আরও একটা সুভাষ জয়ন্তী পালন করতে আমাদের লজ্জা করে না?

Violence and Communalism in India : সুভাষবাদী কোনও নেতা তো আজ জোর গলায় বলছে না আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করো? উল্টে সঙ্ঘই বোঝাতে শুরু করেছে নেতাজি তাদের কাছের লোকই ছিল।

নেতাজি নেই। কোথাও নেই। বাঙালি মায় গোটা ভারতবর্ষের লোকই বহুকাল ভেবেছে, ভাবানো হয়েছে, এই বুঝি নেতাজি ফিরে এল। আমরা ভেবেছি, আমরা বলেছি কিন্ত গড়ার সময় আমরা ক্রমে এমন এক পরিসর নির্মাণ করেছি যেখানে আর যেই থাকুন না কেন, নেতাজি থাকতে পারেন না। আজকের ভারতে সিংহভাগের যে মানসলোক তার কাউন্টার পয়েন্টেই দাঁড়িয়ে আছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন। এই জীবনের বীজকে আমরা সেই কবেই পায়ে দলে চলে গিয়েছি ধর্মে ও জিরাফে। বেদনার স্মৃতির মতো কেউ ছেলের ডাকনাম রেখেছে সুভাষ, কোথাও টিমটিম করে জ্বলছে ওঁর নামে গড়া লন্ড্রির আলো, কিন্তু নেতাজি সেখানে নেই। এই ভারতের কোথাও নেতাজি নেই।

সুভাষচন্দ্র বসু বে়ড়ে উঠেছিলেম কটকের এমন এক পাড়ায় যেখানে হিন্দু মুসলিম একসঙ্গে থেকেছে। মহরমে আনন্দ করার বাল্যস্মৃতি পাওয়া যাবে তাঁর লেখাতেই। স্কুলে বহু সহপাঠী ও শিক্ষক মুসলিম ছিলেন। নেতাজি বারংবারই বলতেন, "হিন্দু-মুসলিম আলাদা করতে শিখিনি।" ওঁর দাদা শরৎচন্দ্র বসু বাংলার মুসলিম নেতাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতেন। ফলে বিদ্বেষের বিষ সুভাষের মনের দখল নিতে পারেনি কখনও। বরং সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন তিনি। বারংবার চেষ্টা করেছেন হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়ে বাংলায় যাতে একটা সরকার গড়ে তোলা যায়। ১৯৩৮-এর ডিসেম্বরে মহাত্মা গান্ধীকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেন, "যেসব রাজ্যে কংগ্রেস সরকার গঠন করেছে সেখানে সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিয়ে অনুসন্ধান করা উচিত। নিরন্তর পর্যালোচনার মধ্যে দিয়েই সংখ্যালঘুর সমস্যার সমাধান সম্ভব।" আজ এই এনআরসি-সিএএ জুজুর যুগে পর্যালোচনার কোনও জায়গা আছে?

আমরা সাম্প্রদায়িক, ধর্মনিবিড় রাজনীতির আঁচে নিজেদের গা গরম করছি, ভোট এলেই মেরুকরণের দামামা পেটাচ্ছে রাজনৈতিক দাদারা। ঘৃণার পাহাড় বুকে নিয়ে ভোট দিতে যাচ্ছি। সুভাষের নামে পতাকাও তুলছি। কী দ্বিচারিতা! ১৯৪০ সালের ৪ মে ফরওয়ার্ড ব্লকের কাগজে ‘কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক সংগঠন’ শিরোনামে সুভাষ সম্পাদকীয় লেখেন, “হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কোনও সদস্য কংগ্রেসের কোনও নির্বাচনী কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।” কই সুভাষবাদী কোনও নেতা তো আজ জোর গলায় বলছে না আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করো? উল্টে সঙ্ঘই বোঝাতে শুরু করেছে, নেতাজি তাদের কাছের লোকই ছিল!

সুভাষ যে হিন্দু-মুসলিম সংকীর্ণতা থেকে কতটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তা বোঝা যাবে তিনি কাদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন সেই দিকটা খুঁজলেই। ১৯৪১ সালে তাঁর অন্তর্ধান পর্বে পেশোয়ারে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন মিয়া আকবর শাহ। ইউরোপ থেকে এশিয়া সাবমেরিন যাত্রায় তাঁর একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী ছিলেন আবিদ হাসান। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম বাহিনী, যারা ইম্ফলে কোহিমায় লড়াই করল তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জামান কিয়ানি। ইম্ফলের কাছে এপ্রিল ১৯৪৪-এ তেরঙ্গা উত্তোলন করেন শওকত মালিক। এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়।

১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময়েই ইউরোপ থেকে এশিয়া আসেন নেতাজি। তিন মাসের যাত্রার পর তিনি এশিয়া এসে পৌঁছলেন, জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আজাদ হিন্দ আন্দোলন শুরু হল। আজাদ হিন্দ আন্দোলনে হিন্দু, মুসলিম, শিখ সব সম্প্রদায়ের সমান অধিকার ছিল। সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করতেন তাঁরা। আজাদ হিন্দ ফৌজে কোনও ভেদাভেদ ছিল না। লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারপর্বে গান্ধী দেখা করতে গিয়েছিলেন বন্দি সেনাধ্যক্ষদের সঙ্গে। তাঁরা গান্ধীকে বললেন, "আমাদের এখানে হিন্দু চা আলাদা মুসলিম চা আলাদা দেওয়া হয়। নেতাজি এমনটা কখনও হতে দেননি।" গান্ধী বললেন, "তোমরা এই অন্যায় মানো কেন?" শাহনওয়াজ খানরা সেদিন তাঁকে বলেছিলেন, "এসব আমরা মানি না, যে যা বলুক, আমরা চা খাবার সব ভাগ করেই খাই।"

