হারিয়ে ফেলা প্রাণীদের খোঁজ! জানেন কী কী আছে এই 'ঠান্ডা' চিড়িয়াখানায়?
San Diego Frozen Zoo: ক্যালিফর্নিয়ার সান ডিয়েগোতে প্রায় ১৮০০ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে এই ফ্রজেন চিড়িয়াখানা। বিশ্বের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম হিমায়িত চিড়িয়াখানা নাকি এটাই।
চিড়িয়াখানা মানেই তো চেনা-অচেনা পশুপাখিদের ভিড়। যাদের সচরাচর রাস্তাঘাটে দেখা যায় না, তাদের জন্য এক নিরাপদ সংরক্ষিত জায়গা। যেখানে দর্শকেরা আসেন, নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সেইসব পশুপাখি-প্রাণীদের দেখতে পান। কিন্তু হিমায়িত চিড়িয়ানা! এমন চিড়িয়াখানার কথা কেউ কখনও শুনেছেন কি?
ক্যালিফর্নিয়ার সান ডিয়েগোতে প্রায় ১৮০০ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে এই ফ্রজেন জু বা চিড়িয়াখানা। বিশ্বের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম হিমায়িত চিড়িয়াখানা নাকি এটাই। দেখতে দেখতে প্রায় ৫০ বছর হয়ে গিয়েছে এই চিড়িয়াখানার। যেখানে রয়েছে ১১ হাজারেরও বেশি নমুনা। না, বরফের বসবাসকারী প্রাণী রয়েছে এখানে, এমনটা কিন্তু নয়। বরং এই চিড়িয়াখানায় রয়েছে এমন সব প্রাণী, কয়েক হাজার বছর আগে যারা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ হাজার প্রজাতির প্রতিনিধিত্বকারী প্রাণীর নমুনা রয়েছে এখানে। না, শুধুই যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীরা রয়েছে, তা-ই নয়। এই পৃথিবীতে অস্তিত্ব রয়েছে, এমন প্রাণীদের নমুনাও কিন্তু রয়েছে এই চিড়িয়াখানায়। জিরাফ থেকে গন্ডার, পিপিলিকিভূক থেকে শুরু করে বহু জানা-অজানা প্রাণীর নমুনা সংরক্ষিত রয়েছে এখানে।
আরও পড়ুন: জলেস্থলে অবাধ বিচরণ! দেখা মিলল পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম পাখির
আশ্চর্যের ব্যাপার এই চিড়িয়াখানার কিউরেটর মার্লিস হক নামে এক মহিলা বিজ্ঞানী। তিনি যে দলটিকে নেতৃত্ব দেন, তাঁরা সকলেই মহিলা। কিন্তু কী রাখা হয় এই হিমায়িত চিড়িয়াখানায়। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, তাঁরা মৃত প্রাণীদের শরীর থেকে কলাকোষগুলির নমুনা সংগ্রহ করেন। এবং সেগুলিকে হিমায়িত করে সঞ্চয় করেন। ভাবছেন নিশ্চয়ই, এ আবার কেমন চিড়িয়াখানা। মৃত জীবজন্তুদের কলাকোষ সংরক্ষণ করে হবেই বা কী?
তবে এই সংরক্ষণ কিন্তু আদপেই সহজ নয়। আসলে বিজ্ঞানীরা প্রাণীদেহ থেকে সংগৃহীত কলাকোষগুলিকে একপ্রকার চাষ করেনই বলা যায়। প্রথমে তাঁর কোষগুলিকে হিমায়িত করা হয়, এবং তার পর সেগুলিকে তরলিকৃত নাইট্রোজেনে সংরক্ষিত করা হয়। বিজ্ঞানীদের দাবি, ওই কলাকোষগুলি থেকে নতুন করে পুনর্জন্ম হতে পারে ওই সব প্রাণীদের।
সহজ নয় অবশ্য এই প্রক্রিয়া। কার্যত সময়ের উল্টোস্রোতে এ যেন এক লড়াই। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর ক্ষেত্রেই শেষ কথা বলে আসলে জিন। সে মানুষই হোক, বা জীবজন্তু-পশুপাখি। সান ফ্রান্সিসকোর এই হিমায়িত চিড়িয়াখানা আসলে সেই কাজটাই করছে। তারা সংগ্রহ করে রাখছে ভীষণ জরুরি সেই জেনেটিক উপাদানকেই।
পৃথিবীর জলবায়ু খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বাড়ছে উষ্ণায়ন। গলে যাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত হিমবাহ। যার ফলে জল বাড়ছে সমুদ্রের। বিপাকে পড়ছে সামুদ্রিক প্রাণীরা। প্রায় প্রতিদিনই এক পা এক পা করে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। সময় ও প্রকৃতির সঙ্গে যুঝে উঠতে না পেরে একদিন হারিয়ে গিয়েছিল ডায়নোসর। আরও বহু প্রাণী ইতিমধ্যেই হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী থেকে। বিলুপ্তির পথে বহু প্রাণীই। পৃথিবীর পরিবেশ যেভাবে দ্রুত গতিতে পাল্টে যাচ্ছে, তাতে সেই আশঙ্কা বাড়ছে বই কমছে না। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সান ফ্রান্সিসকোর এই হিমায়িত চিড়িয়াখানা কিন্তু সভ্যতার আস্ত একটি বৈজ্ঞানিক দলিল।
আরও পড়ুন:রাত ৯ টায় রহস্যময় গর্জন! হাজারে হাজারে মানুষ পশুকে খুন করেছিল বিশ্বের বীভৎসতম এই হ্রদ
১৯৭২ সালে কার্ট বেনিরস্ক নামে এক মার্কিন-জার্মান প্যাথোলজিস্ট এই চিড়িয়াখানার শুরু করেন। সেটি ছিল সান দিয়েগো ইউনিভার্সিটির ল্যাবরটরি। প্রাথমিক ভাবে সেখানে তিনি বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা শুরু করেন। পরে নমুনা বাড়তে থাকায় সেটিকে অন্যোত্র স্থানান্তরিত করা হয়। সে সময় সাধারণ ক্রোমোজোম নিয়ে গবেষণা ছাড়া আর কোনও প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি এ সংক্রান্ত। কিন্তু বেনরস্ক সবসময় মার্কিন ইতিহাসবিদ ড্যানিয়েল বুর্স্টিনের একটা উক্তি মেনে চলেছেন জীবনে। ড্যানিয়েল বলতেন,"You must collect things for reasons you don't yet understand." অর্থাৎ, মানুষের এমন নমুনা সংগ্রহ করা যাওয়া উচিত, যা কেন করছে সে জানে না। । আর সেই কাজটাই এক মনে করে গিয়েছিলেন বেনিরস্করা। যে ব্যাটন আজ হাতে তুলে নিয়েছে মার্লিস ও তাঁর দলবল। কে বলতে পারে, সান দিয়োগের এই চিড়িয়াখানার দৌলতেই ফের পৃথিবীতে ফিরে আসবে হারিয়ে যাওয়া কোনও পাখি। যার গল্প আমরা কেবল বইয়ে পড়েছি বা সিনেমায় দেখেছি গ্রাফিক্সের কারসাজিতে।