একটানা ৫০০ রাত হাউজফুল ছিল রামকৃষ্ণর জীবন অবলম্বনে তৈরি এই নাটক

বাংলার পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের স্বর্ণযুগ তখন ফুরিয়েছে। '৪৩ এর মন্বন্তরের পর গণনাট্য সঙ্ঘের মধ্যে দিয়ে উঠে আসছে থিয়েটারের নতুন ভাষা। এমতাবস্থায় পেশাদারি রঙ্গমঞ্চগুলো একরকম ধুঁকতে ধুঁকতেই চলছে। দিনের পর দিন সেখানে একই নাটক অভিনীত হয়। অভিনয় বিশেষ জমে না, দর্শকাসনও পূর্ণ হয় না। এমন সময় ১৯৪৮ সাল নাগাদ তারকনাথ মুখোপাধ্যায় নামে এক ভদ্রলোক ভাবলেন, এভাবে চলতে পারে না, কিছু একটা করা দরকার। ভাবতে ভাবতে একটা উপায়ও বের করলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে একটা নাটক লিখলে কেমন হয়? বাংলা থিয়েটারের একজন এতবড় 'গার্জেন সেইন্ট', নটী বিনোদিনীর মাথায় হাত রেখে যিনি বলেছিলেন, 'তোর চৈতন্য হোক', তাঁকে নিয়ে নাটক না লেখাই তো বরং আশ্চর্যের। সেই মতো তিনি একটা প্ল্যান ছকে নিলেন। নাটকের মূল কাহিনিখানা গিয়ে শোনালেন 'কালিকা থিয়েটারে'র স্বত্বাধিকারী রাম চৌধুরীকে। নাটক হবে শ্রীরামকৃষ্ণ এবং রাণী রাসমণির গল্প নিয়ে, নাম হবে 'শ্রীরামকৃষ্ণ'। রামবাবু তো এক কথায় রাজি। ব্যাপারখানা বেশ নতুনরকম। গল্প একবার লেগে গেলে সুদিন আবার ফিরে আসবে। 

নাটক যখন রচনা হচ্ছে তখন রামবাবু সময় পেলেই তার পাণ্ডুলিপি নিয়ে চলে যেতেন বেলুড় মঠ। সেখানকার সন্ন্যাসীরাও সে নাটকের গল্প শুনে বেজায় খুশি, রাম চৌধুরীকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করতেন তাঁরা। অবশেষে সরস্বতী পুজোর দিন শ্রী রামকৃষ্ণর বিগ্রহ কে অর্চনা করার পর ঠিক হল নাটক অভিনয়ের দিন ক্ষণ। কিন্তু এবার সেই বেলুড় মঠ থেকেই আপত্তি এল। সন্ন্যাসীদের বক্তব্য, রামকৃষ্ণ, রাসমণি, নরেন্দ্রনাথ, এনারা হলেন মহাপ্রাণ। তাঁদের ভূমিকায় সাধারণ নট নটিরা অভিনয় করবেন, এ মেনে নেওয়া যায় না। ভক্তরা গন্ডগোল করতে পারেন। তখন সামাল দেবেন কে? রামবাবুও দমে যাওয়ার লোক নন। মনে মনে তিনি ভাবলেন, 'দেখব কেমন নাটক আটকাও।' 

তখন পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্রদপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন কিরণশঙ্কর রায়। একদল লোক তাঁর কাছে গিয়ে রাম চৌধুরীর নামে নালিশ ঠুকে এলেন। তার ভিত্তিতে তাঁর থিয়েটারের দরজায় পুলিশ পোস্টিং হল। রামবাবু শুধুই মুচকি হাসলেন। থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী হওয়ার পাশাপাশি তিনি নিজেও ছিলেন পুলিশের দারোগা। তাঁকে পুলিশের ভয় দেখানো? স্বয়ং ভবতারিণীর আদেশ পেয়েছেন তিনি। যতদিন বেঁচে আছেন, নাটক মঞ্চস্থ হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে গিয়ে তিনি তাঁর যুক্তি দিলেন, 'সেন্সর বোর্ড যখন নাটকটা পাশ করে দিয়েছে তখন কোন এখতিয়ারে সেটা আটকানো হচ্ছে?' তিনি এও জানালেন, এ নিয়ে অতিরিক্ত জলঘোলা হলে তিনিও পাল্টা মামলা করতে বাধ্য হবেন। পুলিশ কমিশনার রামবাবুকে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে তিনি সাবধান করে বললেন, 'জানেন আপনি যা আরম্ভ করেছেন তাতে করে আপনার চাকরি যেতে পারে?'  রামবাবু বললেন, 'আরে মশাই আপনি আবার আমার চাকরি কী খাবেন। আমি নিজেই ইস্তফা দিয়ে দিচ্ছি।' বেলুড়ের সন্ন্যাসীদেরও তিনি শাসিয়ে এলেন, 'আপনারা প্রার্থনা করুন যাতে কোনও দুর্ঘটনায় আমার মৃত্যু হয়। যতদিন আমি বেঁচে আছি ততদিন কিন্তু নাটক কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।' 

