ট্যুইটারের নতুন নীতিতে মুখ থুবড়ে পড়বে বিজেপি-র রণকৌশল?
বেগ দেওয়া না সমঝোতা, বিজেপির ক্ষেত্রে ট্যুইটারে কোন পথ বেছে নেবেন এলন মাস্ক?
খবর সত্য হোক বা ভুয়া, তাঁদের হাত দিয়ে বেরনো মানেই ভাইরাল হওয়া অনিবার্য। সোশ্যাল মিডিয়ার (Social Media) আন্তর্জালে ভুয়া খবরের রমরমা নিয়ে যখন উদ্বেগে বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনেতা, সেই সময় প্রকাশ্যে ভুয়া খবর ছড়ানোয় নিজেদের পারদর্শিতা নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই আস্ফালন করতে দেখা গিয়েছিল দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে (Amit Shah)। কিন্তু সাড়ে তিন বছরের একটু বেশি আগে শাহ-র সেই প্রত্যয়ী ভাব আগামী দিনে বজায় থাকবে কি না, তা নিয়ে এখন সন্দিহান কেউ কেউ, যার নেপথ্যে রয়েছে মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটারের হাতবদল।
টেসলা কর্তা, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এলন মাস্কের (Elon Musk) হাতে ট্যুইটারের মালিকানা উঠছে। সইসাবুদ-সহ চূড়ান্ত সিলমোহর পড়তে এখনও কিছু দিন রয়েছে। তবে মাস্ক ইতিমধ্যেই টুইটারের নয়া রূপরেখা ছকে ফেলেছেন, যার আওতায় প্রথমেই ভেকধারী, স্বয়ংক্রিয় টুইটার হ্যান্ডলগুলিকে (বটস) ছেঁটে ফেলা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি (Twitter Bots)। তাতেই আগামী দিনে টুইটারে বিজেপি-র সৈন্য-সামন্তদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বাণিজ্যিক ট্যুইটারের সাবেক মালিকদেরও আগে এমন পণ করতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু সেই অর্থে কিছু করে উঠতে পারেননি তাঁরা। তবে তাঁরা ছিলেন অনেক মাথা, এখন মাস্কই শেষ কথা।তাতেই আগামী দিনে ট্যুইটারে বিজেপি-র (BJP) সৈন্য-সামন্তদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি-র সর্বব্যাপী উপস্থিতি কারও অজানা নয়। যাবতীয় কাজকর্ম ফেলে বিজেপি-র নেতা, মন্ত্রীরা সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় বসে থাকেন, একথা গলাধঃকরণযোগ্য নয়। শাসক দলের কেউ কস্মিনকালে তেমনি দাবিও করেননি। বরং গোটা কাজটাই হয় মাইনে করা লোক দিয়ে।
মাস্ক জমানায় ট্যুইটারে বিজেপি-র ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আগে 'বটস' কী, সেই সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়ার নগদীকরণ, অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে অর্থলাভ বা স্বার্থসিদ্ধি বিষয়টি যবে থেকে বৈধতা পেয়েছে, তখন থেকেই ইন্টারনেট দুনিয়ায় বটসের রমরমা। মোদ্দাকথা হল, যে ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়াকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতে চান, পয়সা খরচ করে ডিজিটাল প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন কিছু লোক বা কোনও একটি সংস্থাকে বরাত দেন তিনি। ওই সমস্ত লোকজন নির্দিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে নিয়োগকর্তার জন্য ডিজিটাল জনভিত্তি তৈরি করেন।
আরও পড়ুন: কার কত টাকা খসবে ট্যুইটার চালাতে? খরচ তুলতে শুরুতেই যে পরিকল্পনা করছেন এলন মাস্ক
