বাংলা জুড়ে তাণ্ডব সুপার সাইক্লোন ‘রেমালে’র! কোথায় কত ক্ষয়ক্ষতি?

Cyclone Remal: রেমালের তাণ্ডবে কার্যত তছনছ হয়ে গিয়েছে কলকাতা-সহ বাংলার একাধিক এলাকা। এই অবস্থায় রেমাল পরবর্তী রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির রিপোর্ট চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

দুর্যোগের স্মৃতি ফিরিয়ে রবিবার দিনভর দাপিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। সন্ধে হতেই শুরু হয়েছিল তাণ্ডব। ক্রমশ পশ্চিমবঙ্গের কান ঘেঁষে বাংলাদেশে গিয়ে আছড়ে পড়ে সুপার সাইক্লোনটি। সেই যাওয়ার পথেই মোটামুটি বাংলায় খেলা দেখিয়েছে রেমাল।

বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা, বিশেষত উপকূল সংলগ্ন এলাকা এবং কলকাতা যে ঝড়ের প্রকোপে পড়বে, এমন সতর্কতা ছিলই। গোড়া থেকেই কোমর বেঁধেছিল প্রশাসন। আমফান, আয়লার স্মৃতি ফিরিয়েই রবিবার সন্ধ্যা থেকে রেমালের দাপটে কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে কলকাতা। আলিপুর আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪৬.২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যার জেরে জলমগ্ন শহরের বিভিন্ন এলাকা। একাধিক জায়গায় ভেঙেছে গাছ, উপড়ে গিয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। তার উপর আলিপুর আবহাওয়া দফতর তরফে জানানো হয়েছে,সোমবার দিনভর কলকাতা ও আশপাশের জেলাগুলিতে দুর্যোগ চলতে পারে।

কলকাতার একাধিক এলাকা জলের তলায়। পার্ক সার্কাস, ঢাকুরিয়া, বালিগঞ্জ, আলিপুর-সহ একাধিক এলাকায় হাঁটুজল। রেমাল ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় বহু এলাকায়। উপরে যায় বিদ্যুতের খুঁটি, ছিড়ে তারও। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করছে প্রশাসন। সোমবার সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন বলে কথা। সেই গতি যাতে কোনও মতেই ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে নষ্ট না হয়, সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। মেয়র ফিরহাদ হাকিম রাতেই আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘‘আপাতত কোনও ক্রাইসিস নেই।’’ বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও জানিয়েছিলেন, “কিছু কিছু জায়গায় ট্রান্সফরমার উড়ে গিয়েছে। পরিস্থতি দ্রুত স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে।”

আরও পড়ুন: শক্তিক্ষয় নামেই, বাংলাদেশেও যে তাণ্ডব চালাল রেমাল

সোমবার সকালে হাওয়া অফিসের প্রকাশিত বুলেটিনে জানানো হয়, ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত দমদমে ঝড়ের গতি ছিল সবচেয়ে বেশি। সেখানে ঘণ্টায় ৯১ কিলোমিটার বেগে হাওয়া বইতে দেখা গিয়েছে। বাংলাদেশে ঝড়ের গতি ছিল ১০০-র বেশি। তালিকা ‌অনুযায়ী, রবিবার রাতে ক্যানিংয়ে ৭৮ কিলোমিটার, বারুইপুরে ৬৭ কিলোমিটার, নিমপিঠে ৬৩ কিলোমিটার, ডায়মন্ড হারবারে ৬৯ কিলোমিটার, কলকাতায় ৭৪ কিলোমিটার, সাগর দ্বীপ এবং রায়দিঘিতে ৬৩ কিলোমিটার বেগে ঝড় হয়েছে। বাংলাদেশের পটুয়াখালিতে রাতে ঝড়ের গতি ছিল ১০২ কিলোমিটার। এ ছাড়া খেপুপাড়ায় ৮৯ কিলোমিটার এবং মোংলায় ৭৫ কিলোমিটার বেগে হাওয়া বয়ে গিয়েছে।

বঙ্গোপসাগর থেকে হাঁটতে শুরু করে গতি বাড়ায় ঘূর্ণিঝড় রেমাল, তার পর ঘণ্টায় প্রায় ১১ কিলোমিটার বেগে স্থলভাগের দিকে এগিয়ে শেষমেশ বাংলাদেশের মোংলার কাছ দিয়ে ডাঙায় প্রবেশ করে ঘূর্ণিঝড়টি। রবিবার সকাল পর্যন্ত প্রবল আকারেই ছিল ঝড়টি। পরে যত এগিয়েছে বাংলাদেশের কাছাকাছি, তত শক্তি ক্ষয় হয়েছে তার। সেই ক্ষয়িত শক্তি নিয়েই কম তাণ্ডব দেখায়নি রেমাল। রবিবার রাতে অন্তত রবিবার রাতে ১৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে কলকাতায়। দমদমে ৮৫ মিলিমিটার, সল্টলেকে ৯৭ মিলিমিটার, হলদিয়ায় ১১৯ মিলিমিটার, দিঘায় ৬৯ মিলিমিটার, ডায়মন্ড হারবারে ৯৪ মিলিমিটার এবং ক্যানিংয়ে ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সোমবার সকালেই বৃষ্টি চলছে বাংলার উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে। কোথাও কোথাও ঝড়ের গতি রাতের চেয়েও বেশি বলে জানান স্থানীয়েরা।

