তৃণমূলের বিরুদ্ধে এত দুর্নীতির অভিযোগ, তাও ইডি-সিবিআই তদন্ত শেষ করে না কেন?

TMC and ED-CBI Tussle : যাঁরা প্রকৃতই ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করে টাকা পেল না এবং তৃণমূলের ধরনায় যোগ দিল না, তাঁরা ব্রাত্যই থেকে যাবেন! তাঁদের টাকা কে দেবে?

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কালো মেঘের ঘনঘটা অনেক দিন ধরেই চলছে। পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি। জেলের মধ্যে বিধায়কদের জন্য আলাদা ব্লক তৈরি করে ফেলা, কর্মসংস্থানের অভাব, অস্বচ্ছ শিল্পনীতি, অনুদান-নির্ভর ভোট, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কেন্দ্রীয় বঞ্চনা — যেটির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্ক প্রায় চার দশক হতে চলল।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সেই রাজনীতিরই প্রদর্শন হয়ে গেল। একদিকে বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এসে ভাষণবাজি করে গেলেন ধর্মতলায়। অন্য দিকে বিধানসভায় ধরনা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর বিধায়কেরা। অদূরেই তাঁদের সঙ্গে থালা-বাসন বাজিয়ে পাল্লা দিলেন শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে বিজেপির পরিষদীয় দল। মূল ইস্যু ছেড়ে জাতীয় সংগীতের অবমাননার দায়ে বিজেপি বিধায়কদের বিরুদ্ধে এফআইআর নিয়ে চলছে চর্চা। বিজেপি যখন 'চুরি'কে ইস্যু করছে। তখন তৃণমূলের ইস্যু 'কেন্দ্রীয় বঞ্চনা'।

এই তু তু-ম্যায় ম্যায় খেলাতে মজা রয়েছে বিস্তর। কেউ কাউকে ছুঁতে চাইছে না। ওই পাড়ার মোড়ে বা রাস্তাঘাটে বচসা হলে যেমন হয় — এক দল বা ব্যক্তি আরেক দল বা ব্যক্তিকে বলে যদি ওমুকটা না হতো না, তাহলে দেখিয়ে দিতাম তোর অবস্থা কী করতে পারতাম। মারপিট করার ভাব দেখাবে। কিন্তু কেউ কারও গায়ে হাত লাগাবে না।

আরও পড়ুন- ২০২৪ এর আগেই কেন ‘ফেল’ কংগ্রেস : সুমন চট্টোপাধ্যায়

বিজেপি ও তৃণমূলের রাজনীতিও সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে। দু' দুটো বড় বড় কেন্দ্রীয় সংস্থা — সিবিআই ও ইডি — দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করছে তৃণমূল নেতা ও সরকারের বিরুদ্ধে। কয়লা থেকে গরু পাচার থেকে শিক্ষা থেকে পুরসভায় নিয়োগ থেকে রেশন — দুর্নীতির অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু আদালতের তাড়া না খেলে সংস্থাগুলি তদন্ত শেষ করে দোষীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে না। তা সে বিচারপতি অমৃতা সিনহার বেঞ্চ হোক বা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ- মামলাগুলির শুনানির দিকে তাকালেই এই অভিযোগ স্পষ্ট হয়। যাঁরা জেলে গেছেন তাঁরা হয় আদালতের নির্দেশে বা রাজনৈতিক 'সদিচ্ছায়'।

তার মূল কারণ সংস্থাগুলি যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের আওতায় আসে সেই মন্ত্রীরাই তদন্তকারীদের হাত খুলে তদন্ত করার 'ছাড়পত্র' দিচ্ছেন না। এমন মনে করার কোনও কারণ নেই যে তদন্তকারী অফিসারেরা অকর্মণ্য। তাঁদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে তাঁদের রাজনৈতিক কর্তাদের ইচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন বারবার উঠছে। হাত খুলে রাজনৈতিক রং না দেখে তদন্ত করার নির্দেশ পেলে এই তদন্তকারীরাই অসাধ্য সাধন করতে পারেন। তার বদলে ধর্মতলায় ভাষণবাজি চলছে। চলবে। তার বদলে বিধানসভার গাড়ি বারান্দায় থালা বাজানো চলবে।