আইএনএ-এর আদর্শ ছিল- ইত্তেহাদ, ইতেমাদ, কুরবানি। বাহিনীর ৪০ শতাংশ সদস্য ছিলেন মুসলিম। আইএনএ–র মেজর ছিলেন জইন–উল–আবেদিন। 'জয় হিন্দ' স্লোগানটি তাঁরই দেওয়া। বাহিনীর রিক্রুটমেন্ট অফিসার ছিলেন হুসেন মুস্তাক রনদেরি। আদাজ হিন্দ ফৌজ গঠনের জন্য নেতাজি যখন অর্থ সাহায্য নিচ্ছেন, সবচেয়ে বেশি সাহায্য এসেছিল মেমন আব্দুল হাবিব ইউসুফ মারফানির থেকে। সেই আমলে এক কোটি টাকা দিয়েছিলেন তিনি। আমরা সেই ইতিহাস কেন পাঠ্যবইয়ে পড়তে পাই না? কেন একজন মুসলিমকে বারবার পরিচয় দিতে হয় এই বলে যে, তিনি ভারতীয়, তিনি জঙ্গি নন? কেন তবরেজরা রামের নামে মার খেলে কেউ পাশে গিয়ে দাঁড়াই না? এ দেশে, এই মৃত্যু উপত্যকায় নেতাজির আদর্শ কোথায়? আমরা ভুলে গেছি, লালকেল্লায় ১৯৪৫ সালের নভেম্বরে যখন বিচার বসল, আজাদ হিন্দের যে তিন সামরিক নেতাকে ডাকা হল, তাদের একজনের নাম ছিল শাহনওয়াজ খান। ভুলে গেছি নেতাজির শেষ বিমানযাত্রায় একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী ছিলেন হাবিবুর রহমান।

ঐতিহাসিকদের একাংশ মনে করেন, স্বাধীনতার লগ্নে তিনি উপস্থিত থাকলে হয়তো দেশভাগ এড়ানো যেত। হরিপুরা কংগ্রেসের বক্তৃতায় নেতাজি বলেছিলেন, কংগ্রেসের আদর্শই হল, লিভ অ্যান্ড লেট লিভ। এই নীতির মূল আদর্শ ছিল অন্যের ধর্ম পোশাক খাদ্য সংস্কৃতিতে নাক না গলানো। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করে বলেন, "ভারতের স্বাধীনতা আসন্ন, মুসলিম সমাজের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। গত ১৭ বছর ধরে কংগ্রেস সামাজিক অন্যায় ও বৈষম্য রোখার চেষ্টা করছে। সেই কাজে আমরা সফল হবই।" এই দেশেই তো ফ্রিজে পছন্দের খাবার রাখার জন্য 'শাস্তি' পেতে হবে একজন মুসলিমকে। আমাদের আদর্শ, বাঁচতে হলে আমার শর্তেই বাঁচতে হবে। না হলে বাঁচতে দেব না। কোন মুখে নেতাজির জয়ধ্বনি দিই আমরা? কোন দেশে আমরা বারবার চাই নেতাজিকে?

নেতাজির স্মৃতিচারণে গান্ধী প্ৰথমেই লিখেছেন, নেতাজির জীবন থেকে সবার প্রথমেই শিখতে হয়, তিনি কীভাবে ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও আঞ্চলিকতার উর্ধ্বে উঠে একই উদ্দেশ্যে রক্তদানে সকলকে একজোট করার পথ নিয়েছিলেন। শাহনওয়াজ খানের লেখাতেও নেতাজির এই গুণের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। আমরা ভুলে গেছি এসব। ভুলে গেছি নেতাজির বেঁচে থাকার যাবতীয় অনুধ্যানকে।

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসঙ্ঘের প্রতি কী মনোভাব ছিল নেতাজির? জনসঙ্ঘের আদি অবতার হিন্দু মহাসভার মিটিং একাধিক বার ভেঙে দেয় সুভাষের ফরওয়ার্ড ব্লকের বাহিনী। এই হিন্দু মহাসভাই তো কলকাতায়, রুবিতে দুর্গাপুজোয় পুলিশের নাকের ডগায় গান্ধীর হত্যাদৃশ্য নির্মাণ করেছিল ২০২২-এর দুর্গাপুজোয়। নেতাজির ভক্তরা কেন ভেঙে দেয়নি সেই মঞ্চ? আরএসএস, জনসঙ্ঘ ও এবিভিপি নেতা বলরাজ মাধোক তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, “ হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাংলায় ভয় দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের ফরওয়ার্ড ব্লকের স্বেচ্ছাসেবীরা। তাঁর লোকেরা হিন্দু মহাসভার সভা ভেঙে প্রার্থীদের মারধর করত। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তা অগ্রাহ্য করে একটি সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। কথা বলার সময়ে তাঁর মাথায় একটি পাথর আঘাত করে এবং প্রচুর রক্তপাত হয়।”

যে ধর্মীয় রাজনীতিকে এত ঘৃণা করতেন সুভাষ, সেই রাজনীতির শতফুল আজ বিকশিত। আমাদের গণ বিস্মরণের সুযোগে দাঙ্গা লাগছে গোটা দেশে। এর মধ্যে আরও একটা সুভাষ জয়ন্তী পালন করতে আমাদের বুক কাঁপে না? আমাদের লজ্জা করে না?

More Articles