অপ্রয়োজনে অস্ত্রোপচার! ৩.৪২ লক্ষ জালিয়াতি! আয়ুষ্মান ভারতের নামে যা চলছে
Ayushman Bharat Fraud: সরকার জানিয়েছে, গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৮.৩৯ কোটি হাসপাতালে ভর্তি অনুমোদিত হয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে।
দরিদ্র মানুষদের যাতে সহজেই স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে কোনও অসুবিধা না হয়, যাতে চিকিৎসায় অর্থসামর্থ কোনও বাধাআ না হয়ে দাঁড়ায় তাই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প আয়ুষ্মান ভারত প্রধান মন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা (AB-PMJAY) চালু করে। এই আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের অধীনে প্রায় ৩.৪২ লক্ষ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ। এই প্রকল্পের অধীনে নাকি অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হয়েছে ব্যাপক পরিমাণে, জানিয়েছে সরকার।
কংগ্রেস সাংসদ মুরারি লাল মীনার একটি প্রশ্নের উত্তরে, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক লোকসভায় জানিয়েছে যে, ২০১৮ সালে শুরু হওয়ার পর চলতি বছরের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রকল্পের অধীনে মোট ৩৪২,৯৮৮টি জালিয়াতির ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮৬,৭৭১টি ঘটনা মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট এবং ৫৬,২১৭টি সার্জিক্যাল ম্যানেজমেন্ট বিভাগের।
রাজস্থানের দৌসার লোকসভার সাংসদ মীনা জানতে চেয়েছিলেন যে, সরকার এই প্রকল্পের অধীনে মৃত্যুর ঘটনাগুলি সম্পর্কে আদৌ সচেতন ছিল কিনা। সারা দেশ থেকে এমন অনেক অভিযোগই এসেছিল যে অপ্রয়োজনীয় অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি এবং অন্যান্য অস্ত্রোপচারের মতো নানা পদ্ধতিগত কারণে নামী হাসপাতালগুলিতেও বহু মৃত্যু ঘটেছে।
গত মাসে, আহমেদাবাদের খ্যাতি মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালে এমনই একটি ঘটনা ঘটে। এই আয়ুষ্মান প্রকল্পের অধীনে চিকিৎসা করাতে আসা দুই রোগীর মৃত্যু ঘটে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার পরে। পরে দেখা যায়, দুই রোগীরই অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। গুজরাত স্বাস্থ্য বিভাগ একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এই প্রকল্পের অডিট করার পরে পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালকে পরিষেবা প্রদান থেকে নিষেধ করেছে সরকার।
আরও পড়ুন- কোটি কোটি টাকা নয় ছয়! আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের নামে আসলে কী চলছে দেশে?
AB-PMJAY প্রকল্পের অধীনে সুবিধাভোগীরা তালিকাভুক্ত হাসপাতালে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরের স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পেতে পারেন। সরকারের দাবি, এ পর্যন্ত প্রায় ১২.৩ কোটি দরিদ্র আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবারকে এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। নির্দিষ্ট আয়ের সীমা ছাড়াই প্রকল্পটি এখন ৭০ বছর বা তার বেশি বয়সি সকলের জন্যই উপলব্ধ।
অন্য আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে সরকার জানিয়েছে, গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৮.৩৯ কোটি হাসপাতালে ভর্তি অনুমোদিত হয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে। এই ভর্তির পরিমাণকে অঙ্কে হিসেব করলে দাঁড়ায় ১.১৬ লক্ষ কোটি টাকা। তথ্য বলছে, এই বিপুল পরিমাণ ভর্তির মধ্যে ০.৫ শতাংশেরও কম ভর্তি ছিল জালিয়াতি।
এই ব্যাপক জালিয়াতির কারণ কী? প্রকল্প ঘোষণার পর কি সরকারের তরফে গোটা বিষয়টিই চলে গিয়েছিল খরচের খাতায়? কীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে, কীভাবে তা পরিচালিত হবে এই নিয়ে কি সরকার একেবারেই নজর দেয়নি? সরকার বলছে, কোনও ধরনের অপব্যবহার যে সহ্য করা হবে না, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই প্রকল্পটি পরিচালিত হয়েছিল। এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটতে পারে এমন বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি শনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপও করা হয়েছিল।
যেমন, ন্যাশনাল অ্যান্টি ফ্রড ইউনিট (NAFU) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের (NHA) অধীনে। সাসপেনশন, কারণ দর্শানোর নোটিশ, সতর্ক করে চিঠি পাঠানো, হাসপাতালের তালিকাভুক্তি, ই-কার্ড নিষ্ক্রিয়করণ, ভুয়ো হাসপাতালের জরিমানা আদায় এবং প্রতারণাকারী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের সহ যথাযথ পদক্ষেপ করার দীর্ঘ তালিকাও রয়েছে। তার পরেও কেন এত ভয়াবহ দুর্নীতি?