রবিবার ঝড়ের দাপটে কলকাতায় মৃত্যু হয়েছে ৫১ বছরের এক প্রৌঢ়ের। প্রবল ঝড়বৃষ্টি মাথায় করেই বাইরে থাকা ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে যান তিনি। রবিবার রাত সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে এন্টালি থানা এলাকার বিবির বাগান সংলগ্ন অংশে একটি বাড়ির কার্নিশ ভেঙে পড়ে মৃত্যু হয় তাঁর। বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে একটি বাড়ির তলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎই ঝড়ের দাপটে ভেঙে পড়ে বাড়ির কার্নিশ। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি সাজিদকে। চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন তাকে। রেমালের তাণ্ডবে শহরের কয়েকটি জায়গায় বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়েছে। শুধু এন্টালিতেই নয়, বাড়ি ভেঙেছে বহু জায়গাতেই। শিয়ালদহে একজনের জখম হওয়ারও খবর মিলেছে। বাড়ির পাঁচিল ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে ক্যামাক স্ট্রিটেও।

রেমালের তাণ্ডবে টলিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের মেট্রোর শেড ভেঙে যায়। উড়ে যায় গড়িয়া এলাকার কবি নজরুল মেট্রো স্টেশনের শেডও। দীর্ঘক্ষণ ব্যহত হয় মেট্রো পরিষেবা। সোমবার দেখা গেল মেট্রো স্টেশনের অন্য দৃশ্য। রেমালের দাপটে জলে ভাসল একাধিক মেট্রো স্টেশন। যার ফলে আংশিক ভাবে বন্ধ হল পরিষেবা। মেট্রো সূত্রে খবর, পার্ক স্ট্রিট-এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনের মাঝে জল জমে গিয়েছে। তার ফলে বন্ধ পরিষেবা। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে ফের কখন শুরু হবে মেট্রো যাতায়াত, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি। রবিবার বিকেলেও বন্ধ ছিল মেট্রো পরিষেবা। সেই রেমালের দাপটে সোমবারও দিনভর বিপাকে মেট্রোযাত্রীরা।

রেমালের জেরে রবিবার একাধিক দূরপাল্লার ও লোকাল ট্রেন বাতিল করা হয়েছিল। পরিস্থিতি বদলালো না সোমেও। সোমবার শিয়ালদহ শাখায় বাতিল করা হল একাধিক ট্রেন। ডায়মন্ড হারবার, নামখানা, ক্যানিং, বজবজ, হাসনাবাদ, মাঝেরহাট- হাসনাবাদ , বনগাঁ সহ একাধিক লাইনে ৪৬টি ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের দাপটে রাতভর চলেছে ঝড়-বৃষ্টির তাণ্ডব। এর জেরেই বাতিল ট্রেন। জানা গিয়েছে, রবিবার রাতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে একাধিক জায়গায় গাছ উপড়ে গিয়েছে। লাইনে জমেছে জল। বিদ্যুতের তার ছিড়ে গতকাল রাত থেকেই অন্ধকারে ডুবে নামখানা স্টেশন। ট্রেনেই বসে রয়েছেন যাত্রীরা। শিয়ালদহ দক্ষিণ এবং কড লাইনে একাধিক ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। নামখানা, ডায়মন্ড হারবার, ক্যানিং , বারুইপুর, হাসনাবাদ , বনগাঁসহ একাধিক রুটে ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি বাতিল হয়েছে মাঝেরহাট -হাসনাবাদ মাজেরহাট- বনগাঁ এবং মাঝেরহাট -ক্যানিং -এই সমস্ত লোকাল ট্রেনগুলি। আজকের জন্য আপাতত বাতিল করা হয়েছে এই সমস্ত লোকাল ট্রেন।

কলকাতা তো বটেই, জেলা থেকেও এল একের পর এক দুর্ঘটনার খবর। ঘূর্ণিঝড় রেমালের দাপটে মৌসুনি দ্বীপে মৃত্যু হল এক বৃদ্ধার। সোমবার সকালে ঘরে বসে খাওয়ার সময় তাঁর মাথায় গাছ ভেঙে পড়ে। ঝড়ের কারণে রবিবার রাত থেকেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশে দুর্যোগ শুরু হয়। মৌসুনি দ্বীপেও রাত জুড়ে চলে ঝড়ের তাণ্ডব। রবিবার রেমাল আসার আগেই উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাধে ইছামতি নদীর বাঁধে নামে ধস। ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ায় এলাকায়। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বাঁধ মেরামতিতে নেমে পড়েন গ্রামের মানুষ। সকাল থেকেই বৃষ্টির কারণে বাড়ছিল ইছামতির জলস্তর। সেই বাড়তি চাপ সামলাতে না পারেই ভাঙে দুর্বল নদীবাঁধ। বাঁধ ভাঙছে এই খবর পেয়েই বাঁধ মেরামতিতে নামেন গ্রামের লোকজন। বাড়ি থেকে ত্রিপল, বাঁশ, ইট এনে সারানো হয় বাঁধ। হাসনাবাদেরই বরুণহাটেও ভাঙে বাঁধ।

