীরা ভয়ে কাঁপছিলেন।অপহরণকারীরা নেপালি ভাষায় বলে কারোর ক্ষতি হবে না। রাজার বিরুদ্ধে গণতন্ত্র রক্ষার সংঘর্ষ চালাতে এই গেরিলা হামলা হয়েছে। বিমানে ছিল নেপাল রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের তিরিশ লক্ষ টাকা। সবই ভারতীয় নোট। বিদ্রোহ পরিচালনা করতে ওই টাকা দরকার। অপহরণকারীরা সেই টাকা লুঠ করল। ভারতের মাটিতেই ঘটে গেল প্রতিবেশি দেশের রাজনৈতিক ঘনঘটার একটি রোমহর্ষক পর্ব।
বিহারের ফরবেসগঞ্জের সেই ঘাসে ঢাকা মাঠের পাশে জঙ্গল। সেখানে তিনটি জিপ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন নেপালি কংগ্রেসের নেতা গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, সুশীল কৈরালা আর তাঁদের ভারতীয় বন্ধুরা। কৈরালারা মোস্ট ওয়ান্টেড। বিমান সেখানে নামতেই লুঠ করা টাকার ট্রাঙ্ক জিপে তুলে নিয়ে গোপন আস্তানায় চলে যান সবাই। এরপর বিমানটি ফের কাঠমাণ্ডুর দিকে উড়ে যায়।
সে এক হই হই কান্ড। কাঠমাণ্ডু বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে খবর পৌঁছতেই শোরগোল পড়ে গেল। নেপালের তরফে ভারতের উপর প্রবল কূটনৈতিক চাপ দেওয়া শুরু হয়। ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে এই বিমান অপহরণ ও টাকা লুঠের কারণ। আরও জানা গিয়েছে, অপহরণে জড়িত নেপালি কংগ্রেস। দলটি সরাসরি নেপালের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক উপায়ে সংঘর্ষ চালাচ্ছে। তারা কী করে গেরিলা হামলা চালাতে পারে? এটাই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠে আসছিল।
রয়াল নেপাল এয়ারলাইনসের বিমান অপহরণে নেপালি কংগ্রেসের জড়িয়ে যাওয়া, আবার ভারতের মাটিতে জোর করে বিমান অবতরণ করানো, টাকা লুঠ সবমিলে সে এক ভজকট পরিস্থিতি। বিব্রত হয় ভারত সরকার ও ক্ষমতাসীন দল জাতীয় কংগ্রেস। বিহারের রাজনৈতিক অন্দরমহলেও উদ্বেগ ছড়াল। কারণ, কংগ্রেস এই রাজ্যে তখন ক্ষমতায়। কে না জানে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও নেপালি কংগ্রেসের কংগ্রেসে 'মধুর' সম্পর্কের কথা।
প্রাথমিকভাবে জানা যায় নেপালের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের জন্য বরাদ্দ টাকা বিহারের আরারিয়া থেকে সড়ক পথে নেপালের বিরাটনগরে পাঠানো হয়েছিল দুই দেশের তত্বাবধানে। সেই টাকা কাঠমাণ্ডু আর গেল না। বিমান অপহরণ ষড়যন্ত্রের পর্দা যত উঠছিল ততই বিব্রত হচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
এদিকে অপহরণকারীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে। বেশকয়েকদিন পর খবর এলো তারা দার্জিলিংয়ে লুকিয়ে। কখনো জানা গেল তাদের বারাণসীতে দেখা যাচ্ছে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছিল। ততদিনে একেবারে জলের মতো পরিষ্কার সব। বিমানটির অপহরণকারীরা সবাই নেপালি কংগ্রেসের নেতা। দলটির দুই শীর্ষ নেতা গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, সুশীল কৈরালা সহ কয়েকজন এই ষড়যন্ত্রে জড়িত। কংগ্রেসের তরফে গোপনে কৈরালাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। ইন্দিরা গান্ধীর বিব্রতকর অবস্থা বোঝানো হলো। অবশেষে তারা গ্রেফতারিতে সম্মত হলেন। তবে লুঠ করা টাকার হদিস মেলেনি।
১৯৭৩ সালে এই বিমান অপহরণের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছিল ভারত ও নেপালে। একদিকে ভারতের শাসক কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ দানা বাধছিল। আর নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বে সে দেশে রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন জমাট হচ্ছিল। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করল ভারত সরকার। এর বিরোধিতায় আন্দোলনে দেশ তোলপাড় হয়ে যায়। জরুরি অবস্থা জারির ধাক্কায় ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা সরকারের পতন হলো। ক্ষমতায় এলো জনতা সরকার। এর পর মুক্তি মেলে রয়াল নেপাল বিমান অপহরণকারীদের। দেশে ফিরে তীব্র রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়েন নেপালি কংগ্রেস নেতারা।
নেপালে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। দশকের পর দশক ধরে সেই আন্দোলন চলে। কাঠমাণ্ডুর নারায়ণহিতি প্রাসাদের চারপাশে নেপালি জনবিক্ষোভ আছড়ে পড়তে থাকে। নেপালি কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির পাশাপাশি পাহাড়ি অঞ্চলে রাজার সেনার সঙ্গে রক্তাক্ত সংঘর্ষে নামে নেপালি মাওবাদীরা। রাজার আসন টলমল করছিল। নরম মনোভাব দেখিয়ে নেপাল রাজপরিবার গণতন্ত্রীকামী দলগুলির সঙ্গে আলোচনায় বসে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত হয় নেপালের কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি। তবে তখনও রাজার হাতেই সর্বচ্চো ক্ষমতা ছিল।
এই পর্বে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর মুখ বদল নজির তৈরি করেছে দুনিয়ায়। একেকজন একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। নব্বই দশক থেকে বারবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে নজির গড়েছেন গিরিজা প্রসাদ কৈরালা। পরে তাঁর ভাইপো সুশীল কৈরালা হন প্রধানমন্ত্রী। তাঁরা এমন দুই প্রধানমন্ত্রী যাঁদের রাজনৈতিক দর্শন গান্ধীবাদ। তারাই আবার গেরিলা রীতিতে গণতন্ত্র রক্ষায় বিমান অপহরণ করেছিলেন। এমন আগ্রাসী গান্ধীবাদী নেতা বিরল। দু'জনেই বিমান অপহরণ করে টাকা লুঠ স্বীকার করেছেন।
২০০৮ সালে নেপালের রাজতন্ত্র পুরোপুরি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আত্মপ্রকাশ করে রাজার ক্ষমতাহীন নেপাল। সুশীল কৈরালার আড়ম্বরহীন অতি সরল জীবন তাঁকে কিংবদন্তি নেতা হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করেছে।
নেপাল তথা উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই দুই কংগ্রেস নেতা গিরিজা কৈরালা ও সুশীল কৈরালা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। সফল হয়েছেন। বিহারের এই ঘটনা তাঁদের সংগ্রামী জীবনের সফল অধ্যায়ের একটি রোমহর্ষক পর্ব।
সৌজন্যে:
Documentary on Nepal plane hijacking screened :
- The Kathmandu Post.
- The skyjack that shook Panchayat.