অন্যদিকে দুর্নীতির ইস্যু থেকে মুখ ঘোরাতে মোক্ষম ইস্যু বের করেছে তৃণমূল কংগ্রেস — কেন্দ্রীয় বঞ্চনা। সেই বাম আমল থেকে রাজ্য ও কেন্দ্রে কখনই এক রাজনৈতিক দলের সরকার না থাকাতে (মাঝের এক দুই বছর ইউপিএ সরকারে তৃণমূলের উপস্থিতি বাদ দিলে), এই ইস্যু খুবই উপাদেয়। সব দোষ কেন্দ্রের ঘাড়ে ঠেলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায়। ১০০ দিনের কাজ হোক বা আবাস যোজনার টাকা নিয়ে দুর্নীতি — যে রাজ্য সরকারের ঘাড়ে অভিযোগ সেই রাজ্য সরকারই এখন বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রের দিকে।

যদি সত্যিই কোনও ভুয়ো জব কার্ড হোল্ডার ১০০ দিনের কাজের টাকা পাননি, যদি সত্যিই যাঁদের প্রয়োজন তাঁদের কাছেই আবাস যোজনার টাকা গেছে, তাহলে এতদিনে রাজ্য সরকার তদন্ত করে কেন্দ্রকে ঠিকমতো রিপোর্ট পাঠাল না কেন?

এর যথাযথ তদন্ত না হলে কেন্দ্র এই প্রকল্পগুলির বকেয়া টাকা পশ্চিমবঙ্গকে যদি দেবে না বলে ঠিক করে বা যাঁরা সত্যিই ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করেও টাকা পাননি, তার দায় রাজ্যের শাসক দল এড়িয়ে যেতে পারে কি? প্রকৃত তদন্ত না করে, দিল্লি গিয়ে ধরনা দিয়ে, কলকাতায় এসে ধরনায় বসে তামাশা অনেক হয়েছে।

আরও পড়ুন- মানুষের সমর্থন ছাড়া দুর্নীতি হয় না, রাজ্যকে ভাগাড় করেছে জনতাই?

এখন নতুন তামাশা শুরু হয়েছে। যাঁরা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে দিল্লিতে ধরনায় যোগ দিয়েছিলেন, সেই সব ১০০ দিনের প্রকল্পের কর্মীদের আর্থিক সাহায্য করা শুরু হয়েছে রাজ্যের শাসক দলের পক্ষ থেকে। সেই টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, দলের তরফে কেউ কেউ টাকা দিয়েছে বলা হলেও, এই টাকার স্বচ্ছ হিসেব নিকেশ কোনও দিন জনসমক্ষে প্রকাশ পাবে বলে মনে হয় না।

মূল উদ্দেশ্য এটা প্রমাণ করা যে, কেন্দ্র তোমাদের টাকা দেয়নি। আমরা তোমাদের টাকার ব্যবস্থা করছি। মাঝের অংশটি — দুর্নীতি হয়েছে না হয়নি তা নিয়ে তদন্ত — উহ্যই থেকে যাবে।

আর যাঁরা প্রকৃতই ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করে টাকা পেল না এবং তৃণমূলের ধরনায় যোগ দিল না, তাঁরা ব্রাত্যই থেকে যাবেন! তাঁদের টাকা কে দেবে? তৃণমূলের প্রতি আনুগত্য না দেখালে তাঁরা বকেয়া টাকা বা দলের অনুদান পাবেন না!

রবিবার চার রাজ্যের ভোটের ফল বের হয়ে গিয়েছে। সোমবার থেকে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু। সেখানে টাকা নিয়ে প্রশ্ন করার অভিযোগে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কারের সম্ভবনা প্রবল। রাজ্যে তৃণমূলের অন্দরে 'পিসি-ভাইপোর' মন কষাকষি। এই সব নিয়ে আলোচনাতেই ব্যস্ত হবেন সবাই। জানুয়ারি আসতেই অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন করে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের দামামা বাজাবেন নরেন্দ্র মোদি।

আর পশ্চিমবঙ্গে কুৎসিত রাজনৈতিক খেলা চলতে থাকবেই। জনগণ যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থাকবে।

More Articles