রেমালের দাপটে রাতভর তাণ্ডব চলেছে হাওড়া জেলাতেও। প্রবল ও ভারী বৃষ্টিতে বহু এলাকা ইতিমধ্যেই জলের তলায়। গাছ পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে যায় একাধিক এলাকা। হাওড়া পুরসভা, বালি পুরসভার বহু অঞ্চল জলের তলায়। কোথাও হাঁটু সমান জল। কোথাও তারও বেশি। হাওড়া স্টেশন সংলগ্ন এলাকা, বেলিসিয়াস রোড, হাওড়া ময়দান এলাকার বহু রাস্তা জলমগ্ন। হাওড়ার চার্চ রোডের কেলভিন কোর্টের রেলওয়ে আবাসনের ভিতর জল জমে আছে। ঘরবন্দি হয়ে আছেন বাসিন্দারা। নীচের ঘরগুলিতে জল ঢুকে গিয়েছে। গাছ পড়ে রয়েছে আবাসনের ভিতরে। জল না কমলে পরিস্থিতি উন্নতির জন্য কাজও শুরু করা যাবে না। আজ সোমবার সকালে বাসিন্দাদের মধ্যে শুকনো খাবার দেওয়া হয়৷ রেমালের তাণ্ডবে রাতভর ভারী বৃষ্টিতে হাওড়ার বালি পুরসভার ১৬টি ওয়ার্ডই এই মুহূর্তে জলমগ্ন। দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ।

রেমালের তাণ্ডবে কার্যত তছনছ হয়ে গিয়েছে কলকাতা-সহ বাংলার একাধিক এলাকা। এই অবস্থায় রেমাল পরবর্তী রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির রিপোর্ট চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্রের খবর, মুখ্যসচিবের কাছ থেকে তিনি ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছেন। জেলাশাসকদের মাধ্যমে রিপোর্ট তৈরির কাজ চলছে বলে নবান্ন সূত্রে খবর। দুই ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রাথমিকভাবে নবান্নে আসা রিপোর্ট অনুযায়ী, ১২০০ বিদ্যুতের খুঁটি নষ্ট হয়েছে, যার মধ্যে সুন্দরবনেই তিনশোর বেশি। এছাড়া ৩০০র বেশি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। জেলাশাসকদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি ব্লকের আলাদা করে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে বলে খবর নবান্ন সূত্রে। সমস্ত তথ্য পেলে এর পর বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠানো হবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। এমনই জানিয়েছেন মুখ্যসচিব বিপি গোপালিকা। এছাড়া সূত্রের খবর, কলকাতার রাস্তায় ভেঙে পড়া সমস্ত গাছ পরিষ্কার করে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করতে কলকাতা পুরসভাকে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কয়েকদিন বাদেই সপ্তম দফার লোকসভা ভোট। শেষ দফার নির্বাচনের আগে এটাই সময় শেষ প্রচার সারার। তবে রেমালের জেরে তাতে খানিকটা হলেও ভাটা পড়েছে। দুর্যোগের জেরে নিজের নির্বাচনী কর্মসূচিও সামান্য বদল করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীর প্রচারে রোড শো জনসভার সময় পরিবর্তন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: শক্তি কমলেও আজও তাণ্ডব রেমালের! কোথায় কোথায় তুমুল ঝড়-বৃষ্টি?

রেমালের ক্ষয়ক্ষতির ছাপ কতটা পড়তে চলেছে লোকসভার শেষ পর্যায়ের ভোটে। শহরের একাধিক জরুরি কেন্দ্রের ভোট রয়েছে সেদিন। নবান্ন সূত্রের খবর, রেমালের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রাজ্যকে দ্রুত সারিয়ে আনতে এমনিতেই তৎপরতা আরম্ভ করে দিয়েছে প্রশাসন। আবহাওয়া দফতর সূত্রে অবশ্য জানানো হয়েছে, সোমবারও সারাদিন বৃষ্টি হবে রাজ্যজুড়ে। এমনিতেই অতিরিক্ত বৃষ্টিতে জলমগ্ন শহর। এরপর আরও বৃষ্টির ধাক্কা সইতে পারবে তো মহানগর? সেই দুশ্চিন্তাতেই রয়েছে শহর কলকাতা।

More Articles