এই কাজে প্রথমেই হাজার হাজার ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়। সন্দেহ এড়াতে নাম, ধাম, ছবি দিয়ে পুরোদস্তুর সাজানো হয় প্রোফাইলগুলিকে, তার জন্য বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্যের পরিচয়ও চুরি করা হয়। তারপর ওই সমস্ত ভেকধারী অ্যাকাউন্টকে একটি সফটওয়্যারের সঙ্গে সংযুক্ত করে শুরু হয় আসল কাজ। নিয়োগকর্তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলে, তাঁর বার্তা সকলের মনকে নাড়া দেয়, এমন মেসেজ তৈরি করা হয়। তার পর সফটওয়্যারে ফেলে শুরু হয় বৃহত্তর ক্ষেত্রে চালানের কাজ।
এই সমস্ত মেসেজে বিশেষ ধরনের হ্যাশট্যাগ বা সাংকেতিক চিহ্ন থাকে, যেগুলি কোডওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে নির্দিষ্ট সফটওয়্যারের নিয়ন্ত্রণে থাকা সব অ্যাকাউন্ট এবং হ্যান্ডল চিহ্নিত করতে পারেন কর্তৃপক্ষ। সেই মতো রেকর্ড ধরে ধরে হিসেব কষা যায় সহজেই। ট্যুইটারে মাঝেমধ্যে আলটপকা যে-সমস্ত হ্যাশট্যাগকে ট্রেন্ড করতে দেখি আমরা, অর্থাৎ আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে শীর্ষে থাকে, তার অধিকাংশই বটসের কারসাজি। উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরা যায়, #justiceforsushantsinghrajput, #hindusmustunite-কে। ট্যুইটারে কোন বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হচ্ছে, সেগুলোই ট্রেন্ড-এ জায়গা পায়। হ্যাশট্যাগ ধরে ধরে সেগুলো টেনে নেয় ট্যুইটারের অ্যালগরিদম। কিন্তু বটসের কারসাজিতে অনেক সময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি হ্যাশট্যাগও জনপ্রিয়তার শীর্ষে জায়গা করে নেয়। সুইৎজারল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, ১ লক্ষ ৮০ হাজার হ্যান্ডল থেকে ১৯ হাজারের বেশি ভুয়া ট্রেন্ড তৈরি করা হয়। ওই সব অ্যাকাউন্টই অন্যের পরিচয় চুরি করে বানানো হয়েছিল। ২০১৬-য় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে যে রাজনৈতিক বিষয়বস্তু আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে, তার ২০ শতাংশই ছিল ৪ লক্ষ স্বয়ংক্রিয় অ্যাকাউন্ট থেকে তৈরি করা ভুয়া ট্রেন্ড। ভোট দিতে যাওযার আগে আমজনতার মগজধোলাই করতেই সেগুলি বানানো হয়েছিল বলে অভিযোগ।
আমেরিকার দ্বিদলীয় রাজনীতিতে এই ধরনের প্রচারে মোটামুটি ভারসাম্য থাকলেও, ভারতে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। ভারতীয় রাজনীতিতে সোশ্যাল মিডিয়ার বৈধতা প্রাপ্তি বিজেপি-র হাত ধরেই। বিগত আট বছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় কার্যত একচ্ছত্র আধিপত্য তাদের। ২০২০-র জানুয়ারি মাসে রেডিট-এর একটি সমীক্ষার রিপোর্টে দেখা যায়, ট্যুইটারে বিজেপি-র সমর্থক ২ লক্ষ ৭০ হাজার অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার মধ্যে ১৮ হাজার অ্যাকাউন্ট শুধু ভুয়া খবর এবং হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রচারেই পুরোপুরি নিযুক্ত। সেই তুলনায় কংগ্রেসের হয়ে প্রচার করে মাত্র ১৪৭টি অ্যাকাউন্ট।
শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে বর্তমানে সর্বাধিক ট্যুইটার অনুগামী যাঁর, তাঁর ৬০ শতাংশ অনুগামীই ভুয়া অ্যাকাউন্টের মালিক বলে জানায় টুইপ্লোমেসি সংস্থার একটি রিপোর্ট। বর্তমানে ট্যুইটারে মোদির অনুগামীর সংখ্যা ৭ কোটি ৮৬ লক্ষ। মাস্ক বটস ধরতে শুরু করলে বিজেপি-র আইটি সেলের পাশাপাশি মোদির অনুগামী সংখ্যাতেও কোপ পড়বে বলে মনে করছেন অনেকে। কিন্তু তাতে বিজেপি-র আদৌ ক্ষতি হবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দের রয়েছে। কারণ ভারতে রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে সচেতন মানুষ, নেতা-মন্ত্রী, তারকাদের মধ্যেই ট্যুইটার জনপ্রিয়। এদেশে টুইটারের গ্রাহকসংখ্যা মোটে ১ কোটি ৫০ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ মাত্র। সেই তুলনায় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৩ কোটি ৯০ লক্ষ, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৮ কোটি ৭০ লক্ষ। ইনস্টাগ্রামেও ১৪ কোটি ভারতীয়র অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এই হিসেব বিজেপি-রও জানা।
তাই ট্যুইটারের তুলনায় ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডের ওপর গোড়া থেকেই জোর দিয়ে এসেছে তারা। ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে একটি অনুষ্ঠানে শাহ জানান, এক বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথকে বিজয়ী করতে ৩২ লক্ষ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছিলেন তাঁরা। প্রতিদিন সকাল ৮টায় ফরওয়ার্ড চালাচালি করেই তাঁদের দিন শুরু হয় বলে জানান। তাই শাহকে বলতে শোনা যায়, “সত্য হোক বা মিথ্যা, নিজেদের ইচ্ছেমতো খবর আমরা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে পৌঁছে দিতে পারি।”
তাই মাস্ক ছাঁকনিতে ছেঁকে তাদের যাবতীয় বটস টুইটার থেকে বিতাড়িত করলেও, তেমন কিছু এসে যাবে না বিজেপি-র। বরং একপ্রকার হাঁফ ছেড়েই বাঁচবে তারা। কারণ মাস্ক জানিয়েছেন, সাধারণ মানুষ ছাড়া, বাণিজ্যিক স্বার্থবিজড়িত সমস্ত সংস্থা, দল, সংগঠনের কাছ থেকে ট্যুইট প্রতি টাকা আদায় করবেন তিনি। দেশের ১ শতাংশ জনগণ, যার একটি বড় অংশ আবার বোদ্ধাদের দলে পড়েন, তাঁদের বার্তা দিতে টাকা ব্যয় করার মতো নির্বোধ নয় বিজেপি। ফলে মাস্কের খাঁড়ার ঘায়ে বিজেপি-র বলি হওয়ার অবকাশই নেই।
তবে মাস্ক নিজে বিজেপি-কে চটাতে চাইবেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে মোদি সরকারের সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক টানাপড়েন। ভারতের বাজারে টেসলার বিদ্যুৎচালিত গাড়ি নিয়ে বহু দিন ধরেই আবির্ভূত হতে চাইছেন মাস্ক। কিন্তু আমদানি শুল্কের প্রশ্নে বারবার আলোচনা আটকে গিয়েছে। চিনে টেসলার কারখানা রয়েছে। অর্থাৎ চিনে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে ভারতে মাস্ক ব্যবসা করবেন, তা হতে দিতে নারাজ মোদি সরকার। ভারতে ব্যবসা করতে হলে এদেশেই উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে শর্ত দেয় তারা, যাতে সম্মত হননি মাস্ক। তাই মোদি-নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে মাস্কের পক্ষে ট্যুইটারে বিশেষ ছাড় দেওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
মাস্কের অভিসন্ধি নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন আমাজন কর্তা তথা মাস্কের প্রতিদ্বন্দ্বী জেফ বেজোস। নাগরিকদের বাকস্বাধীনতায় আঘাত হেনে ২০০৯ সাল থেকে চিনে নিষিদ্ধ ট্যুইটার। ফলে ট্যুইটারও সেদেশের সরকারের সঙ্গে কোনও আপসের পথে হাঁটেনি। নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থকে সামনে রেখে মাস্ক চিনা সরকারের সঙ্গে ট্যুইটার নিয়ে সমঝোতায় গেলেও যেতে পারেন- এমন ইঙ্গিত দিতে দেখা গিয়েছে বেজোসকে। তাই ভারতে মোদি সরকারের ক্ষেত্রেও মাস্ক তেমন অবস্থান নিতেই পারেন। সেক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি-র আধিপত্য আরও মজবুত হবে।