প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা বা PMJAY - আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের দু'টি উপাদানের একটির মূল্যায়ন করে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (CAG) জানিয়েছিল, দুর্নীতিতে ভরে রয়েছে কেন্দ্রের স্বাস্থ্য প্রকল্পটি! PMJAY-এর প্রথম CAG রিপোর্ট ছিল বিস্ফোরক। এই প্রকল্পের টাকা ভাগ হয় কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ৬০:৪০ অনুপাতে। কেন্দ্রীয় সরকার-স্তরে, জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বা NHA প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। রাজ্যগুলিতে কাজ করে রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ (SHAs) এবং জেলার ইউনিটগুলি। এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হচ্ছে পরিবার প্রতি চিকিৎসার খাতে ৫ লক্ষ টাকা দেওয়া। NHA-এর তথ্য বলছে, এখনও অবধি ২৪.৪২ কোটি মানুষ এই প্রকল্পে নাম লিখিয়েছেন এবং এদের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এখনও অবধি ৬৭,৪৫৬.২১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
ক্যাগের এই মূল্যায়ন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর ২০২১ সালের মার্চ অবধি করা হয়েছিল। অর্থাৎ এর মধ্যে COVID-19 মহামারীর সময়টিও রয়েছে। সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১৬১টি জেলার ৯৬৪টি হাসপাতালের উপর এই মূল্যায়ন হয়েছে৷ উল্লেখ্য, দিল্লি, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ এই প্রকল্পের আওতা থেকে বেরিয়ে এসেছে।
আরও পড়ুন- মোদি-মন্ত্রিসভার সিলমোহর, ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করতে কেন এত মরিয়া বিজেপি সরকার?
এই মূল্যায়নে দেখা গিয়েছে, ইনসিওরেন্সের নিষ্পত্তিতে বড় আকারের দুর্নীতি ঘটেছে। টাকা দেওয়ার আগে এই প্রকল্পের অধীনে থাকা হাসপাতালগুলি পর্যাপ্ত নিয়ম মেনে কাগজপত্র অবধি খুঁটিয়ে দেখেনি। ২.২৫ লক্ষ ক্ষেত্রে, অস্ত্রোপচার করার তারিখটি দেখানো হয়েছে 'ডিসচার্জের' অনেক পরে! স্রেফ মহারাষ্ট্রেই এই ঘটনাটি ঘটেছে ১.৭৯ লক্ষেরও বেশি! প্রায় ৩০০ কোটি টাকারও বেশি অঙ্কের হিসেব নেই ঠিকঠাক।
অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে, হাসপাতাল যবে টাকা দাবি করেছে এবং SHAs যখন টাকা দিয়েছে, সেই দুই তারিখই এত আগেকার যে তখনও আয়ুষ্মান প্রকল্পের সূচনাই হয়নি! এমনকী 'ক্লেম' করার ঢের আগেই হাসপাতালগুলিকে টাকা দেওয়া হয়েছে। ১৮ বছরের বেশি বয়সী রোগীদেরও নাকি 'পেডিয়াট্রিক স্পেশালিটি প্যাকেজ'-এর অধীনে চিকিত্সা করা হয়েছে!
অডিটে আরও দেখা গেছে, ৪৫,৮৪৬টি ক্ষেত্রে রোগী ভর্তির আগেই 'ডিসচার্জ হয়ে গেছেন খাতায় কলমে! এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে একজন রোগীকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একাধিক হাসপাতালে ভর্তি দেখানো হয়েছে। 'মৃত' হিসেবে দেখানো হয়েছে এমন কয়েকজনের জন্যও লাখ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। ট্রানজ্যাকশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের তথ্যে দেখা গেছে, ৮৮,৭৬০ জন রোগী চিকিৎসার সময়ই মারা গেছেন। তাও এখনও, ২,১৪,৯২৩টি 'ক্লেম' রয়েছে যাতে এই মৃত রোগীদের নাকি নতুন করে চিকিত্সার করানো হচ্ছে। ২৪টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে এই দাবি নিষ্পত্তিতে প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, কেরল এবং মধ্যপ্রদেশে এই ধরনের ঘটনা সবথেকে বেশি ঘটেছে।