'পথের পাঁচালী'-তে ছিলই না চরিত্রটি! যেভাবে এক 'দেহাতি' কিশোরী হয়ে উঠল বাঙালির দুর্গা

Uma Dasgupta: বিভূতিভূষণ নিজেই জানাচ্ছেন, আদিতে এই দুর্গা চরিত্রই ছিল না। ভাগলপুরে থাকাকালীন এক ‘দেহাতি কিশোরী’-কে দেখে তাঁর মনে প্রথম দুর্গা চরিত্রটি আদল পায়।

সত্যজিৎ রায়ের জীবনীকার অ্যান্ড্রিউ রবিনসন উল্লেখ করেছেন, ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে দুর্গার মৃত্যু বিষয়টি সুগঠিত ছিল না গল্পের যুক্তি-বিন্যাসের দিক থেকে। সত্যজিৎ বরং ‘লেবু পাতায় করমচা/ হে বৃষ্টি ঝরে যা’ ছড়া বলা দুর্গার বৃষ্টি-স্নানের দৃশ্যের উপস্থাপনায়, তার মৃত্যুর যৌক্তিক পটভূমি তৈরি করতে পেরেছেন। তারপর দুর্গার প্রবল জ্বর— আর সেই অন্ধকার ঝড়-বাদলের রাত শেষে আমরা বুঝতে পারি, দুর্গা চলে গেছে। বালক অপুও গম্ভীর, নীরব। এই নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যায় যখন হরিহর ফিরে আসে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর। ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে দুর্গা চরিত্রের অভিনেত্রী উমা দাশগুপ্তর প্রয়াণের পর এই কথাগুলোই প্রথমে মনে আসছে। উমা দাশগুপ্ত অভিনয় করেছিলেন দুর্গা চরিত্রে গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে। ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৫ সালে আর উমা দাশগুপ্ত প্রয়াত হলেন ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর। প্রয়াণকালে বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। অপুর দিদি দুর্গা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উমা দাশগুপ্ত ১৪ বছর বয়সে। সম্ভবত, জীবনে একটিই মাত্র ছবিতে কাজ করেছিলেন তিনি।

সত্যজিৎ-পুত্র চিত্রপরিচালক সন্দীপ রায় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, উমা দাশগুপ্তের সঙ্গে পরে তেমন যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ‘পথের পাঁচালী’-র কাজ হয়েছিল যে সময়, তখন সন্দীপ রায় নিতান্তই শিশু। ফলে বিশেষ কিছু বলা তাঁর পক্ষে সম্ভবও নয়। উমা দাশগুপ্ত পরবর্তীকালে কেন অভিনয় করলেন না, এ বিষয়েও বিশেষ কিছু সংযোজন করা সম্ভব নয় সন্দীপের পক্ষে। তৎকালীন বোড়ালে শুটিংয়ের সেইসব দিনগুলির স্মৃতি নিজের অন্তরে নিয়েই উমা দাশগুপ্তের চিরবিদায়। অপু চরিত্রের অভিনেতা সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, গড়িয়ার কাছে সেই বোড়াল আজ আর চেনা যাবে না। শুটিংয়ের সময় দিদির মতোই অপু-রূপী সুবীরকে আগলে রাখতেন কিশোরী উমা। ট্রেন দেখতে যাওয়ার সেই দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল শক্তিগড়ের কাছে পালসিটে। কাশবনের মধ্যে দিয়ে প্রায় অলীক দুই শিশু ছুটতে থাকে রেল দেখতে। সেই দৃশ্যের দিকে আজও অপলক চেয়ে থাকি আমরা। ওই কাশবন, রেলগাড়ির শব্দ, স্টিম ইঞ্জিনের ধোঁয়া— বাস্তব না কুহক বলা কঠিন! হয়তো বাস্তবেরই সম্প্রসারণ। তাঁর মৃত্যু সংবাদ, সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন অভিনেতা ও বিধায়ক চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। উমা দাশগুপ্ত এবং চিরঞ্জিত একই আবাসনের বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগছিলেন উমা। পেশায় ছিলেন শিক্ষিকা। অথচ, জীবনের একটিমাত্র সিনেমায় দুর্গার ভূমিকাতেই চিরকালীন হয়ে থেকে গেলেন উমা।