সন্ন্যাসীরাও পড়লেন দুশ্চিন্তায়। কী উপায় করা যায় এর? শেষ পর্যন্ত সমাধান একটা বেরোল। রামবাবুকে জানানো হল নাটকের নাম পাল্টে অন্যকিছু রাখতে হবে, এবং চরিত্রদের মূল নামও বদলাতে হবে।  অর্থাৎ নাটককে হতে হবে রূপক। রামবাবুর তাতে কোনও আপত্তি নেই। 'শ্রী রামকৃষ্ণ' নাম পাল্টে নাটকের নাম তিনি রাখলেন 'যুগাবতার'। রামকৃষ্ণ চরিত্রের নাম হল সচ্চিদানন্দ, রাসমণির নাম নারায়ণী। কোনো চরিত্রই বাদ গেলেন না, কিন্তু তাঁরা থাকলেন কেবল আসলের রূপক হয়ে। শুরু হল পরিকল্পনা। সচ্চিদানন্দর পার্টটা কাকে দিয়ে করানো যায়? প্রথমে ঠিক হল বাণীবিনোদ নির্মলেন্দু। নাটক রচনার শুরুর দিন থেকে তিনি উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। কিন্তু তিনি মাথা নত করে জানালেন, 'না মশাই, রামকৃষ্ণর ভূমিকায় পার্ট করতে পারব না।' এবার প্রস্তাবিত হল গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। মজার ব্যাপার হল এই নাটক থেকেই রামকৃষ্ণের চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে যখন তাঁকে নিয়ে সিনেমা হয়, তখনও সে চরিত্রে তিনিই অভিনয় করেন। নারায়ণীর পার্টের জন্য ভাবা হল মলিনাদেবীকে। গোড়ায় খানিকটা দ্বিধায় থাকলেও অভিনয় তিনি করেছিলেন। 

শুরু হল নাটক। কিন্তু অল্প কিছুদিন তা চলার পরেই ফের বিপত্তি। রাণী রাসমণির পরিবার থেকে এলো injunction-এর চিঠি। নাটকের মধ্যে দিয়ে নাকি তাঁকে অপমান করা হচ্ছে। রামবাবু তাঁদের জানালেন, 'আপনারা এসে নাটকটা দেখে যান। তাঁকে বিন্দুমাত্র অপমান করা হচ্ছে কিনা দেখুন।' রাসমণির পরিবারের লোকজন সেদিন নাটক দেখে জয়জয়কার করতে করতে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়েছিলেন। 

নাটক চলছে পুরোদমে। কোনো অভিনয়ে দর্শকাসন ফাঁকা যায় না। এমনই একদিন আনন্দময়ী মা এলেন নাটক দেখতে। অথচ প্রধান অভিনেতা গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন কোনো কারণে অভিনয় করতে পারবেন না। রামবাবুর তো মাথায় হাত। এবার কী হবে? এমন সময় তাঁর চোখ গেল নীতীশ মুখোপাধ্যায়ের দিকে। সদ্য পিতৃহারা নীতীশ এসেছেন একমাথা রুক্ষ চুল আর অবিন্যস্ত দাড়ি নিয়ে। রামবাবু ভাবলেন, 'এই তো সচ্চিদানন্দ।' রামকৃষ্ণ ওরফে সচ্চিদানন্দের ভূমিকায় অভিনয় করে সেদিন সকলের তারিফ কুড়িয়েছিলেন নীতীশ মুখোপাধ্যায়। 

বাঙালির ছিল এক কল্পতরু। তাঁকে অমন কাছ থেকে দেখার সুযোগ আর কেই বা ছাড়তে চান? হয়ত সেই কারণেই ৫০০ রাত হাউজফুল হয়েছিল 'যুগাবতার'। এমনই একদিনের ঘটনা। নাটক চলাকালীন রামবাবু কী একটা কাজে হলের বাইরে বেরিয়েছেন, হঠাৎ তাঁর চোখ গেল একটা বাচ্চা ছেলের দিকে। হলের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেটা কাঁদছে। রামবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কাঁদছ কেন?' ছেলেটা বলল, 'আমি পঁয়ত্রিশবার 'যুগাবতার' দেখেছি। আমার সব পয়সা শেষ হয়ে গেছে, আর দেখতে পারছি না।' রামবাবু তাঁকে বললেন, 'এসো আমার সঙ্গে।' তাঁর দৌলতে সেই ছেলে ছত্রিশতম বার সামনে থেকে দেখতে পেল নিজের প্রানের নায়ক শ্রীরামকৃষ্ণকে। 

তথ্যঋণ: রাজেশ্বরী রাসমণি: গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ
চিত্রঋণ: wikipedia

More Articles