আরও পড়ুন- সর্বজয়া নয়, আসলে ইন্দির ঠাকরুনেরই সন্তান দুর্গা…

অ্যান্ড্রিউ রবিনসন যে যুক্তিক্রমের কথা বলেছেন, সেই সূত্রে মনে পড়ে, ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের প্রথম খসড়ায় ছিল না দুর্গা চরিত্রটিই। তৃণাঙ্কুর দিনলিপিতে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস নিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শুনিয়েছেন এইসব নানা কথা। বিভূতিভূষণের কথায়— ১৯২৪ সালের পুজোর সময়টা থেকে এই বইয়ের কথাই ভেবেছিলেন তিনি। লেখা শুরু করলেন ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাস নাগাদ। কথায় বলে, বাংলা সাহিত্যের ‘পশ্চিমা’ টান। ছোট নাগপুরের মালভূমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বাঙালি লেখকদের সঙ্গে। বিভূতিভূষণও ‘পথের পাঁচালী’ লিখেছেন ভাগলপুরে। বিচিত্রা পত্রিকায় ১৯২৮-এর জুলাই মাস থেকে ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু হলো ‘পথের পাঁচালী’। ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মহালয়ার দিন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল এই উপন্যাস। পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়েছিল, বইয়ের আকার দেওয়ার সময়ে নানা অদলবদল ঘটান লেখক। বিভূতিভূষণ নিজেই জানাচ্ছেন, আদিতে এই দুর্গা চরিত্রই ছিল না। ভাগলপুরে থাকাকালীন এক ‘দেহাতি কিশোরী’-কে দেখে তাঁর মনে প্রথম দুর্গা চরিত্রটি আদল পায়।

স্মৃতির রেখা অনুসরণ করলে পাওয়া যাবে, ১৯২৮-এর ২৬ এপ্রিল বিভূতিভূষণ লিখছেন— "সন্ধ্যার সময় টেবিলে আলো জ্বলছে। লেখার পাতাগুলো ছড়ানো আছে (পথের পাঁচালী লেখা হচ্ছিল)। এই সন্ধ্যা, এই লেখার টেবিল অত্যন্ত রহস্যময়— অর্থযুক্ত— হয়তো একান্ন বছর পরে আমার কোনও চিহ্ন পৃথিবীতে খুঁজে মিলবে না।"

আশ্চর্য লাগে, এই উপন্যাস-রচনাকালে কেন ফিরে ফিরে আসছিল লেখকের নিজেরই মৃত্যু ভাবনা! দুর্গা অকালে চলে গিয়েছিল। বৃষ্টিতে ভেজামাত্র হাঁচি শুরু হয়েছিল গ্রামীণ ওই বালিকার। সিনেমায় দেখা গেল, গ্রামের চিকিৎসক অভয় দিলেন। সাবু খাওয়ার নিদান দিলেন। বলে গেলেন, ঠান্ডা যেন না লাগে। কী করবে দুর্গার মা সর্বজয়া? অমন ঘনঘোর ধারাবরিষণ, সেইসঙ্গে বিদ্যুতের ঝলক, বাজ পড়া আর প্রবল ঝড়-ঝাপটা। কী করে রক্ষা করবে কন্যাকে তার মা? বাড়ির চতুর্দিক ভাঙা। চটে ঢাকা পাল্লাহীন জানলা ঠেকিয়ে রাখা যায় না। বজ্র-বিদ্যুতের আলো এসে পড়ে শয্যাশায়ী দুর্গার মুখে। অন্ধকারে বিদ্যুতের ঝলকে দেখা যায় প্রবল হাওয়ায় দুলছে ঘরের গণেশ মূর্তিটি। প্রদীপের শিখা এই বুঝি নিভে যায়। জানলা-দরজারও ভঙ্গুর দশা। ছোট্ট একটা ঘরে ভাঙা জানলা দিয়ে ভয়ংকর হাওয়ায় যেন ভেসে আসছে মৃত্যু সংবাদ। ছোট ছোট বিষয় দিয়ে গড়ে উঠছে এক মৃত্যুর মন্তাজ।

‘পথের পাঁচালী’ ছবি প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে চিন্তক আশিস নন্দীর একটি লেখার কথা— ‘The Decline in the Imagination of the Village’। এই প্রবন্ধে লেখক সত্যজিৎ রায়ের ‘My Years With Apu’ এবং ‘অপুর পাঁচালী’ বই দু'টি থেকে দেখাচ্ছেন, বোড়ালে গিয়ে সত্যজিৎ আবিষ্কার করছেন নিজেকে। সেকথা স্পষ্ট জানিয়েওছেন সত্যজিৎ রায়। বিভূতিভূষণের উপন্যাসটিকে তিনি গ্রাম-জীবনের এনসাইক্লোপিডিয়া আখ্যা দিয়েছেন। আশিস নন্দীর যুক্তি, একটি গ্রামকে ঘিরে থাকে নানা পুঁথিলেখা, সংগীত, লোকপরম্পরা, লোকনাট্য এবং মহাকাব্যের বিপুল বিস্তৃতি নিয়ে আখ্যানের অনন্ত বিস্তার। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে নদী পার হয়ে পৌঁছে গেলে শোনা যায় ভিন্ন ভাষা, আবার মহাকাব্যেরও পৃথক প্রবর্তনা। আশিস নন্দীর প্রশ্ন, ‘আম আঁটির ভেঁপু’ – এই কিশোর সংস্করণকেই সত্যজিৎ গ্রাম-জীবনের এনসাইক্লোপিডিয়া বলেছেন? অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সদস্য সত্যজিৎ, একথা জানে গোটা ভারতবর্ষ কিন্তু বাংলার গ্রামজীবনের সঙ্গে পরিচয় কি তাঁর ঘটেছিল ‘আম আঁটির ভেঁপু’-র মাধ্যমেই?

আরও পড়ুন- কাজ না পাওয়ার অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ‘পথের পাঁচালী’-র হরিহর কানু বন্দ্যোপাধ্যায়

এ বিষয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সত্যজিতের এক কথোপকথনের কথাও উল্লেখ করেছেন আশিস নন্দী। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসটি সুনীল সত্যজিৎকে উপহার দিয়ে থাকলেও, বইটি সম্পর্কে বিশেষ কিছু শোনা যায়নি বিশ্ববরেণ্য এই চিত্রপরিচালকের দিক থেকে। তবে কি কেবল খণ্ড খণ্ড সময়চিত্রই ধরে রাখলেন সত্যজিৎ তাঁর ছবিতে? এই দৃশ্যাবলীর অপার মহিমার কথা কে-ই বা বলে শেষ করতে পারে! যে সভায় আশিস নন্দী আলোচনা করেছিলেন গ্রাম-জীবন বিষয়ে লেখকদের ঘাটতি বিষয়ে, সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন ইউ আর অনন্তমূর্তিও। তিনিও মেনে নেন এই প্রতর্ক। তবে শিল্পী সত্যজিৎ যেন বাস্তবিকই বুঝেছিলেন— ‘একটি বিভ্রম দেশে যেতে/ শুল্ক, ছাড়পত্র নেই, জলস্রোত নিজে দেবযান.../ ঘাসগুলি হালকা রোম, কাল বুঝি বৃষ্টি হয়েছিল।/ আজ সব ধুয়ে গেছে’।

‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে বর্ষা আগমনের আগেই গ্রামে হাজির হয়েছিল এক বুড়ো বাঙাল মুসলমান। রংচং করা টিনের বাক্সে তার খেলা। দুর্গাকে সে ডাকে— ‘এসো খুকি দেখে যাও। পয়সা লাগবে না।’ দুর্গা অবাক হয়ে দেখে, কত সাহেব, কত মেম, ঘর-বাড়ি, যুদ্ধ— সেসব কথা সে বলে শেষ করতেই পারবে না। রংবাহারি এত কিছুর পরই দুর্যোগের দামামা। আকাশ ছেয়ে কালো মেঘ। এর পরই বৃষ্টি, মহাঝড়, হু-হু পূবের হাওয়া, খানা ডোবা সব থইথই করছে। পথে-ঘাটে হাঁটু-জল। দিনরাত সোঁ-সোঁ আওয়াজ। দুর্গা কই মাছ ধরেছিল। তারপর জ্বর। কৃষ্ণ ত্রয়োদশীর অন্ধকারে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে দুর্গা। নিম-ছাল সেদ্ধর জল খেতে বড় কষ্ট। একে একে তাদের বাড়ির দেয়াল ভাঙে, পাঁচিল ভাঙে। এইখানেই আশিস নন্দী বলছেন, সুখ আনন্দ কিংবা দুর্যোগের ঘনঘটাকে পুনরাবিষ্কার (re-discover) করার কিছু নেই, বরং যোগাযোগ পুনঃস্থাপন (re-connect) করা।

আর-এক ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় এক মেরুকরণের কথা বলেছেন। গ্রাম-শহরের দূরত্ব বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি। গ্রাম-সমাজের বুননে থাকে নানা সূচিশিল্প। নতুন নতুন ভাব গ্রামের মানুষকে আন্দোলিত করে বটে, তবে গ্রামের কৌমসমাজ বিষয়ে শহরের শিল্পীকে হতে হবে অধিকতর অবগত। এই দ্বান্দ্বিক বিন্যাসে গ্রাম চিত্রণের কথা ভেবেছেন দুই চিন্তক। সিনেমা যেহেতু একান্তই শহুরে মাধ্যম, সেক্ষেত্রে গ্রামের নাট্য-পরম্পরাগুলিও দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তাৎপর্যপূর্ণভাবে স্থান করে নিতে পারেনি। এটা হয়তো বাঙালির সাংস্কৃতিক আধুনিকতার বড় সংকট। দুর্গা চরিত্রে যে কিশোরী অভিনয় করেছিলেন, সেই উমা দাশগুপ্ত সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানা এখনও সম্ভব হয়নি। হতে পারে, শিল্পী উমা নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন আলোকমালার উদ্ভাসন থেকে। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস বা ছায়াছবি নিঃসন্দেহে আমাদের বঙ্গজীবনের অঙ্গ। তাও কিছু প্রশ্ন তো থেকেই যায়। এতদিন পরেও, কোনও সূত্রে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি বিষয়ে উমা দাশগুপ্তের যদি কিছু উল্লেখযোগ্য সাক্ষাৎকার বা স্মৃতিচারণ পাওয়া যায়, তা অবশ্যই আমাদের শিরোধার্য হবে। সেদিনের বোড়াল বা পালসিট গ্রাম দেখা বিষয়ে উমা দাশগুপ্তর সঙ্গে তাবৎ স্মৃতিই যদি বিস্মৃতির অতলে যায়, তাহলে বলতেই হবে—

‘গ্রামের পথ নিজে যাত্রী আজ / আমি জেগে থাকি বা না থাকি/ ভুল দেখতে আপত্তি কী... জলস্রোত নিজেই দেবযান।'

 

গ্রন্থ সহায়:

১) বিভূতি রচনাবলী, খণ্ড ১, জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স
২) জয় গোস্বামী কবিতা সংগ্রহ ২, আনন্দ পাবলিশার্স (প্রথম সংস্করণ ১৯৯৭)
৩) Satyajit Ray: The Inner Eye, Andrew Robinson, Andre Deutsch
৪) Dissenting Knowledges, Open Futures : The Multiple Selves and Strange Destinations of, Ashis Nandy (Second Edition), Ed: Vinay Lal, OUP
৫) Exploring Emotional History, Rajat Kanta Ray, OUP
৬) বিশেষ ঋণ : কবি-প্রাবন্ধিক অভীক মজুমদার

More Articles